রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : মক্ষীরানী আফসানার সহায়তায় এক ব্যবসায়িকে জিম্মি করে আটক রেখে মোটা অংকের টাকা আদায়ের চেষ্টার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া কথিত সম্পাদক, মানবাধিকার সংগঠণের চেয়ারম্যান ও ভূমিহীন নেতা শহীদুলের বিরুদ্ধে বেরিয়ে এসেছে আরো চাঞ্চল্যকর কাহিনী।

কালিগঞ্জের বারোদহ গ্রামের দরিদ্র ইমান আলীর ছেলে শহীদুল ইসলাম স্থানীয় একটি হাইস্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণীতে পাশ করে নবম শ্রেণীতে উঠে আর পড়াশুনা করেননি। পরবর্তীতে হাড়িভাঙা বাজারের ঘড়ির মিস্ত্রীর কাজ করতেন। তাতে সুবিধা না হওয়ায় হাড়িভাঙা বাজারের একটি মাছের সেটে তিন হাজার টাকা মাসিক বেতনে কাজ নেয় শহীদুল। এ সময় ঝায়ামারির বহুল আলোচিত ওহাব আলী পেয়াদার সঙ্গে তার সাতক্ষীরায় যাতায়াত। বিয়ে করে আশাশুনির কল্যাণপুরের মকবুল হোসেনের মেয়েকে। একপর্যায়ে সে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ভোরের পাতার জেলা প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় বহন করতো। দাবি করতো জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে।

সে ২০১৭ সালে ঢাকায় চলে যায় শহীদুল। সেখানে বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে বাসা নেয় মধ্যম বড্ডার একটি বস্তির মধ্যে তিনতলায়। সেখানে পরিবেশ সংরক্ষণ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সাংবাদিক সোসাইটি এর চেয়ারম্যান নামের একটি সংগঠণের সাইন বোর্ড তোলে সে। বনে যায় ওই সংগঠণের চেয়ারম্যান। একইসাথে সে মানবাধিকার প্রতিদিন নামের একটি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে নিজেকে জাহির করতে থাকেন।

২০১৮তে পরিচয় হয় মালয়েশিয়া থেকে জেল খেটে ফেরৎ আসা কালিগঞ্জের মৌতলার আফসানা বেগমের। একপর্যায়ে আফসানাকে মক্ষীরানী বানিয়ে সাতক্ষীরার নারিকেলতলা এলাকায় পরিবেশ সংরক্ষণ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সাংবাদিক সোসাইটি’র সাইনবোর্ড তুলে চাকুরি দেওয়ার নামে প্রতারণা, ঘের দখল, জমি দখল, বিভিন্ন মানুষকে তুলে এনে মক্ষীরানীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ ছবি তুলে আটক রেখে ব্লাক মেইল করার কাজ শুরু করার অভিযোগ রয়েছে শহীদুলের বিরুদ্ধে।

স্থানীয় দায়িত্বশীল সূত্র জানান, মানবাধিকার সংগঠণের চেয়ারম্যান ও মানবাধিকার প্রতিদিন এর সম্পাদক হিসেবে সে সমগ্র জেলাজুড়ে জেলা প্রতিনিধি,উপজেলা প্রতিনিধি ও ইউনিয়ন প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়। কার্ড দিতে নেন বিভিন্ন অংকের টাকা। একপর্যায়ে তার প্রতিনিধিদের ব্যবহার করে বিভিন্ন এলাকার ঘের দখল, জমি দখল, চাকুরি দেওয়ার নামে মোটা অংকের টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। প্রভাব খাটাতে মুন্সিপাড়ার আনছার ক্যাম্পের পাশে শাহজাহান চেয়ারম্যানের ছেলে পলাশকে তার পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কার্ড দেয়া হয়। মক্ষীরানী আফসানার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠায় স্ত্রীর সঙ্গে শহীদুলের টানাপোড়েন শুরু হয়।

শহীদুল তার অপকর্ম জাহেজ করতে ও নিজেকে বড়মাপের ক্ষমতাধর দেখাতে শহরের ইটাগাছার শাহজাহান ড্রাইভারের কালো কাচ লাগানো গাড়ি (মিনি মাইক্রোবাস) ব্যবহার করতো। তার দলে বর্তমানে রয়েছে শহরের নিউমার্কেট এলকার হারবাল ডাক্তার মহিদুল, মাছখোলার ভানু বিবি, শ্যামনগরের মাদক সম্রাজ্ঞী মাছুরা, আশাশুনির ক্ন্দুুড়িয়া গ্রামের সাইফুল। ২০১৮ সালে প্রতিপক্ষদের কাছ থেকে আট লাখ টাকা ও অর্ধেক ঘের তাকে দেওয়ার শর্তে ভূমিহীনদের মাধ্যমে শ্যামনগরের চিংড়িখালির গুলিগফুরের ঘের দখল করতে যায় শহীদুল ও তার বাহিনীর সদস্যরা। দখল করার এক ঘণ্টা পর শহীদুল বাহিনীকে বিতাড়িত করেন গুলি গফুর।

কালিগঞ্জের নলতার জনৈক খালেকের কাছ থেকে খাস জমি পাইয়ে দেওয়ার নামে সাত লাখ টাকা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে শহীদুলের বিরুদ্ধে। শ্যামনগরের বাসিন্দা ও বর্তমানে সাতক্ষীরা শহরের সরকারপাড়ার জিএম রেজাউল করিম রেজাকে সদরের তুজুলপুরের খাস জমি পাইয়ে দেওয়ার নাম করে ঢাকার বাড্ডায় নিয়ে যেয়ে নগদ ও বিকাশের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

তুজুলপুরের কমল ঘোষের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি খাস হয়ে যাওয়ায় (মোহনপুরের) আনোয়ার হোসেনের ছেলে শাহজাহানকে কাগজপত্র করিয়ে দেওয়ার নামে কয়েক দফায় শহীদুল নিয়েছে কয়েক লাখ টাকা। মক্ষীরানী আফসানার ছেলে মেহেদীর কাছে পুরাতন মোটর সাইকেল বিক্রি করে বার বার পরিবর্তন করতে আপত্তি করায় সম্প্রতি পাটকেলঘাটার স্বপন সাধুর ছেলে সঞ্জিব সাধুকে( সাংসদ মোস্তফা লুৎফুল। লাহ’র এক সময়কার গাড়ি চালক ) তার সাতক্ষীরার বাসা ও পাটকেলঘাটার বাড়ি থেকে দু’ দফায় তুলে আনতে যায় শহীদুল। যশোরের মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করে প্রতারিত হওয়া শহরের মধুমোল্লারডাঙির লিটনসহ তার চার বন্ধুর টাকা ফেরৎ দেওয়ার নামে শালিসের মাধ্যমে নন জুডিশিয়াল স্টাম্পে চুক্তিপত্র ও কয়েকটি অলিখিত চেক নিয়ে নিজের কাছে রেখে ইতিমধ্যেই ৩০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছে শহীদুল।

লিটনদের বাবদ দেওয়া অলিখিত চেকের পাতায় জনৈক আব্দুল্লার নাম বসিয়ে একাউন্ট হোল্ডারের বিরুদ্ধে সম্প্রতি লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছে শহীদুল। টাকা আত্মসাৎ ও চেক প্রতারনা করার প্রতিবাদ করলে শহীদুল সম্প্রতি লিটন ও তার তিনসহকর্মীকে জেলের ভাত খাওয়ানোর হুমকি দিয়েছে। গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর আশাশুনির পাইথালী গ্রামের এক হিন্দু নাবালিকাকে নিয়ম বর্হির্ভুত ভাবে ধর্মান্তিত করা দশম শ্রেণীর স্কুল ছাত্রীকে বাড়ি থেকে তুলে আনার হুমকি দেয় শহীদুল, হাবাসপুরের এসএম শাহীন আলম, কুন্দুড়িয়ার সাইফুল ও জেরী মেম্বর। এ ছাড়াও রয়েছে শহীদুল ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ। শহীদুল জেলে যাওয়ার পর অনেকেই মুখ খুলতে শুরু করেছেন।

মধুমোল্লারডাঙির লিটন বলেন, তিনি আইনি সহায়তা পেতে শহীদুলের বিরুদ্ধে বুধবার থানায় সাধারণ ডায়েরী করেছেন। প্রতারণার ব্যাপারে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সায়েদ করিমের সঙ্গে শহীদুলের অনেকাংশে মিল রয়েছে।

সরকারপাড়ার জিএম রেজাউল করিম রেজা জানান, তার ৫০ হাজার টাকা ফেরৎ পেতে পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ করবেন তিনি।

(আরকে/এসপি/জুলাই ৩০, ২০২০)