আবীর আহাদ


গতকালের পর : বিরাট লোহার গেট । ভেতর থেকে বন্ধ । অবাক হয়ে দেখলাম, দোহা সাহেবের বাসভবনের দোতলায় একটি কক্ষে বাতি জ্বলছে । গেটের পাশের একটুখানি ছিদ্রপথে দৃষ্টি দিতেই দেখলাম আমার পরিচিত বিহারী দারোয়ানটা টুলের ওপর বসে ঝিমুচ্ছে । গেটে মৃদু টোকা মারলাম । ভেতর থেকে ক্ষীণ কন্ঠে ভেসে এলো, কৌন হ্যায় !

খান সাব, দরওয়াজা খোলো । আমি বললাম ।

কৌন হ্যায় এতনি রাত্মে ?

মুঝে তুম পেহছানতে হ্যায় । আমার মাছিছ দরকার । সিগারেট ধরাবো ।

খান মনে হলো আমার কন্ঠ শুনে চিনতে পেরেছে । ফলে গেটের পাশে ছোট্ট দরোজা খোলার শব্দ হলো । খান গলা বের করে বলে, আরে, আপনি !

আমি বলি, আর বোলো না, সিগ্রেটের নেশা লেগেছে, মাগার হামারা পাছ মাছিছ নেহি হ্যায় ।
খান ম্লান হেসে বাইরে বেরিয়ে এলো । আমি হাসি । খানও হাসে । খানকে একটা সিগারেট দিয়ে আমি নিজেও একটা ধরালাম । খান আমার খুব পরিচিত । পাশাপাশি বহুদিন বসবাস করার ফলে তার সাথে আমার বেশ ঘনিষ্ঠতাও আছে ।
কয়েকটি গাড়ি ঢোকার কথা বলতেই খান চাপাস্বরে বললো, আর বলবেন না, প্রায় এমন গভীররাতে এরা এখানে আসে । কী করে জানি না, তবে ভালই লাগে, আমাকে তারা বহুত বকশিশ দেয়------

আমি আর কথা বাড়ালাম না । আমার যা জানার জেনে গিয়েছি । খানকে আরেকটি সিগারেট দিয়ে আমি আমার বাসায় চলে আসি ।

রাত তখন দেড়টা । আমার বাসা, মানে এক কক্ষের সাবলেট । সার্ট-প্যান্ট ও জুতোসমেত বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে এসব নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভাবলাম । আমি আজ সত্যই এক মহাচক্রান্তের আখড়া আবিষ্কার করতে পেরেছি । কিছুতেই ঘুম আসছে না । বার বার ঘুরেফিরে একই প্রশ্ন, আমি এ কী দেখলাম ! রাতের আঁধারে কতিপয় মন্ত্রী, সামরিক ব্যক্তিসহ মার্কিন দূতাবাসের------! ভাবলাম, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধাও । আমার দেশের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই কোনো জঘন্য ষড়যন্ত্র । এতো রাতে কাকে কীভাবে কী বলবো ? কেউ তো আমার কথা বিশ্বাস করবে না । কাউকে বললে উল্টো আমিই না ফেঁসে যাই ! ভাবলাম, একমাত্র বঙ্গবন্ধু আমার শেষ ভরসা । তাকে এতরাতে কিভাবে এসব বলি ? আমার বাসায় ফোন থাকলে না হয় বঙ্গবন্ধুর বাসায় ফোন করলে কেউ না কেউ তো ধরতো । নানান এলোমেলো ভেবে তালা মেরে বেরিয়ে পড়ি । পাশেই আমরা এক মুক্তিযোদ্ধা-বন্ধু খালেকের বাসা । আগরতলা ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত কমান্ডো বাহিনীর সদস্যও ছিলো । আমার মতো তার সাথেও বঙ্গবন্ধুর খুব ঘনিষ্ঠতা । আমাদের এ-চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতেই হবে ।

খালেককে ঘুম থেকে জাগিয়ে সব খুলে বললাম । সিদ্ধান্ত নিলাম, এক্ষণি বঙ্গবন্ধুর বাসায় যাবো । যেভাবেই হোক, এ-খবর পৌঁছাতেই হবে । ভাবীও তাতে সায় দিলেন । তিনি চা তৈরি করে আনলেন । চা পান করতে করতে আমার মনে পড়লো, আমার এক চাচাতো ভাই হাবিলদার জহুর বঙ্গবন্ধুর বাসায় পাহারারত সেনাবাহিনীর লান্সার বাহিনীর সদস্য । বঙ্গবন্ধুর বাসার সামনে তাঁবুতে সে থাকে । গতকাল সকাল বেলা আমার খোঁজ নিতে এসে এ-কথা বলেছিল । পেয়ে গেলাম মওকা । খালেককে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম ।

তখন ভোর পাঁচটা । ধিরে ধিরে আকাশ ফর্সা হচ্ছে । আমি ও খালেক মিরপুর রোড থেকে ধানমন্ডির 32 নং রোডের গোড়ায় যেতেই দু'জন সেনা লান্সার আমাদের সামনে এসে গতিরোধ করলো । রাতে এ-রোড বন্ধ । কিছুতেই রোডে ঢুকতে দিলো না । নানান প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুললো । শেষমেশ আমি হাবিলদার জহুরের ভাই পরিচয় দিলে তারা স্বাভাবিক হলো । বললাম, তাকে খবর দিন, তার পারিবারিক একটা জরুরি খবর আছে ।

কাজ হলো । আমাদের দাঁড়িয়ে রেখে একজন জহুরভাইকে খবর দেয়ার জন্য চলে গেল । মিনিট বিশেকের মধ্যে জহুরভাই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। বললাম, তোমার তাবুর কাছে চলো, বসে জরুরি খবর বলবো । আমাদের সে নিয়ে গেল তার তাঁবুতে । ক্ষীণকন্ঠে বিস্তারিত খুলে বললাম, বঙ্গবন্ধুর সাথে আমাকে দেখা করতেই হবে । শুনে জহুরভাই জানালো যে, সে প্রেসিডেন্ট সাহেবের সাথে আমাদের দেখা করিয়ে দিতে কোনোই ভূমিকা পালন করতে পারবে না, তবে প্রেসিডেন্ট সাহেব একটু পরে নিচে নেমে বাসভবন-চত্বরে হাঁটতে বেরুবেন । নিচু ওয়ালের এপাশে দাঁড়িয়ে যদি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়, তখন যদি ডাকেন । জহুরভাই জানে, বঙ্গবন্ধু আমাকে খুব স্নেহ করেন । এটাই তার ভরসা ।

আমরা তাঁবু থেকে বেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসার সামনের নিচু ওয়ালের এ-পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম । তখন চারদিকে ফর্সা হয়ে উঠেছে । সহসা বঙ্গবন্ধু লনে নেমে এলেন । তাঁর পরনে লুঙ্গি-পাঞ্জাবি । হাতে পাইপ । তিনি কয়েকবার এদিকওদিক পায়চারি করার এক পর্যায়ে আমরা তাঁর দৃষ্টিতে পড়ে গেলাম । হাত উঁচিয়ে সালাম দিতেই কিছুটা বিস্মিত হয়ে পরক্ষণে হাত ইশারায় ডাকলেন । লান্সাররা গেট খুলে দেয় ।

শালপ্রাংশু দেহের অধিকারী বঙ্গবন্ধু ততক্ষণে রাসেলের দোলনার ওপর একখানি পা তুলে দিয়ে নিবিড় মনে পাইপ টানছেন । তাঁর মুখখানি লালচে । উজ্জ্বল । রক্তিম । থমথমে । মনে হচ্ছিলো ভাল ঘুম হয়নি । কাঁচাপাকা কয়েক গাছি চুল এসে পড়েছে কপালের ওপর । বঙ্গবন্ধুকে এ-অবস্থায় খুবই মায়াবি লাগছিল ।

জাদুভরা মিষ্টিমধুর জলদগম্ভিরকন্ঠে বঙ্গবন্ধু বললেন, কিরে মুক্তিরা ! এই সাতসকালে কী মনে কইরা ? কোনো সমস্যা ? দেইখা তো মনে হইতেছে রাতে ঘুমাও নাই ! এক নিঃশ্বাসে তিনি কথাগুলো বলে গেলেন । আমি ও খালেক বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে দাঁড়াই । তিনি দোলনার ওপর বসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই তো আবার রিপোর্টার । কোনো জরুরি খবর !

আমি হঠাত্ উত্তেজিত হয়ে চাপাস্বরে সমস্ত ঘটনা খুলে বলতেই বঙ্গবন্ধু সহসা প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলেন, উহ্, ষড়যন্ত্র ষড়যন্ত্র ষড়যন্ত্র ! কী পেয়েছিস তোরা ? যখনই কেউ আমার সামনে আসে তখনি শুধু বলে ষড়যন্ত্র ষড়যন্ত্র ষড়যন্ত্র ! তোদের খেয়েদেয়ে বুঝি কোনো কাজ নাই ? শুধু হুইসপারিং হুইসপারিং ! আমার রাষ্ট্রের ন'/দশটি গোয়েন্দা শাখা রয়েছে, তারা কী করে ? ঘাস কাটে ? তাদের কারো চোখে কিচ্ছুটি ধরা পড়ছে না, ধরা পড়ছে তোর চোখে ? তুই কোন গোয়েন্দার লোক-----!

আমি হুহুকরে কেঁদে তার পায়ের ওপর মাথা ঠেকিয়ে বলি, আপনি এক্ষণে পুলিশ পাঠিয়ে খোন্দকারকে ধরে এনে-----
বলা শেষ না হতেই বঙ্গবন্ধু আমাকে টেনে তুলে সস্নেহে বললেন, আমি জানিরে, তোরা মুক্তিরা আমারে কতো ভালবাসস । তারপর উদাসকন্ঠে বললেন, আমি তো একটা রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ । সবসময় যদি এ-ধরনের অশণির কথা শুনি তখন আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই ।------এখন এসব শুনতে আর ভাল্লাগে না । চারদিকে অশান্তি আর দুষ্চিন্তা নিয়ে আর কতো পেরেশানে ভুগবো ? দেশটা কি আমার একার ? ওরা তারা আর সব ওরা কী করে ! বলেই বঙ্গবন্ধু চাপা উত্তেজনায় হাঁফাতে থাকেন । আবার বললেন, তোরাই বল, আমি এখন কী করবো ? কাকে বিশ্বাস করবো ? কাকে অবিশ্বাস করবো ?

ঠিক তখনি অবাক চোখে দেখলাম, খোন্দকার মোশতাক এসে হাজির । তিনি গাড়ি থেকে নামছেন । তার মুখে মিটিমিটি হাসি । আমরা তাকাই সেদিকে । বঙ্গবন্ধুও তাকান । বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে একরাশ মৃদু হেসে বললেন, আসুন মন্ত্রী মহোদয় !

আমি খালেকের হাতে হেচকা টান মেরে পড়ি কি মরি ত্রস্তপায়ে সে-স্থান ত্যাগ করি । গেটের বাইরে বেরিয়ে ফিরে তাকাতেই দেখি বঙ্গবন্ধু আমাদের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ।

(চলবে)

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।