আবীর আহাদ


বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের রাজনৈতিক ও সামরিক চক্রান্তের সমন্বয়

বঙ্গবন্ধু সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য উনিশশো চুয়াত্তরে মার্কিন সরকার-সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ বেশিদিন প্রলম্বিত করা গেলো না । বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আওয়ামী লীগ অত্যন্ত সাফল্যের সাথে সেই দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করেন । তবুও স্বীকার করতেই হবে যে, সেই দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি অনেকখানি ক্ষুন্ন হয়ে যায় । মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের মধ্যে দিয়ে অর্জিত তিক্ত অভিজ্ঞতা ও দেশের মানুষের সার্বিক অর্থনৈতিক মুক্তির বৈপ্লবিক চিন্তায় বঙ্গবন্ধুকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পদক্ষেপ নিতে হয় । শুরু হলো বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের তথা বাকশাল নামক একক জাতীয় রাজনৈতিক প্লাটফরমে মাধ্যমে দ্বিতীয় বিপ্লব সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া । এতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং দেশীয় উঠতি ধনিক ও স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি প্রমাদ গণলো । তারা বুঝতে পারলো, শেখ মুজিব চরমতম পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন । তিনি তাদের শোষণ ও প্রতিপত্তি চিরতরে উৎখাতের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন । সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের এদেশীয় সেবাদাসরা দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু সরকারকে দুর্বল করেছে বটে কিন্তু তার পতন ঘটেনি । দ্রুততম সময়ের ভেতর তিনি দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন । এ-পর্যায়ে এসে তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে পড়ে । এ-লক্ষ্যে তারা দেশে অনাচার অন্তর্ঘাত নৈরাজ্য সৃষ্টিসহ হত্যাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বিশাল অংকের মার্কিন ডলারের একটি তহবিল গঠন করে ।

বহুদিন পূর্ব থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যা চক্রান্তের জাল বুনে এর মধ্যকার দেশীয় রাজনৈতিক ও সামরিক চক্রান্তের হোতারা একটি কমান্ডে আসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে । এ-প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক চক্রান্তের নায়ক সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাকের ও তার সহযোগীদের সাথে মেজর ফারুক-রশিদচক্রের মিলন ঘটে । আর এ-মিলনের পশ্চাতে ছিল মোশতাক-রশিদের মামা-ভাগ্নে সম্পর্ক । মূলত: মোশতাক-রশিদ বহু পূর্ব থেকে একে-অপরের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল ।

এন্থনী ম্যাসকারনহাস তাঁর 'বাংলাদেশ : এ লিগ্যাসি অব ব্লাড' গ্রন্থে মোশতাক-রশিদের মিলনের প্রথম ঘটনাটি দেখিয়েছেন মাত্র 02 রাজ্য আগস্ট '75 তারিখে । তিনি উল্লেখ করেছেন যে, মেজর রশিদ মোশতাকের সাথে পূর্ব নির্ধারিত এপয়ন্টমেন্ট অনুযায়ী মোশতাকের ঢাকাস্থ নিজস্ব বাসভবন আগামসিহ লেনে দেখা করেন । একজন রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীর সাথে একজন সামরিক অফিসারের সাক্ষাত্কারের বিষয়ে যাতে কারো মনে কোনো সন্দেহ না জাগে, তার জন্য রশিদ একখানি স্কুটার কেনার পারমিটের দরখাস্ত পকেটে রাখেন । মোশতাক তাকে দোতলায় তার শয়নকক্ষে নিয়ে যান । ম্যাসকারনহাসের রিপোর্টে একটি বিষয় আসেনি । তবে এ-লেখক (আমি) একটি ভিন্নসূত্র থেকে জেনেছিলেন, এ-সময় মোশতাকের ঘনিষ্ঠ সহচর মাহবুব আলম চাষী সেখানে উপস্থিত ছিলেন । কিছুক্ষণ টুকিটাকি বিষয়ে আলাপের পর মোশতাক, চাষী ও রশিদ দেশী-বিদেশি রাজনৈতিক ও তাদের সামরিক প্রস্তুতির ওপর প্রায় তিন ঘন্টা আলোচনা করেন ।

এরপর খুনি সামরিকচক্র বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সামরিক ও রাজনৈতিক দিকটা ভাগ করে মেজর ফারুককে হত্যাকাণ্ডের অপারেশন আর মেজর রশিদকে রাজনৈতিক ও অন্যান্য সামরিক নেতৃত্বকে ট্যাকল করার দায়িত্ব অর্পণ করে ।

খুনিচক্রের শলাপরামর্শ

১২রআগসট । ১৯৭৫ । ঢাকা সেনানিবাস । গল্ফ ক্লাব ।মেজর ফারুক ও তার স্ত্রী ফরিদার তৃতীয় বিয়ে বার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে উচ্চ পদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন । যারাই সেদিন আমন্ত্রিত হয়েছিলেন সম্ভবত: তারা সেই অনুষ্ঠানের স্মৃতি কোনোদিন ভুলতে পারবেন না । কে জানতো, সেই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে খুনিচক্র একটি হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার একটি উল্লাসঘন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল । এটাকে বলা চলে খুনিদের মহাসম্মেলন ।

ম্যাসকারণহাস এ-ভাবে বর্ণনা করেছেন, অনুষ্ঠানে সামরিক ব্যান্ডে আধুনিক বাংলাগানের সুর ভেসে আসছিল । ক্লাবের মধ্যে রান্না হচ্ছে । খাসির বিরিয়ানি, কাবাব, সুস্বাদু তরকারি ও নানান ধরনের সালাদ । চারপাশে প্রচুর সামরিক লোকজন । ডেপুটি চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, চীফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার মাশহারুল হক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন । ম্যাসকারনহাস জেনারেল জিয়ার উপস্থিতির বিষয়টি এড়িয়ে গেলেও মেজর ফারুকের লান্সার বাহিনীর এক হাবিলদার এ-লেখকের কাছে জিয়ার উপস্থিতির খবর নিশ্চিত করেছিলেন । কারণ ঐ হাবিলদারটি ছিলেন ফারুকের অতি ঘনিষ্ঠ এবং অনুষ্ঠানের অন্যতম তদারককারী । উপস্থিত হয়েছিল মেজর রশিদসহ বহু চাকরিরত ও চাকরিচ্যুত সামরিক অফিসারবৃন্দ । সকলেই ফারুক-ফরিদাকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছেন; সঙ্গে নিয়ে আসেন নানান দামি দামি উপঢৌকন ।

আনন্দ উল্লাসের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হলো । একে একে সকলেই বিদায় নিলেন । মেজর ফারুক তার ভায়রা রশিদকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে বলে, আমি ওটা পনেরো তারিখে করতে যাচ্ছি । শুক্রবার সকালেই আমি মুজিবকে চিরদিনের মতো সরিয়ে দিতে চাই ।

রশিদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এদিকওদিক থাকায় । তাদের কয়েক মাসের গোপন পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে । তবে রশিদকে ঢেকুর গিলতে ও মুষড়ে যেতে দেখে ফারুক তাকে ভয় দেখায় । বলে, আমি ব্যর্থ হলে আমার সাথে তোমাকেও ফাঁসিতে লটকাবে । রশিদ তাকে অভয় দিয়ে বলে, কোনো চিন্তা কোরো না, আমিও প্রস্তুত । রশিদ এ-পরিকল্পনায় আরো অফিসারদের সম্পৃক্ত করার প্রস্তাব দিলে ফারুক ম্লান হেসে সম্মতি দেয় ।

তেরো আগস্ট । দুপুর আড়াইটায় মেজর রশিদ তার মামা খোন্দকার মোশতাকের সাথে তার আগামসিহ লেনের বাড়িতে এক বৈঠকে মিলিত হয় । রশিদ জানতে গিয়েছিল যে, আগামী কিছুদিনের মধ্যে দেশের বাইরে যাবার মোশতাকের কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা । মোশতাক না-সূচক জবাব দেন । ধূর্ত শেয়াল চরিত্রের মোশতাক যে সমস্ত ধরাছোঁয়ার ঊর্দ্ধে থেকে এই পুঁচকে মেজরচক্রকে খেলাচ্ছেন, তা এই কামলাবাহিনী বুঝতেই পারছে না । রশিদের বদ্ধমূল বিশ্বাস, খোন্দকার মোশতাকের কাছে সে সম্পূর্ণ নিরাপদ । কারণ তিনি তার মামা । মোশতাকের সাথে যোগাযোগের পূর্বে রশিদ সামরিক বাহিনীর ভেতরকার মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অফিসারদেরকে এ-প্রক্রিয়ায় মোশতাকসহ অনেক মন্ত্রী ও রাজনীতিক যে জড়িত সে-বিষয়টি নিশ্চিত করতে সক্ষম হয় ।

তবে রশিদ সামরিক বাহিনীর কর্মরত অফিসারদের ওপর খুব একটা আস্থা রাখতে পারছিল না । সে ভাবলো, মুজিবের আমলে সামরিক বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুতরা তাকে সহযোগিতা করবে বেশি । রশিদ জানতো, বেশকিছু অফিসারকে নানান দুর্নীতি ও শৃঙ্খলাজনিত কারণে সেনাবাহিনী থেকে বিদায় দেয়া হয়েছে । তারা মানসিকভাবে মুজিববিরোধী । এ-পর্যায়ে রশিদের সর্বপ্রথম মেজর ডালিমের কথা মনে পড়ে । মেজর শরীফুল হক ডালিমকে কয়েক মাস পূর্বে চরম শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে সামরিক বাহিনী থেকে অবসর দেয়া হয়েছিল । ধূর্ত ও ড্যামকেয়ার-ভাব ডালিমের সামরিক বাহিনীর সকল পর্যায়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে ছিলো উঠাবসা । তার চাকরিচ্যুতিতে সে সেনাবাহিনীর মধ্যে নানান কল্পকাহিনী ফেঁদে একটা বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করে ।

অপরদিকে রক্ষিবাহিনী গঠন এবং সামরিক বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান-প্রত্যাগত অফিসার-সৈনিকদের মধ্যকার মনোস্তাত্ত্বিক বিরোধের কারণে নানান কোন্দল কাজ করছিল । এটাই ছিল খুনিচক্রের একটা মস্তবড় হাতিয়ার । এ-হিশেবে রশিদ ধূর্ত ডালিমকে তার সাথে দেখা করার আমন্ত্রণ দেয় । রশিদের আর্টিলারী বাহিনীতে তারই অধীনেই ইতোপূর্বে সে চাকরি করতো । ফলে ডালিমকে পাওয়া যাবে বলে সে নিশ্চিত হয় ।

ডালিম তেরো আগস্ট সকাল বেলা রশিদের বাসায় আসে । রশিদ সবকিছু তাকে খুলে বলতেই সে রাজি হয়ে যায় । ডালিম প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে ইতোপূর্বে চাকরিচ্যুত মেজর নূরের নাম প্রস্তাব করে । রশিদ এতে রাজি হয় এবং তাকেসহ ডালিমকে তার বাসায় রাতের খাবারের আমন্ত্রণ জানায় ।

রাতের খানা শেষে তারা তিন মেজর পুরো পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত ছক আঁকে । তারা বঙ্গবন্ধুর স্থলে খোন্দকার মোশতাকে মনোনীত করে । কিন্তু মোশতাককে পাওয়া যাবে, বিষয়টি সম্পর্কে নূরের মনে সংশয় জাগে । রশিদ নূরকে চৌদ্দই আগস্ট বিকেল পাঁচটায় আণবিক শক্তি কমিশন কার্যালয়ের সামনে থাকতে বলে । নূরকে সে মোশতাকের বাড়িতে নিয়ে যাবে । নূর সম্মতি দেয় ।

পূর্ব নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে মেজর রশিদ সবিসম্ময়ে দেখে যে, নূরের পাশে আরেক মেজর শাহরিয়ার দাঁড়িয়ে আছে । শাহরিয়ারই প্রথমে রশিদকে অভ্যর্থনা জানায় । মেজর রশিদ বেশ আশ্বস্ত হয় । অত:পর তিন মেজর সাহেব মোশতাকের বাড়ির দিকে গমণ করে ।

মোশতাক এই তিন মেজরকে খুবই আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করেন এবং তার শয়নকক্ষে নিয়ে যান । নূর ও শাহরিয়ার মোশতাকের আতিথিয়তায় দারুণ মুগ্ধ হয় ।

এখানে তারা সৌজন্যমূলক আলোচনা শেষ করে ফেরার পথে নূর ও শাহরিয়ার যে-কোনো সময় যে-কোনো পরিস্থিতিতে তাদেরকে পাওয়া যাবে বলে তারা রশিদের কাছে অঙ্গিকার করে । রশিদ তখনি তাদেরকে আজ রাত দশটায় নির্মাণাধীন নিউ এয়ারপোর্ট প্রশিক্ষণ মহড়া কেন্দ্রে তার ও ফারুকের সাথে সাক্ষাত করার প্রস্তাব দেয় । নূর ও শাহরিয়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি জানায় ।

(চলবে)

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।