শিতাংশু গুহ


‘ঈদুল আয্হা’ বা কোরবানী’র ঈদ চলে গেলো। প্রবল বন্যা এবং করোনা ভাইরাসের মধ্যে যতটা সম্ভব মুসলমানরা ঈদের আনন্দ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। কোরবানীর ঈদে গরু কোরবানী হবে সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু একজন কমরেড যখন কোরবানী দেন্, সেটি চমকপ্রদ? তাও সেই কমরেডের নাম যদি হিন্দু হয়, তবে তো কথাই নেই! বরিশালের বাসদ নেত্রী কমরেড ডাঃ মনীষা চক্রবর্তী গরু জবাই দিয়ে সবাইকে তাঁক লাগিয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মাংস গরীব মুসলমানের মধ্যে বিতরণ করেছেন। একজন অভিনেত্রী বিদ্যা সিনহা মিমও তাঁর মুসলমান কর্মী ও গরিবদের জন্যে খাসী কোরবানি দিয়ে আলোচনায় এসেছেন। আরো একজন বিএনপি’র নেত্রী অপর্ণা রায় ঢাকঢোল পিটিয়ে ঈদে মুসলিম উম্মার শ্রীবৃদ্ধি কামনা করেছেন। হয়তো এসব দেখে সামাজিক মাধ্যমে একজন আব্দুল্লাহ এন নোমান বলেছেন, ‘ধর্ম যার যার, ‘গরুর মাংস সবার’।

এখানেই শেষ নয়! ক্রিকেটার মুশফিকুর রহমান গরু কাঁটার রক্তাক্ত ছুরি হাতে নিয়ে নিজেই নিজের ছবি পোষ্ট করেছেন। বেশকিছু মানুষ এটি পছন্দ করেছেন। অনেকে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। কিছুদিন আগে ক্রিকেটার সৌম্য সরকার দুর্গাপূজার ছবি পোষ্ট করেছিলেন, মুশফিকুর রহমান তখন এ ধরণের ছবি পোষ্ট না করার পরামর্শ দিয়ে সৌম্যকে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ এসব পছন্দ করেনা’? এ সবের মধ্যেই চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার দক্ষিণ ধর্মপুর মগদ্বেশ্বরী মন্দিরে কারা যেন গরুর মাংস ফেলে গেছে। রাঙ্গুনিয়ার এক হিন্দু ব্যবসায়ীর দোকানে একই কান্ড ঘটেছে। এ ধরণের ঘটনা প্রতি বছর ঘটে? প্রশাসন খুব একটা মাথা ঘামায় না! কোরবানী ধর্মাচারের অংশ, কিন্তু যাঁরা গরুর হাড়-গোড় মন্দিরে ফেলেন তাঁদের বোঝানো উচিত যে, ওটি ধর্ম নয়! অন্য ঘটানগুলো তেমন আলোচিত না হলেও ডাক্তার মনীষা চক্রবর্তী’র গরু কোরবানী নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।

বাসদ এনিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করে হিন্দুদের বেদের রেফারেন্স টেনে বলতে চেয়েছেন, মনীষা একটি মহৎ কাজ করেছেন। ভাবখানা এই যে, বাসদ বেদকে সংগঠনের গঠনতন্ত্র হিসাবে গ্রহণ করবেন? বলা হচ্ছে, বাসদ ডাঃ মনীষাকে কোরবানী দিতে বাধ্য করেছে। প্রশ্ন হলো, কমরেড খালেকুজ্জান নিজে কেন এ মহৎ কাজটি করলেন না? অথবা তিনি কি পারবেন অন্য কোন মাংস আদিবাসীদের মধ্যে বিতরণ করতে? বাসদ বা বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের তো ধর্ম নিয়ে মাথাব্যথা থাকার কোন কারণ ছিলোনা? ডাঃ মনীষা অবশ্য নিজেকে মানুষ হিসাবে বর্ণনা করে একটি বিশদ ব্যাখ্যা দিয়ে সবাইকে মানবিকতায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এমনিতে ডাক্তার হিসাবে তিনি মানুষের সেবা করে থাকেন। গরিবের জন্যে গরু কোরবানী দেয়াটা জনসেবা বটে? তবে লক্ষ্য হয়তো ভোট। প্রচার বা নির্বাচনে জয়ের জন্যে কুরবানীকে ব্যবহার করা কতটা সমীচীন, তা কমরেডদের মাথায় ঢুকবে না!

এ নিয়ে বিতর্ক বিতণ্ডায় পরিণত হোক তা কাম্য নয়। তবে ডাক্তার মনীষা মেয়র হতে চান, তিনি মেয়র হবেন। ভোট চাই? গতবার নির্বাচনে অল্পের জন্যে তিনি ভালোভাবে হেরেছেন। এবার ভোট বাড়াতে হয়তো তাই কমরেডের ধর্ম নিয়ে রাজনীতি। লোকে বলছে, সম্প্রতি বরিশাল কলেজে’র নাম অশ্বিনী কুমার দত্ত রাখার পক্ষে আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। এতে মানুষ তাঁকে হিন্দু হিসাবে চিহ্নিত করে? ম্যাডাম ডাক্তার হয়তো সেই দুর্নাম ঘুঁচাতে এবার কোরবানী দিলেন? হিন্দুরা বলছেন, ডাক্তার মনীষা গরিব নির্যাতিত মানুষের পক্ষে কাজ করছেন, ভালো কথা; কিন্তু বাংলাদেশের নির্যাতিত হিন্দুর পক্ষে তো তাঁর মুখ দিয়ে একটি শব্দও বের হয়না? ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’? হটাৎ করে তিনি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ-এর ‘ধর্মকর্ম সমাজতন্ত্র’ আঁকড়ে ধরলেন কেন? এ ফর্মুলায় কিন্তু বামফ্রন্টে জোয়ার আসেনি। ডঃ মোজাফ্ফর আহমদ নিজে কখনো এই ফর্মুলায় নির্বাচনে জয়ের স্বপ্ন দেখেন নি!

যদি ভোটের জন্যে ডাঃ মনীষা এ কাজ করে থাকেন তবে তিনি হতাশ হবেন। এতে ভোট কমবে। তদুপরি, নির্বাচনে জিততে কি আজকাল আর ভোট দরকার হয়? এরচেয়েও বড় প্রশ্ন, নৌকায় না উঠলে কি কমরেডরা নির্বাচনে জেতেন? আর একবার নৌকায় উঠে গেলে ‘নাহিদ’ বা ‘ইনু’ হতে কতক্ষন? বড়জোর ‘মতিয়া’? বাংলাদেশের কমরেডরা এক আজব চীজ! সবার ছেলেমেয়ে আমেরিকায়, আর ওনারা ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’ শ্লোগান দিয়ে লাল ঝান্ডা উড়িয়ে রেখেছেন। ব্যতিক্রম আছে, তবে ‘ধর্মকর্ম সমাজতন্ত্র’ মার্কা মেকি কমরেডের কাছে এরা নস্যি। একজন হিন্দু ঈদে শুভেচ্ছা জানাবেন, মুসলমান বন্ধুর বাড়ী বেড়াতে যাবেন, এটি স্বাভাবিক। কিন্তু একজন হিন্দু কোরবানি দেবেন, এটি বেমানান। হয়তো এসব কারণে কেউ কেউ এটিকে বিতর্কিত করতে চাইছেন। অন্যরা বলছেন, এটি সম্প্রীতি ও প্রগতিশীলতার চমৎকার দৃষ্টান্ত। হিন্দুরা বিরক্ত। কেউ কেউ মনীষাকে যোগেন মন্ডলের সাথে তুলনা করছেন।

মনীষা কি ‘আপনি আচরি ধর্ম’ শেখাতে চেয়েছেন? তিনি কি চেয়েছেন তা তিনি জানেন।

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।