টাঙ্গাইল প্রতিনিধি : টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বাণিজ্যিক এলাকা ঐতিহ্যবাহী করটিয়া কাপড়ের হাট প্রায় দেড় মাস যাবত বন্যার পানিতে ভাসছে। এতে বিপাকে পড়েছে পাইকারী বিক্রেতা ও স্থানীয় ইজারাদার। বিকিকিনি হচ্ছেনা, রাজস্ব আদায়ও বন্ধ রয়েছে। 

ইতিহাস থেকে জানা যায়, টাঙ্গাইল শাড়ির ইতিহাসের সঙ্গে করটিয়া হাটের ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। প্রায় দু’শ বছর এ হাটের আয়ুস্কাল বলে জনশ্রুতি আছে। প্রাচীণকালে টাঙ্গাইলের তাঁতিরা মসলিন শাড়ি বুনতেন। এর স্বার্থক উত্তরাধিকারী হয়ে এখনও টিকে আছে টাঙ্গাইলের জামদানি, বেনারসি ও হাতেবুঁনা তাঁতের শাড়ি। অতীতে মুসলিম তাঁতিদের বলা হত ‘জো-ওয়ালা’ বা ‘জোলা’, ফার্সি শব্দ ‘জোলাহ’ থেকে এর উৎপত্তি। জোলাদের সংখ্যাধিক্য ছিল টাঙ্গাইল শহর, কালিহাতী ও গোপালপুর এলাকায়। অপরদিকে, যুগী বা যুঙ্গীদের নাথপন্থী ও কৌলিক উপাধি হিসেবে দেবনাথ বলা হয়। ক্ষৌম বস্ত্র বা মোটা কাপড় বোনার কাজে এদের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। তাদের সুতা কাটার চড়কা ছিল। সে সময়ে তাঁতিরা অবস্থাসম্পন্ন থাকায় তাদেরকে বুদ্ধিমান হিসেবে বিবেচনা করা হত। তাঁতিদের চড়কা এখনও ভারতের জাতীয় পতাকায় শোভা পায়। পরিবারের নারী-পুরুষ সবাই সুতা কাটা ও কাপড় বুনতেন। যুগীরা ক্ষৌম, গামছা, মশারি তৈরি করে প্রায় স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতেন।

আরও জানা যায়, টাঙ্গাইলের হিন্দু তাঁতিদের মৌলিক উপাধি বসাক। বাজিতপুর ও নলসুন্দা গ্রামেই তাদের অনেকে বাস করেন। তবে বল্লা ও রতনগঞ্জে জোলার সংখ্যা বেশি।

দেশ ভাগের আগে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির বাজার বসতো কলকাতায়। টাঙ্গাইলের তাঁতিরা চারাবাড়ি, পোড়াবাড়ি ও নলছিয়া ঘাট এবং সুবর্ণখালী বন্দর থেকে স্টিমার, লঞ্চ ও জাহাজে চড়ে কলকাতায় যেতেন। দেশ ভাগের পর টাঙ্গাইল শাড়ির প্রধান হাট ছিল জেলার বাজিতপুরে। শুধু দেশি পাইকাররাই নন, ভারত ও ইংল্যান্ড থেকেও শাড়ি কিনতে আসতেন ক্রেতারা।

টাঙ্গাইল শাড়ির এমন চাহিদা আর দেশ-বিদেশের ক্রেতাদের আগমন দেখে টাঙ্গাইলের বিখ্যাত করটিয়া জমিদার পরিবার একটি হাটের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। পন্নী পরিবারের সদস্য ওয়াজেদ আলী খান পন্নী ওরফে চাঁদ মিয়া করটিয়ার বিশাল এলাকাজুড়ে একটি হাট প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময় করটিয়া ছিল একটি নদীবন্দর। সেখানে সপ্তাহজুড়ে হাট বসতো। শাড়ির পাশাপাশি গবাদিপশু, হাতে তৈরি তৈজসপত্রসহ নানা সামগ্রী বিক্রি হত। প্রতিষ্ঠার পর পাট ও গবাদিপশুর জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে এ হাট। পরবর্তী সময়ে টাঙ্গাইল শাড়ির জন্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সে সময়ের জনপ্রিয় যাতায়াত মাধ্যম ছিল নদীপথ। এ হাটটি মাহমুদগঞ্জ কাপড়ের হাট হিসেবেও পরিচিতি লাভ করে।

প্রায় দুইশ’ বিঘা জমির ওপর হাটটি প্রতিষ্ঠিত। লক্ষাধিক ব্যবসায়ী হাটে বিকিকিনি করেন। শাড়ির পাশাপাশি শালের জন্যও বিখ্যাত এ হাট। এখান থেকেই অনেক জেলার কারিগরদের তৈরি চাঁদর ভারত, বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) ও কয়েকটি শীত প্রধান দেশে রপ্তানী হয়।

করটিয়া হাট সপ্তাহে সাধারণত বৃহস্পতিবার বসে। কিন্তু তাঁতিদের চাহিদার কারণে বর্তমানে সপ্তাহের মঙ্গলবার বিকালে শুরু হয়ে বৃহস্পতিবার বিকালে শেষ হয়। দেশের নানা স্থান থেকে আসা পাইকাররা এখানের শাড়ি কিনে খুচরা বিক্রি করেন। সপ্তাহে ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার লেনদেন হয় এ হাটে। খোলা মাঠে শাড়ি বিক্রির পাশাপাশি হাটে তৈরি করা হয়েছে অর্ধশতাধিক বহুতল মার্কেট। টাঙ্গাইল শাড়ির পাশাপাশি প্রিন্টের শাড়িও পাওয়া যায়। ঢাকার ইসলামপুর, নরসিংদীর বাবুরহাট, সিরাজগঞ্জের বেলকুচি ও এনায়েতপুর থেকে শাড়ি আসে। বর্তমানে শাড়ি ও শালের পাশাপাশি লুঙ্গি, চাদর, থ্রিপিস এবং শিশুদের পোশাক পাওয়া যায়। পাইকারির পাশাপাশি খুচরা বিক্রিও হয়।

স্থানীয়রা জানায়, চলতি বছর এক কোটি ৭২ লাখ টাকায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ‘দিবা এণ্টারপ্রাইজ’ হাটের ইজারা পেয়েছে। দিবা এণ্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী সাইফুজ্জামান সোহেল জানান, করোনা ও বন্যার কারণে হাট বন্ধ থাকায় ইজারামূল্য উঠানোও সম্ভব হবেনা।

কাপড় বিক্রেতা আমিনুর, রফিক, করিম, উজ্জল সহ অনেকেই জানান, করটিয়া হাটে পানি উঠায় বিকিকিনি হচ্ছেনা। ঐতিহ্যবাহী এ হাটে স্বাধীনতার পর চোখে পড়ার মত কোন উন্নয়ন হয়নি। উন্নয়নের দাবিও জানান তারা।

হাটের ইজারাদারের স্থানীয় প্রতিনিধি নুরুল আমিন জানান, করোনা ও বন্যার কারণে তিন মাস যাবত হাটে কোন মহাজন আসতে না পাড়ায় খাজনা আদায় করা যাচ্ছেনা।

টাঙ্গাইল সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও করটিয়া হাট পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আনছারী বলেন, করটিয়া হাটের চারপাশের রাস্তাগুলোয় পানি উঠেছে। হাটটি নদী ঘেঁষা হওয়ায় রাস্তাঘাটের উন্নয়ন এবং নদীর ঘাটটি পাঁকাকরণ করা জরুরি।

টাঙ্গাইল সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সায়েদুল ইসলাম বলেন, করটিয়া হাটের এ সঙ্কটের বিষয়ে তিনি অবগত নন। তবে করটিয়া হাট উন্নয়নে স্থানীয় প্রশাসনের পরিকল্পনা রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

(আরকেপি/এসপি/আগস্ট ০৬, ২০২০)