আবীর আহাদ


রাজনৈতিক ক্ষমতা ও আর্থিক লাভালাভের স্বার্থে অর্থ, আত্মীয়তা ও দলীয় বিবেচনায় স্বাধীনতাবিরোধী বিএনপি-জামায়াত-হেজাজত, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকার ও তাদের সন্তানদের আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে দলটিকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে দাঁড় করানো হয়েছে । আর সবচেয়ে যে শঙ্কাটি বিরাজ করছে, তাহলো, রাজাকারদের সন্তানেরা আওয়ামী লীগে অবস্থান নিয়ে সবার আগে তারা মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারকে নিশানা করেছে । মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকাদের হত্যা করেছিলো, পরাজিত করেছিলো । সেটিকে মাথায় রেখে রাজাকারদের সন্তানেরা তাদের বাবা-দাদাদের হত্যা ও পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে । ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে । অনেকের বাড়িঘর দখল করেছে । তাদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে । প্রায় প্রতিদিনই সারা দেশে এভাবে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের ওপর নানাবিধ অত্যাচার ও নিপীড়ন চলছে ।

এখানেই শেষ নয় । মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়া রাঘব বোয়ালরা দলের প্রভাবশালী অবস্থানেই শুধু নয়, রাষ্ট্র পরিচালনায় তথা এমপি মন্ত্রী ও উপদেষ্টা পদেও তারা আজ আসীন হয়েছে ! আরো আছে অপদার্থ ও ভোদাই টাইপের কিছু এমপি-মন্ত্রী ! এরা যে কী যোগ্যতায় এসব অবস্থানে আসন লাভ করেছেন তা দেশের কেউ জানেন না । এর পাশাপাশি দলের জন্য অতীতে যারা অবদান রেখেছেন, মুক্তিযোদ্ধা, সৎ, ত্যাগী ও মেধাবী মানুষগুলো ঐসব দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের কনুইয়ের ধাক্কায় কোথায় হারিয়ে গেছে, সেসবেরও কোনো খোঁজখবর কেউ রাখে না ।

অপরদিকে দেশের স্বাধীনতা আনায়নকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা, যারা আদর্শিকভাবে আওয়ামী লীগের প্রতি অনুরক্ত, তাদের প্রতি আওয়ামী লীগের নেতা-এমপি-মন্ত্রীরা, এমনকি হাইকমান্ডও কেনো ও কী কারণে তাদেরকে অবজ্ঞা ও অবহেলার দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছে । মনে হয় আওয়ামী লীগও আজ মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা দেখে হিংসায় জ্বলে মরছে । তাইতো মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাইয়ের নামে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন উপজেলা ও জেলা পর্যায়সহ উচ্চতর পর্যায়ের অমুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাই ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা সেজে গেছেন । অতীতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেও এভাবেই হাজার হাজার রাজাকার-আলবদররা মুক্তিযোদ্ধা বনে গিয়েছিলো ! এভাবে অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দিয়ে প্রকারান্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন করা হয়েছে ।

মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী আওয়ামী লীগের এসব অবস্থার দায় ও দায়িত্ব অবশ্যই আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের ওপর বর্তায় । কিন্তু সবকিছু দেখেশুনেবুঝে মনে হচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব একটি ধারাবাহিক ভ্রান্তিবিলাসের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে-----যেখান থেকে সে উঠে আসার নৈতিক শক্তি হারিয়ে ফেলেছে ।

অনেকে যুক্তি দেখান, সৎ ত্যাগী ও মেধাবীদের দিয়ে নাকি দল ও রাষ্ট্র চলে না ! একথা তারা কোন নিক্তিতে মেপে বলেন তা আমরা বুঝি না । নিকট অতীত থেকে অদ্যাবধি কি দল ও দেশ পরিচালনা করার কাজে ঐ সৎ ত্যাগী ও মেধাবীদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে ? হয়নি বললেই চলে । তাহলে দলে ও সরকারে দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের প্রাধান্য দিয়ে ঐসব আন্দাজি কথা বলে প্রকৃতপক্ষে কীসের পক্ষে সাফাই গাওয়া হয় তা বুঝতে কারো বাকি থাকে না ।

মূলত: রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ঐসব দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের যোগসাজসে ভাগাভাগি করে লুটপাট করাই হলো লক্ষ্য । এই ভাগাভাগির লুটপাটের হোলিখেলায় দেশের মধ্যে তরতরিয়ে তথাকথিত ধনিক শ্রেণীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে----দেশের সব সম্পদ মুষ্টিমেয় লুটেরাদের হাতে চলে যাচ্ছে । সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে চরমতম বৈষম্য ও আর্থসামাজিক অরাজকতা, যার প্রভাবে সামাজিক সম্প্রীতি, নৈতিকতা, আদর্শ ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে ।

সবকিছু পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, যে-দলটির সাথে দেশের সব দেশপ্রেমিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষের আবেগ-অনুভূতি, আশা-আকাঙ্খা জড়িত, জড়িত দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন ----সে-দলটি আজ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দিকটি হারিয়ে ক্রমান্বয়ে অজানা এক অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে ! ঠিক এ-অবস্থায় দলটির কাঁধে চড়ে বসেছে আরেক অন্ধকারের অপশক্তি, যার রাজনৈতিক দর্শন হচ্ছে দেশকে ধর্মীয় কূপমণ্ডকতার জালে আটকে দেশের বুকে একটি ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে স্বাধীনতাকে হরণ করা । আর সেই অপশক্তিটি হচ্ছে হেফাজতে ইসলাম । তারা সরকারের ঘাড়ে চড়ে দেশের সর্বত্র ধর্মান্ধতা ছড়িয়ে দেয়ার মতলব নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে ।

অপরদিকে ইসলাম ধর্মের সোল এজেন্সি নিয়ে তারা কে কাফের, কে মুরতাদ, কে মুসলিম, কে মুসলিম নয়----কে আস্তিক, কে নাস্তিক ইত্যাদি বিষয়ে ফতোয়া দিয়ে ধর্মের নামে দেশের বুকে হানাহানি ও হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করে চলেছে । তাদের মতলব না-বুঝে সরকারও তাদেরকে মাথায় তুলে নিচ্ছে । যেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাজাত শিক্ষা ও সংস্কৃতি দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার কথা, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ধর্মীয় অপচেতনাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে । দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে তথা ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে যেখানে সাধারণ্যের মনোজগতকে বিকশিত করার লক্ষ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাভিত্তিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন, সেখানে সরবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে ইসলাম ধর্মের আবরণে ধর্মান্ধ, রাজাকারি ও জঙ্গিবাদী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান----যার মূল লক্ষ্য বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাকে নস্যাত্ করা । এ-বিষয়টি যদি আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন, তাহলে আমাদের সান্ত্বনার জায়গাটা আর অবশিষ্ট থাকে না । আর এ-অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলা চরম দিকভ্রান্তি বৈ কিছু নয় । এবং এটাই হচ্ছে আওয়ামী লীগের ভ্রান্তিবিলাসী রাজনৈতিক পদক্ষেপের ফলশ্রুতি ।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।