রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : বার বার অপরাধ। তিনবার বহিস্কার । তা সত্ত্বেও সন্ত্রাস  চাঁদাবাজি  ও দখলদারিত্ব  কিছুতেই থামছে না সাতক্ষীরা জেলা যুবলীগের তৃতীয়বার বহিস্কৃত আহবায়ক আব্দুল মান্নানের। এরই মধ্যে সদর উপজেলার বাঁকাল জেলেপাড়ায় হিন্দুদের বাড়িতে হামলা ও দেশ থেকে হিন্দু বিতাড়নের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে। বাঁকালের নিরঞ্জন মাখালের দায়ের করা মামলায় পুলিশ তাকে খুঁজছে। এ ঘটনায় কেন্দ্রিয় যুবলীগ মান্নানকে জেলা যুবলীগের আহবায়ক পদ থেকে  ফের বহিস্কার করেছে। এর পর থেকে মান্নান পলাতক। 

আব্দুল মান্নান ছিনতাইকারী থেকে একজন কোটিপতি। এখন গাড়ি ও আলিশান বাড়ির মালিক। সন্ত্রাস জগতের অন্যতম চাঁই হিসাবে নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন মান্নান। জেলার বিভিন্ন স্থানে জমি দখল, ঘের দখল, বাড়ি দখল, খুন খারাবি , চোরাচালান মারামারি কোনো কিছুতেই পিছিয়ে নেই আব্দুল মান্নান।

শহরের অদুরে কাশেমপুর গ্রামের এই আব্দুল মান্নান ১৯৯২ সালে জেল থেকে জামিনে বাড়ি ফিরে আসা এক ব্যক্তির(ডাক্তার) দুই হাতের কবজি দায়ের কোপে কেটে ফেলেছিলেন। সেই থেকে তার নাম ‘হাতকাটা মান্নান’। সেই হাতকাটা মান্নান রাজনৈতিক ক্ষমতা বলে কখনও সাতক্ষীরা জেলা যুবলীগের সভাপতি অথবা আহবায়ক। তার রয়েছে বিশাল বাহিনী। এই বাহিনী যখন ইচ্ছা তখন যে কোনো নেতার হয়ে কাজ করে থাকেন।

২০১৮ সালের ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সাতক্ষীরা পৌর আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভা চলাকালে সাতক্ষীরা সদর আসনের সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতিতে আব্দুল মান্নান তার বাহিনী নিয়ে হামলা করেন । এতে যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতাসহ অন্ততঃ কুড়িজন আহত হন। এ ঘটনায় গ্রেফতার হন আব্দুল মান্নান। এর পর থেকে আব্দুল মান্নান ফের আলোচনায় উঠে আসেন।

বিভিন্ন সময়ে তার বিরুদ্ধে আসা লিখিত অলিখিত অভিযোগ, মামলা, পত্রিকার রিপোর্ট ও প্রেস কনফারেন্স থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেন আব্দুল মান্নান।

১৯৯২ সালে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কাশেমপুর গ্রামের মন্তাজ সরদারের ছেলে আবুল হাসান ওরফে ডাক্তার হাসান একটি মামলায় জেলে যান। জেল থেকে জামিনে আসার পর আব্দুল মান্নান ভোরে সেহরি খাবার সময় তাকে ঘর থেকে ডেকে বের করে এনে দুই হাত কাঠের ওপর রেখে ধারালো দা দিয়ে কুপিয়ে দুই কবজি কেটে নেন। দুই কবজি হারানো ডাক্তার এখন বিভিন্ন স্থানে ভিক্ষাবৃত্তি করেন।

এ ঘটনায় মান্নানের দশ বছর জেল হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয় মান্নানের ভাই আব্দুল হান্নান, জাহিদ, রবিউল ইসলাম, আব্দুস সালাম ও কুচপুকরের নজরুল ইসলামের। এ ছাড়া কয়েক বছর আগে সিটি কলেজের পার্শ্ববর্তী একটি ডোবা থেকে আব্দুল মান্নানের বাড়ির গৃহপরিচারিকার লাশ পাওয়া যায়। এ মৃত্যু নিয়ে অপমৃত্যু মামলা হলেও রয়েছে নানা গুঞ্জন।

সাতক্ষীরা সিটি কলেজ থেকে বিএ পাস করার পর ২০০৭ সালে আবদুল মান্নান যুবলীগে যোগ দেন। কিছুদিনের মাথায় তিনি হয়ে ওঠেন জেলা যুবলীগের নেতা। সে সময় তার সন্ত্রাসের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। আব্দুল মান্নান সদর উপজেলার আবাদেরহাটের গোপাল ঘোষাল পরিবারের জমি দখল করে নেন। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়।

বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও স্থানীয় পত্রিকায় এ বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশের পর আব্দুল মান্নান যুবলীগ থেকে বহিস্কার হন।
আব্দুল মান্নান একজন চোরাচালানি। তার বেনামে রয়েছে সীমান্তে ভারতীয় গরুর খাটাল । এসব খাটাল থেকে তিনি নিয়মিত বখরা আদায় করে থাকেন। ঘোনার গরুর খাটাল দখল করতে মান্নান তার বাহিনী নিয়ে সেখানে হামলা করেন কিছুদিন আগে। বর্তমানে এসব খাটাল বন্ধ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে সোনা চোরাচালানেরও অভিযোগ রয়েছে।তার বিরুদ্ধে রয়েছে চোরাচালানের মালামাল ছিনতাইয়ের অভিযোগ।

২০১২ সালে সাতক্ষীরা সিটি কলেজে প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে পুলিশের সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হন আবদুল মান্নান। এ সময় তিনি গনপিটুনির শিকার হন। পরে পুলিশ তাকে সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগে গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনতাই চেষ্টার।

২০১০ /২০১১ সালে আবদুল মান্নান হাতে রাম দা নিয়ে সাতক্ষীরা বাসটার্মিনালে হামলা চালিয়ে ভাড়াটে সন্ত্রাসীর কাজ করেন । তার এই হামলার কারণে সাতক্ষীরা বাস মালিক সমিতিতে পরিবর্তন আসে। সাতক্ষীরা বাস টার্মিনাল এখন তার নিয়ন্ত্রনে। এখানকার সন্ত্রাস চাঁদাবাজি চোরাচালান ও মানুষ পাচারের সাথে জড়িত রয়েছেন মান্নান।

দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী আবদুল মান্নান সাতক্ষীরা সিটির কলেজের পাশে জমি কেনেন । তিনি তার জমি পেছনে রেখে সামনে থাকা জমির এক ভূয়া মালিক সাজিয়ে প্রতিবন্ধী দিন মজুর ফয়জুর রহমানের জমি দখল করে নেন। সেখানেই তিনি গড়ে তুলেছেন এক আলিশান বাড়ি। এ নিয়ে প্রতিবন্ধী ফয়জুর রহমান সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জানান তিনি মামলা করেও জমি দখল নিতে পারছেন না। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষন করেন।

দীর্ঘদিন বহিস্কৃত থাকার পর ফের রাজনৈতিক তদবিরে আবদুল মান্নান জেলা যুবলীগের ৩১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির আহবায়ক হন ২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর। তিন মাসের মধ্যে পূর্নাঙ্গ কমিটি গঠনের নির্দেশনা থাকলেও তা না করায় যুবলীগের নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভ বাড়তে তাকে। তারা এই কমিটি বাতিল ও মান্নানের বহিস্কার দাবি করে শহরে মিছিল করেন । সংবাদ সম্মেলনও করেন।

কিছুদিন আগে ভুয়া মালিক সাজিয়ে সাতক্ষীরা শহরতলির রসুলপুরে আফরোজা বেগম ও তার স্বজনদের ৩০ শতক ও ৭৬ শতক জমি দখল করে নেন আব্দুল মান্নান। তিনি সেখানে যুবলীগের সাইনবোর্ড তুলে দেন। এ নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় সচিত্র রিপোর্ট প্রকাশিত হয় । একই সাথে তার সহযোগী জনৈক সাগর হোসেনও ওই জমি দখল করে নিয়েছেন। আতংকিত আফরোজা পরিবার জানায় আব্দুল মান্নান জমির ভাগ বাটোয়ারার বিষয়টি সমাধান করার জন্য তার কাছে তাদের যেতে বলেন । তারা গেলে তিনি বলেন তার নামে কিছু জমি লিখে দিতে হবে । এতে অসম্মতি প্রকাশ করায় মান্নান তার সাগরেদ সাগর ও তার বাহিনী নিয়ে দখল করে নেন ওই জমি। আবদুল মান্নান দৈনিক যুগান্তরের সাবেক সম্পাদক আবেদ খানের জমিও দখল করার চেষ্টা করেন । তবে এতে তিনি ব্যর্থ হন। এ সময় তিনি ফের যুবলীগ থেকে বহিস্কৃত হন।

২০১৬ সালের আগে ইউনিয়ন পরিষদ উপ নির্বাচনে মান্নানের ভাই আব্দুল হান্নান চেয়ারম্যান প্রার্থী হন। এ সময় দুই সহোদর মান্নান ও হান্নান তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলে বাধার সৃষ্টি করেন । পরে সেখান কার চেয়ারম্যান প্রার্থী আগরদাঁড়ি ইউপি সদস্য আবদুল মান্নান নিজে মনোনয়ন দাখিলে ব্যর্থ হয়ে একজন মহিলা মেম্বরকে পাঠান । যুবলীগের মান্নান ও তার ভাই হান্নান তার কাছ থেকে ক্গাজপত্র কেড়ে নেন।

পরে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে পুলিশ প্রহরায় চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ইউপি সদস্য আবদুল মান্নান তার মনোনয়নপত্র জমা দেন। মান্নানের ভাই হান্নানের বিরুদ্ধে ব্যাংক ডাকাতির মামলা ছিল। জেলার ঘের মালিকদের অনেকেই এখনও আতংকে ভোগেন । তাদের আশংকা কখন মান্নান তার বাহিনী নিয়ে হামলা করে ঘের জমি দখল করে নেবেন। কারণ যেকোনো দখলবাজিতে মান্নান একজন ওস্তাদ। সাতক্ষীরা সীমান্তে যে কয়টি গরুর খাটাল ছিল তার পরিচালকরাও একই আতংকে রয়েছেন।

আবদুল মান্নান এখন পুলিশের তাড়া খেয়ে পালিয়ে থাকায় এসব বিষয়ে তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে গত ৫ আগস্ট তার সাথে কথা হয় সাংবাদিকদেও । তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে যা বলা হচ্ছে তা সত্য নয়। আগে তার সাথে প্রায়ই এ বিষয়ে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন খাটালে আমার টাকা আছে। তাই সেখানকার আয়ের ভাগ তো আমি পাবোই।

আমি কারও জমি দখল করিনি, মালিকের কাছ থেকেই জমি কিনেছি। এসব বিষয়ে আমি পাল্টা প্রেস কনফারেন্স করে আমার বক্তব্য দিয়েছি। ঘের জমি দখল সন্ত্রাস সৃষ্টি যাই বলুন এগুলি আমি করিনা । আমি সাংবাদিক আবেদ খানের জমি দখল করতে যাবো কেনো। আমি ছিনতাইকারী ছিলাম না কখনও। বাঁকালে জেলেপাড়ার হিন্দুদেও বাড়িতে হামলার সাথে তিনি জড়িত নন বলে দাবি তার। তিনি বলেন সাতক্ষীরায় তার একটি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ রয়েছে । তারাই তার বিরুদ্ধে এসব অপপ্রচার দিয়ে আসছে।

সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদুজ্জামান বলেন মান্নানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

(আরকে/এসপি/আগস্ট ০৯, ২০২০)