নিউজ ডেস্ক : 'যতদিন রবে পদ্মা-মেঘনা-গৌরী-যমুনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান'- ১৫ আগস্ট ২০২০ইং স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৫তম শাহাদত বার্ষিকী। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী সদস্যদের হাতে সপরিবারে (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ব্যতীত) ধানমন্ডি ৩২-এর বাসভবনে নিহত হন।১৯২০ সালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জম্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।তার দীর্ঘদিনের সংগ্রাম, নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের পথ ধরেই বাঙালি তাদের নিজ আবাসভূমি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।তার নেতৃত্বেই বাঙালি জাতি অনুপ্রাণিত ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ তথা পাকিস্তানি আধিপত্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করেছে আমাদের স্বদেশভূমিকে।পরাধীনতার জিঞ্জির ছিঁড়ে এই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাকামী বাঙালী অর্জন করেছিল বাঙ্গালি জাতির মহামূল্যবান স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল ইংরেজ আমলে ছাত্র থাকা অবস্থায়।

শেখ মুজিবের ছাত্র রাজনীতির সূচনা:
অল্পবয়স থেকেই শেখ মুজিবের রাজনৈতিক প্রতিভার প্রকাশ ঘটতে থাকে। ১৯৪০ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন ‘নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। কট্টরপন্থী এই সংগঠন ছেড়ে ১৯৪৩ সালে যোগ দেন উদারপন্থী ও প্রগতিশীল সংগঠন বেঙ্গল মুসলিম লীগে। শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের(অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের শাখা) কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এখানেই সান্নিধ্যে আসেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। ১৯৪৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কুখ্যাত ক্যালকাটা কিলিং(সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা) শুরু হলে শেখ মুজিবুর রহমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং শান্তি বজায় রাখার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন, নিজের জীবন বাজি রেখে হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নিরীহ মানুষদের জীবন রক্ষা করেন।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যায় অবিচার, শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। ধীরে ধীরে তিনি এবং পূর্ব-পাকিস্তান একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন। দীর্ঘ এই ২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রামে বহুবার কারাগারে গিয়েছেন। সংগঠক, নেতা, আন্দোলন-সংগ্রাম, কারাবরণ, আত্মত্যাগে তিনি ধীরে ধীরে বাংলার মানুষের মনে মহানায়ক হিসাবে স্থান করে নেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের সূচনা লগ্ন থেকেই আমরা সংগঠক, নেতা, সংগ্রামী মুজিবকে দেখতে পাই।

শেখ মুজিব ও পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ:
১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার ১৫০, মোগলটুলিতে এক যুব সম্মেলনের আয়োজন করে এবং পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ নামে নতুন সংগঠন গড়ে যুবনেতা শেখ মুজিব সম্মেলনে প্রস্তাব করেন যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা অধিকাংশ জনগণের মতামতের ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে।

শেখ মুজিব ও ছাত্রলীগ:
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের অ্যাসেম্বলি হলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এর নাম ছিল পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়কের ভূমিকা পালন করেন নাঈমউদ্দিন আহমেদ এবং পরবর্তীতে সাংগঠনিকভাবে এর সভাপতি মনোনীত হন দবিরুল ইসলাম। ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন খালেক নেওয়াজ খান।

শেখ মুজিব ও ভাষা আন্দোলন(১৯৪৮):
শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ৪ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রথম বিরোধীদলীয় ছাত্র সংগঠন পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের গণপরিষদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে অবশ্যই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে মেনে নিতে হবে।' শেখ মুজিবুর রহমান এই ঘোষণার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ জানান। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য মুসলিম লীগের চক্রান্তের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য কর্মতৎপরতা শুরু করেন। ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ধর্মঘট পালনকালে সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভরত অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান কয়েকজন সহকর্মীসহ গ্রেফতার হন। শেখ মুজিবের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ছাত্র সমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষুব্ধ ছাত্র সমাজের অব্যাহত আন্দোলনের মুখে ১৫ মার্চ মুসলিম লীগ সরকার শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য ছাত্রনেতাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা ও শেখ মুজিব:
২৩ জুন ১৯৪৯, পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ(বর্তমান আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠিত হয়। মওলানা আব্দুল হামীদ খান ভাসানী সভাপতি হন,সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শামসুল হক এবং কারাগারের বন্দী থাকা অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে শেখ মুজিব পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হন।

শেখ মুজিব ও ভাষা আন্দোলন(১৯৫২):
২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা দেন, 'একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।' জেলে বন্দী অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে নিজেকে জড়িত রেখেছিলেন এবং আন্দোলনকে সফল করার জন্য জেল থেকেই পাঠাতেন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা। ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শেখ মুজিবুর রহমান জেলের ভেতরেই টানা ১১ দিন ধরে আমরণ অনশন চালিয়ে যান এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তি পান। ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ধর্মঘট আহ্‌বান করে। আন্দোলনরত ছাত্র জনতা ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল নিয়ে অগ্রসর হলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রফিক,সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউর সহ আরো অনেকেই। জেল থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমান শহীদদের প্রতি গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানান। একই বছর শেখ মুজিবুর রহমান শান্তি সম্মেলন উপলক্ষে চীন সফর করেন। শান্তি সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় বক্তৃতা দেন, ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে যান বৈশ্বিক অঙ্গনে।

শেখ মুজিব ও যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন(১৯৫৪):
১০ মার্চ ১৯৫৪ পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তফ্রন্ট ২৩৭ টি আসনের মধ্যে ২২৩ টি আসনে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ একাই ১৪৩ টি আসনে জয়ী হয়। শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ আসন থেকে নির্বাচিত হন এবং ১৫ মে নতুন প্রাদেশিক সরকারের বন ও কৃষি মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ২৯ মে ভারত স্বাধীনতা আইন-১৯৪৭, প্রয়োগ করে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার হঠাৎ করে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়।

শেখ মুজিব ও আওয়ামীলীগ(১৯৫৫):
সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সব ধর্মের মানুষের অন্তর্ভুক্তি এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি প্রত্যাহার করে নাম রাখা হয় 'আওয়ামী লীগ'। ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ৬ সেপ্টেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান পুনরায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ(১৯৫৭):
১৯৫৬ সালে খান আতাউর রহমানের নেতৃত্বে প্রাদেশিক সরকারে শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। মাত্র নয় মাস তিনি মন্ত্রী পদের দায়িত্বে ছিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বাঙালির অধিকার আদায় আন্দোলনকে বেগবান করা এবং সংগঠনকে আরো সুসংহত করার উদ্দেশ্যে ১৯৫৭ সালের ৩০ মে শেখ মুজিবুর রহমান স্বেচ্ছায় মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন।

শেখ মুজিব ও স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ গঠন:
১৯৬১ সালে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য উদ্যমী ছাত্র নেতৃবৃন্দদের নিয়ে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

শেখ মুজিব ও ছয় দফা(১৯৬৬):
শেখ মুজিবুর রহমান ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। প্রস্তাবিত ছয় দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। এই ছয় দফা মুক্তিকামী বাঙালি জাতির জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির বীজ বুনে দেয়, পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়ায় আঘাত করে।

ছয় দফা:



১. ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিক্তিতে পাকিস্তান হবে যুক্তরাষ্ট্র এবং সরকার হবে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির। প্রাপ্তবয়স্কদের সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিক্তিতে নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন সভাগুলো হবে সার্বভৌম।
২. কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে দেশ রক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি এবং অবশিষ্ট ক্ষমতা থাকবে প্রদেশের হাতে।
৩. দেশের দুই অঞ্চলের জন্য সহজে বিনিময় যোগ্য মুদ্রা থাকবে এবং লেনদেনের হিসাব রাখার জন্য দু'অঞ্চলে দুটি স্বতন্ত্র ব্যাংক থাকবে।মুদ্রা ও ব্যাংক পরিচালনা করার ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। অথবা দু'অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকবে,তবে এক অঞ্চলের মুদ্রা অন্য অঞ্চলে যেন পাচার হতে না পারে সেজন্য পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে এবং দু'অঞ্চলের জন্য দু'টি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।
৪. সকল প্রকার কর ধার্য ও আদায় করার ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে এবং আদায়কৃত অর্থের একটি অংশ ফেডারেল ব্যাংকে জমা দিবে।
৫. বৈদেশিক বাণিজ্য ও মুদ্রার ক্ষেত্রে প্রদেশগুলোর হাতে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে।
৬. আঞ্চলিক সংহতি ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে প্রদেশগুলো নিজস্ব কর্তৃত্বাধীনে আধাসামরিক বাহিনী বা অঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও পরিচালনা করার ক্ষমতা দেওয়া হবে।।

ছয় দফা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়,ছয় দফা কার্যকর হলে পূর্বপাকিস্তান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাররিক দিকে শোষণ,অবহেলার হাত রেখে মুক্তি পেয়ে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করতো। লাহোরে ছয় দফা উত্থাপিত হবার পরদিনই পাকিস্তানিদের পত্রপত্রিকায়য় শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে আখ্যা দেওয়া হয়।প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ছয় দফাকে 'হিন্দু আধিপত্যাধীন যুক্তবাংলা গঠনের যড়যন্ত্র' বলে আখ্যা দেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৬) করাচিতে পূর্ব পাকিস্তানের আইন ও সংসদীয় মন্ত্রী আব্দুল হাই চৌধুরি ছয় দফাকে 'রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা' বলে আখ্যা দেন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মুসলিম লীগ ৬ দফাকে 'পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার দাবী'হিসেবে চিহ্নিতত করেন।ধর্মভিক্তিক দল জামায়াত-ই-ইসলামী,নেজাম-ই-ইসলামী ছয় দফা প্রত্যাখ্যান করেন।পিপিপি সভাপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো ছয় দফাকে 'দেশ বিভাগের ফর্মুলা' হিসাবে আখ্যা দেন। মওলানা ভাসানী ছয় দফাকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবে বর্ণনা করে একে অর্থনৈতিকভাবে অসম্পূর্ণ বলে প্রত্যাখ্যান করেন।

শেখ মুজিব ছয় দফাকে 'আমাদের বাঁচার দাবি' বলে আখ্যা দেন এবং দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু করেন। ১ মার্চ ১৯৬৬, শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ছয় দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি সারা বাংলায় গণসংযোগ সফর শুরু করেন। এ সময় তাঁকে আটবার গ্রেফতার করা হয় এবং সর্বশেষ ৮ মে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিব সহ আরো ৩৪ জনের নামে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা'দায়ের করা হয়। প্রায় তিন বছর শেখ মুজিবুর রহমান কারারুদ্ধ ছিলেন।

শেখ মুজিব ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা:
১৯৬৮ সালের প্রথমদিকে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিব এবং আরও ৩৪ জন বাঙালি সামরিক ও সিএসপি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে যা ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে সুপরিচিত। মামলায় উল্লেখ করা হয়েছিল শেখ মুজিবসহ এই কর্মকর্তারা ভারতের ত্রিপুরা অঙ্গরাজ্যের অন্তর্গত আগরতলা শহরে ভারত সরকারের সাথে এক বৈঠকে পাকিস্তানকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা তৈরি করেছে। এতে শেখ মুজিবকে এক নম্বর আসামী করা হয়।

শেখ মুজিব ও ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান :
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র গণআন্দোলন শুরু হয়। টানা গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুব সরকার ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সকল বন্দীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২৩ শে ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল ছাত্র সমাবেশে লাখো শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আওয়ামী লীগের এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের নাম রাখেন ‘বাংলাদেশ’।

তিনি বলেন, 'একসময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোন কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি- আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র বাংলাদেশ'। ‌

বঙ্গবন্ধু ও ১৯৭০ সালের নির্বাচন:
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফার আলোকে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বা‌ন জানান। আওয়ামী লীগের জন্য তিনি নৌকা প্রতীক বেছে নেন। ১২ নভেম্বর এক প্রলয়ংকরী ঘুর্ণিঝড়ে উপকূল এলাকায় লাখো মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচারণা স্থগিত রেখে ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত অঞ্চলে ছুটে যান। ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়ী হয়। জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তান অংশে ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি আসনে এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৯৮ টি আসনে(সংরক্ষিত ১০টি নারী আসনসহ) আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে।

অধিবেশন নিয়ে ইয়াহিয়ার টালবাহানা(১৯৭১):
১ মার্চ, ১৯৭১ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরুর মাত্র দুই দিন আগে অনির্দিষ্টকালের জন্য এই অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার ফলে সর্বস্তরের বাঙালি জনতা রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নতুন মোড় নেয়। ১ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধু কার্যত ছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধান। একদিকে রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়ার নির্দেশ যেত, অপর দিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে যেত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ। বাংলার মানুষ মেনে চলতেন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ।

বঙ্গবন্ধু ও ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ(১৯৭১):
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশবাসীকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের আহবান জানান।

বঙ্গবন্ধু ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আলোচনা পর্ব :
১৬ মার্চ ১৯৭১ সালে বিস্ফোরণমুখ বাংলাদেশে আসেন ইয়াহিয়া খান। বঙ্গবন্ধুর সংগে তার দীর্ঘ আলোচনা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু তার গাড়ীতে কালো পতাকা উড়িয়ে হেয়ার রোডে প্রেসিডেন্ট ভবনে আলোচনার জন্য যান। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫১তম জন্মদিন। এই দিন ইয়াহিয়া খানের সংগে দ্বিতীয় দফা আলোচনা থেকে ফিরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলে এদেশে জন্ম দিনই বা কি আর মৃত্যু দিনই বা কি আমার জনগনই আমার জীবন।

কালো রাত্রি(২৫ মার্চ, ১৯৭১):
পৃথিবীর ইতিহাসে এক নৃশংসতম কালো রাত্রি ২৫ মার্চ। এদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে মানুষের ঢল নামে। সন্ধ্যায় খবর পাওয়া যায় ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেছেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সাথে বৈঠক করেন। তার সাড়ে এগারটায় শুরু হয় অপারেশন সার্চ লাইট। ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা।

বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার(২৬ মার্চ ১৯৭১):
রাত ১২-৩০ মিনিট ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হবার আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাবার্তা ওয়ারলেস যোগে চট্টগ্রামের জহুরুল আহমেদ চৌধুরীকে প্রেরণ করেন। চট্টগ্রাম বেতার থেকে আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বানী স্বকন্ঠে প্রচার করেন। পরে ২৭ মার্চ চট্টগ্রামে অবস্থিত অষ্টম ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান ঐ ঘোষণা পাঠ করেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে করাচীতে নিয়ে যাওয়া হয়।

অস্থায়ী সরকার গঠন ও মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১):
১৭ এপ্রিল ১৯৭১, তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার ভবের পাড়ার (বৈদ্যনাথ তলা) আমবাগানে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে নতুন মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মদ ঘোষণা করেন আজ থেকে (১৭ এপ্রিল) বৈদ্যনাথ তলার নাম মুজিব নগর এবং অস্থায়ী রাজধানী মুজিব নগর থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করা হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং তার অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়।দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বরে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান এবং অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাঙালী জাতি অর্জন করে তাদের হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন প্রিয় স্বাধীনতা। বিশ্বের মানচিত্রে স্থাপন করে সার্বভৌম বাংলাদেশ, নিজস্ব লাল-সবুজ পতাকায় আচ্ছাদিত হয় বাঙালীর হৃদয়।

পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু (১৯৭২):
শেখ মুজিবকে পাকিস্তানি কারাগার হতে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি লন্ডন ও ভারত হয়ে বিজয়ীর বেশে স্বদেশ প্রর্ত্যাবর্তন করেন এবং বাংলাদেশর স্বাধীনতা পূর্ণতা পায়।।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই ভাষা, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্র পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যায় অবিচার শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রহ করেছেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তান আলমের দীর্ঘ ২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন এবং দীর্ঘ এ লড়াইয়ের ফসল হিসাবে ১৯৭১ সালে জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশের।

লেখক
নুরুজ্জামান শুভ
শিক্ষর্থী: ইতিহাস বিভাগ (শিক্ষাবর্ষঃ ২০১৫-১৬)
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

(পিএস/১৫ আগস্ট, ২০২০ ইং)