আবীর আহাদ


২০০৪ সালের ২১ আগস্ট উপর্যুপরি ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা করে জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ গোটা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে ধ্বংস করতে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার প্রচ্ছন্ন নীলনক্সার বাস্তবায়ন ঘটাতে এক বিভীষিকাময় হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে । সেই পৈশাচিক হামলায় আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ মানবঢাল রচনা করে কোনোমতে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে পারলেও তিনি তাঁর একটি কানে প্রচন্ড আঘাত পান । কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপর্যুপরি গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে ঝাঝরা হয়েও নেত্রীকে পরম মমতায় নিরাপদ রাখতে পেরেছিলেন । কিন্তু বিশিষ্ট নারীনেত্রী আইভি রহমানসহ চব্বিশ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারান । কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দসহ প্রায় পাঁচশতাধিক নেতাকর্মী মারাত্মক আহত হন । তাদের অনেকেই আজ দুনিয়াযে নেই । আজো যারা বেঁচে আছেন, তারা এখনো তাদের দেহের ভেতর স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা নিয়ে কোনোমতে বেঁচে আছেন । আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধা, আমরা জানি যুদ্ধ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত অন্যতম মারণাস্ত্র গ্রেনেড কী ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করে থাকে ।

পরের দিন । ২২ আগস্ট । সন্ধ্যায় আমরা প্রায় পঁচিশজন মুক্তিযোদ্ধা বিশেষ করে মাহবুবউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম, শাহজাহান কবীর বীরপ্রতীক, প্রয়াত আবু সাঈদ, সদ্যপ্রয়াত এড. হাবিবুর রহমান শওকত ও আমি আবীর আহাদ ধানমন্ডিতে শেখ হাসিনার বাসভবন সুধাসদনে তাঁর সাথে দেখা করতে যাই । শেখ হাসিনা আঘাতজনিত কারণে গুরুতর অসুস্থ । তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও নিরাপত্তাকর্মীদের সাফ জবাব, নেত্রীর সাথে দেখা করা যাবে না, তিনি ডাক্তারের পরামর্শে পূর্ণবিশ্রামে আছেন । বিষয়টি বিবেচনা করে আমরা একে একে যখন সুধাসদন থেকে বের হচ্ছি, তখনি তাঁর বিশেষ সহকারী ড. আওলাদ হোসেন দ্রুত বাইরে এসে আমাদের জানালেন যে, নেত্রী আমাদের ডেকেছেন । আসলে কীভাবে যেনো তিনি জেনেছিলেন যে, মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছেন ।

আমরা সুধাসদনে তাঁর বসার ঘরে প্রবেশ করতেই দেখলাম ছলছল চোখে নেত্রী আমাদের মাঝে এসে দাঁড়ালেন । তিনি আমাদের হাত ইশারায় বসতে বললেন ।

বঙ্গবন্ধুকন্যার মুখাবয়ব দেখে আমরাও কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে উঠি । সবার চোখে জল । আমরা কেউ বসলাম না । তিনিও দাঁড়িয়ে আছেন । কারো মুখে কোনো কথা নেই । একখন্ড নীরবতায় আমরা আচ্ছন্ন । নেত্রী এবার অশ্রুভেজা চোখে আমাদের সবার দিকে একবার তাকালেন । সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় । আমরা একে অপরের দিকে তাকাতে থাকি । তাঁকে কী সান্ত্বনা দেবো । সব নীরবতা ভেঙে আমিই মুখ খুলি : বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে একাত্তরে অস্ত্র ধরেছিলাম, দেশ স্বাধীন হয়েছে । গতকাল যে পৈশাচিক বর্বর ঘটনা ঘটে গেলো, তার প্রেক্ষিতে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছ থেকে একটি নির্দেশ চাচ্ছি !

শেখ হাসিনা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে সবার উদ্দেশে শান্তকন্ঠে বললেন : আপনাদের নির্দেশ দেয়া মানে তো যুদ্ধ----গৃহযুদ্ধ ! আইভি রহমানসহ আমাদের অসংখ্য নেতাকর্মী নিহত-আহত হয়েছেন । আমি ডান কানে কিছুই শুনতে পাই না । হয়তো আমিও নিহত হতে পারতাম । তাই বলে আমি আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন দেশটাকে ধ্বংস করে দিতে পারি না ! আমার বাবা-মা-ভাই ও অন্যান্যরা রক্ত দিয়ে এদেশকে পবিত্র করে গেছেন, সেই দেশকে, কোটি কোটি নিরীহ মানুষের দেশকে যুদ্ধের মধ্যে ঠেলে আমি প্রতিশোধ নিতে পারি না ! প্রয়োজনে এদেশের মানুষের কল্যাণ ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আমিও প্রাণ বিসর্জন দেবো, কিন্তু দেশের বিনিময়ে নয়; প্রতিশোধ নয়, হত্যার বদলে হত্যা নয় !-----আপনারা শান্ত থাকুন ।

গতকাল কালের আবর্তে আমাদের স্মৃতিতে সেই বিভীষিকাময় ২১ আগস্ট ফিরে এসেছে । ২০০৪ সালের সেদিনের সেই ভয়াবহ ঘটনার স্মৃতিবিজড়িত মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে পরের দিনের নেত্রীর সাথে সাক্ষাতের বিষয়টিও মনে পড়ে গেলো । ১৯৭৫ সালের পর থেকে একের পর এক মর্মান্তিক আঘাতের পর আঘাত সয়েও বঙ্গবন্ধুকন্যাই কেবল বলতে পারেন : 'আমি আমার বাবার স্বাধীন দেশকে ধ্বংস করে দিতে পারি না !'

এটাই দেশপ্রেম । একথাটি কেবল শেখ হাসিনাই বলতে পারেন । তিনি যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সন্তান-----

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ।