নিউজ ডেস্ক : করোনা সংকটে গত ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।প্রাথমিক পর্যায়ে সারাদেশে লকডাউন সহ (হাসপাতাল,ব্যাংক ব্যতিত) সকল কিছু কয়েক দফায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তবে ইউরোপ, আমেরিকার দেশগুলোর মতো করোনা মহামারী বাংলাদেশে দেখা যায় নি। বর্তমানে দেশে পর্যটন কেন্দ্র সহ সকল কিছুই খুলে দেওয়া হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যতিত। দীর্ঘ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এমনিতেই নানা কারণে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে সেশনজট লেগে থাকে। দেশের সকল কিছু খুলে দেওয়া হয়েছে, তাই শিক্ষার্থীরাও বিশ্ববিদ্যালয় গুলো খুলে দেওয়ার দাবি তুলেছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার মতো স্বাভাবিক পরিস্থিতি এখনও হয় নি। এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে দেশের সকল কিছু খুলে দিয়ে একবারে স্বাভাবিক পরিবেশ আশা করাটা কতটা যৌক্তিক। দ্রততম সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার দাবি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শেখ খালিদ সাইফুল্লাহ (ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং, ১৬-১৭ সেশন) বলেন, 'যেহেতু সবই খোলা এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা যায়। না হলে মারাত্মক সেশনজট এবং বর্তমান সময়ের হতাশা আরো বেড়ে যাবে।
তবে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে,

১. প্রতিটি ফ্যাকাল্টির গেটে ও আবাসিক হলে ডিসইনফেকশন টানেল বসাতে হবে এবং ফলোআপ করতে হবে।
২. হলে ছাত্রদের নিরাপদে রাখার জন্য গনরুম কে সীমিত করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে গনরুমের শিক্ষার্থীদের কিছু অংশ কে বিশ্ববিদ্যালয় নিজ খরচে বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত এলাকায় থাকার ব্যবস্থা করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় এর মেডিকেল'কে উন্নত করতে পারে।

বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয় খুলুক। এই বয়সে বাড়িতে বসে থাকা আসলেই সম্ভব না আর।'

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আহমাদ গালিব (বাংলা বিভাগ, ২০১৭-১৮ সেশন, ৪৭ ব্যাচ) বলেন, 'শেষমেষ যখন পাবলিক বাসের সামাজিক দূরত্ব ও উঠিয়ে নেয়া হল তখন ঠিক কোন যুক্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকছে? হাজার হাজার লোকের পাবলিক গ্যাদারিং হচ্ছে পর্যটন স্পটগুলোতে যাদের প্রায় সবাই শিক্ষার্থী। এদিকে আমাদের মত মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা পরিবারের বোঝা হয়ে উঠছি। ভ্যাকসিন আসবে আর ১৬ কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দিবে সে তো অনেক দূরের পথ। এমতাবস্থায় আর কত বসে থাকবো। সেশনজটে আগে থেকেই পড়ে আছি, আবার সেশনজট হলো একবছরের। এর কোন উত্তর কেউ দিতে পারবে? বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করুক, আবাসিক হলে প্রোপার স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিক। আশা করি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি আমাদের দাবি'টা আমলে নিয়ে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেবেন।'

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অন্তর মজুমদার অন্তু (মার্কেটিং বিভাগ, ২০১৫-১৬ সেশন) বলেন, করোনায় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে সবথেকে বেশি ৪০/৫০ বছর বয়সের মানুষজন। আর সব থেকে কম ১৮-৩০ বছরের মানুষজন। কিন্তু বয়স্করা সবাই কাজের জন্য বাইরে যাচ্ছে কিন্তু যাদের ঝুঁকি কম তাদের শুধু শুধু আটকে রাখা হচ্ছে।'

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় না খোলার কারণে মানসিক ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে অনেক ছাত্র ছাত্রী। ফলে আত্নহত্যার প্রবণতা বাড়ছে।'

এছাড়াও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী স্ম্রিতা সুলতানা রাত্রি (Political Studies, Sessionঃ 2016-17) বলেন, 'করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও অন্যান্য সবকিছুই খোলা। শিক্ষার্থী জাতির ভবিষ্যৎ এটা যেমন সত্য তেমনি তাদের কে হতাশার মধ্যে ফেলে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করা এটাও সত্য। অনেকেই মেন্টালি খুবই সিক হয়ে পড়ছেন, পারিবারিক অনেক সমস্যা আছে, সব শিক্ষার্থীর আর্থিক অবস্থা ও তেমন ভালো নয়। টিউশন করে নিজে চলা আর পরিবারে কিছু টা যোগান দেয়া শিক্ষার্থীরা হয়তো খুব ভালো বুঝতে পারছেন কেন ক্যাম্পাস খোলা দরকার। অনেক স্টুডেন্টস আছেন, হয়তো মা কিংবা বাবা অথবা উভয়ই নাই। তারা হয়তো কোনো আত্মীয়ের কাছে থাকেন, তাদের জন্য সময়টা খুব কষ্টের বটে।'

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শরিফ ইসলাম (সিএসই, ২০১৭-২০১৮ সেশন) বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় খোলা উচিত, কারণ-

১) যে উদ্দেশে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করা হয়ছিল সেটা বাস্তবায়িত শুরুর দিকে যতোটুকু হয়েছিল এখন তা বিন্দুমাত্রও হচ্ছে না; ফলে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকলে যতটুকু ক্ষতি হবে তার থেকে বেশি ক্ষতি হচ্ছে এখন।
২) বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ফলে অনেকের পড়াশোনা গতি হারিয়ে ফেলছে অলরেডি; অনেকেই হতাশা, অনিশ্চয়তায় ভুগছেন
যারা টিউশনি কোচিং করিয়ে পরিবার আর নিজে চলতো তারা করুণ জীবন যাপন করছে; অনেকে ফেসবুক, পর্নগ্রাফি, মাদকে আসক্ত হচ্ছে। যা জীবনকে আরো মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, এগুলা করোনা থেকেও ভয়ংকর।
৩) বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্দকতা হচ্ছে আবাসিক হল। আবাসিক হলে গাদাগাদি করে না থেকে সিটের কিংবা মেসের নিশ্চয়তা তৈরি করা আইসোলেশন এর ব্যবস্থা করা, কেউ যদি করোনায় আক্রান্ত হয় তবে তার চিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং গেটে থার্মোমিটার ব্যবহার করা,
অনলাইনেও কিছু ক্লাস চালিয়ে যাওয়া।'

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সানজিদা ইসলাম (নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ২০১৬-১৭ সেশন) বলেন, 'দেড় মাস হয়ে গেছে, ঘরেই বসে আছি, পড়াশোনা হচ্ছে না, অনলাইন ক্লাস! তার বাস্তবতা তো সবাই জানে, আমার ডিভাইসের সমস্যা আছে, নেটওয়ার্কের ও তীব্র সমস্যা, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগে তীব্র সেশন জট যা আরো বেড়ে গেছে এখন।

আর শিক্ষাজীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের পারিবারিক বিভিন্ন ইস্যুর সম্মুখীন হতে হয়। ক্যারিয়ারের হতাশা, বিভিন্ন বাস্তবতা থাকে সব মিলিয়ে মানসিক অবস্থা খুব খারাপ। দিন দিন সেশন জট বাড়ছে, অনলাইন ক্লাসে আদতে কোনো লাভ হচ্ছে না, মানসিকভাবে চরম হতাশায় আছি, পড়াশোনা, ক্যারিয়ার কিছুই হচ্ছে না। সারাদিন শুধু অবসাদেই কাটে। ২০১৬'তে এইচএসসি পাশ করে এখন পর্যন্ত মাত্র ২য় বর্ষ শেষ হয়েছে। পারিবারিক প্রেসারও বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজেদের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন, হল গুলোতে এবং ক্লাস রুম গুলোতে এমনইতেই মশার স্প্রে করা হয়, তেমন ভাবে দিনে ২ বার জীবাণুনাশক স্প্রে করলে, শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ জায়গা থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে, মূল ফটকে কয়েকটি জীবানুনাশক ট্যানেলের ব্যবস্থা করলে সেই সাথে অনলাইন ক্লাস চলবে!(শিক্ষার্থী এরা ক্যাম্পাস এবং হলের ওয়াইফাই ব্যবহার করবে) আমার মনে হয় খুব সহজেই ক্লাস করা যাবে। আমরা সবাই মাক্স, সেনিটাইজার ব্যবহার জানি।'

বশেমুরবিপ্রবি এর শিক্ষার্থী সিদরাতুল মুনতাহা (বাংলা বিভাগ; ২০১৭-২০১৮ সেশন) বলেন, 'বাংলাদেশের এমন কোনো জায়গা এখন আর বন্ধ নেই শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া। রাস্তাঘাটে বেড় হলে চোখে পড়ছে কোনো স্বাস্থ্যবিধি কেউ সেমন মেনে চলছে নাহ। সবাই তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য যেন ক্রমশ ধাবিত হচ্ছে। এ চলমানতা দেখার পর কিভাবে শিক্ষার্থীরা বসে থাকতে পারে?

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছেলে-মেয়েরা যথেষ্ট সচেতন তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সক্ষম। তাই বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হোক। এতদিন পড়াশুনা থেকে বিচ্ছিন্নতা সত্যি আমাদের জন্য অশনিসংকেত বয়ে আনছে। আমরা আর ঘরে বসে থাকতে চাই নাহ। এখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হোক। কারণ দেশ থেকে তো করোনা একেবারে নির্মূল করা সম্ভব না, অযথা আমাদের সময় নষ্ট করার মানে হয় না।'

বিভিন্ন পাবলিক, বেসরকারি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে গ্রুপ খুলে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দাবি জানাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা সচেতন, দেশের করোনার যে অবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় গুলো খুলে দেওয়া সময়ের দাবি জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

(এস/পি/আগস্ট ২৩, ২০২০ইং)