নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার


করোনা কালে বদলে গিয়েছে পৃথিবীর চিরচেনা রুপ। কোন দিন ফিরবে পূর্বের রুপে বা কোন দিন চলে যাবে করোনার প্রভাব এ সম্পর্কে কারো সুস্পষ্ট ধারণ নেই। পৃথিবীর সব দেশের জন্য ধাক্কা হলেও আমাদের মতো মধ্যম আয়ের বা এত জনসংখ্যা বহুল দেশের জন্য চরম ধাক্কা। করোনা দিচ্ছে আমাদের বিভিন্ন রকমের শিক্ষা যার জন্য আমাদের কোন পূর্ব প্রস্তুতিই ছিল না। এ থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ। করোনায় যেসব খাত সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পরেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শ্রম বাজার। দেশের লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কাজ না থাকায় বিদায় হয়েছে কর্মক্ষেত্র থেকে। পাশাপাশি ব্যাপকভাবে শ্রমিক নতুন করে শ্রম বাজারে প্রবেশ করার অপেক্ষায় রয়েছে।

শিক্ষার্থীরা ছাত্রজীবনের শেষ সময়ে বা শেষ করে চাকুরির জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। প্রচুর পরিমাণে কর্মক্ষেত্র না থাকায় চাকুরি না পেয়ে হতাশায় বিপদগ্রস্থ হচ্ছে যুব সমাজ। পড়াশুনা শেষ করে খুব একটা সময় পাচ্ছে না চাকুরিতে আবেদন করার মতো। এছাড়া বর্তমান করোনাকালে শিক্ষা ক্ষেত্রে যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তা থেকে পরিত্রাণ পেতে অনেকটা সময় নিতেই হবে একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সরকারি চাকুরিতে বর্তমান প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আবেদনকারীদের বয়স ৩২ বছর রাখা হয়েছে।

যখন দেশের মানুষের গড় আয়ু ৪৫ বছর ছিল তখন চাকুরিতে প্রবেশের বয়স ছিল ২৭ বছর আর গড় আয়ু ৫০ বছর হওয়ার পর তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩০। কিন্তু বর্তমানে দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছর হলেও বাড়েনি চাকুরিতে প্রবেশের বয়সসীমা। যেহেতু গড় আয়ু ৭২এ দাঁড়িয়েছে তাই সার্বিক বিচারে অবসরের বয়স বৃদ্ধি করাও প্রয়োজন। মানুষের কর্মক্ষমতাকে কাজে লাগাতে পারলে দেশের শ্রম বাজার হবে আরো সমৃদ্ধ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চাকুরিতে প্রবেশের এবং অবসরের বয়স একেক রকম। প্রত্যেক দেশের অবস্থা বিবেচনা করে এটা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। উত্তর আমেরিকায় চাকুরিতে বয়সের প্রবেশসীমা রয়েছে ৫৯ বছরে।

এছাড়া আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ বয়সসীমা ৩৫ বছরে রয়েছে। এ বয়সসীমা বৃদ্ধি নিয়ে বেশ কয়েকবার মানববন্ধন স্মারকলিপি প্রদান করেছে চাকুরি প্রত্যাশীরা। এমনকি এখনও এ আন্দোলন সীমিত পরিসরে চলমান রয়েছে। চাকুরির আবেদনের বয়সসীমা কম থাকায় শিক্ষা জীবনের শেষ হবার আগেই শুরু হয়ে যায় চাকুরির পড়াশুনা। যার ফলে একাডেমিক পড়াশুনায় তৈরি হচ্ছে ব্যাপক ঘাটতি। পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান তৈরি হচ্ছে না শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বইয়ের উপর। স্নাতক ২ বছরের কোর্স বৃদ্ধি করে ৩ বছর এবং স্নাতক সম্মান কোর্স এর মেয়াদ ৩ বছর থেকে বাড়িয়ে
করা হয়েছে ৪ বছর। যার ফলে শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটাতে এক বছর বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে।

উপরের স্তরে শিক্ষা এক বছর বৃদ্ধি হলেও আগের নিয়মেই রয়ে গেছে আবেদনের মেয়াদ। ১৬ বছর বয়সে মাধ্যমিক স্তর পরিপূর্ণ করে ১৮ বছর বয়সে শেষ হচ্ছে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর এবং ২২ বছর বয়সে স্নাতক স্তর অতিক্রম করে ২৩ বছরে স্নাতকোত্তর সমাপ্ত হওয়ার কথা থাকলেও শেষ হতে সময় নিচ্ছে আরো অনেক বেশি। নির্দিষ্ট সময়ে পড়াশুনা শেষ হলে চাকুরির জন্য ৭ বছর চেষ্টা করতে পারতো শিক্ষার্থীরা। কিন্তু শিক্ষা স্তরের বিভিন্ন পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে ২৫ থেকে ২৬ বছর চলে যাচ্ছে শিক্ষাজীবন শেষ করতে। তাই নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষার্থীরা যেন শিক্ষা জীবন শেষ করতে পারে সে দিকে সরকারের খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরি। সরকার সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা বৃদ্ধি করার কারণে দিনদিন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

একথা স্বীকার করতে হবে যে সরকার কারিগরি শিক্ষার প্রতি বেশ আন্তরিক। কিন্তু জনবহুল এদেশে কারিগরি শিক্ষার জন্য যে বব্যস্থা এখন পর্যন্ত নেয়া হয়েছে তা অত্যন্ত অপ্রতুল। মানসম্মত কারিগরি শিক্ষা প্রদান করে যুব সমাজকে শ্রমবাজারে ফিরিয়ে আনা সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। ইতোমধ্যে অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধি হওয়ার কারণে উপরের স্তরে পদ খালি না হওয়ায় পদোন্নতিও হচ্ছে কম। যার ফলে নিচের স্তরেও পদ শুন্য না হওয়ায় নিয়োগ পাচ্ছে না নতুন করে। যেহেতু গড় আয়ু বেড়েছে তাই চাকুরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি করলে এবং অবসরের সীমা বৃদ্ধি করলে শ্রম বাজারে সুফল আসবে একথা বলা যায়। যে পরিমান যুবক শিক্ষাগ্রহণ করে বের হচ্ছে সে তুলনায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই তাই পড়াশুনা শেষ করেই কর্মসংস্থানে প্রবেশ করার সুযোগ পাচ্ছে না। যার ফলে বারবার চেষ্টা করতে হচ্ছে চাকুরির জন্য। সেক্ষেত্রে আবেদনের বয়স না থাকায় সুযোগ হারাচ্ছে চাকুরি প্রত্যাশীরা। ফলে তরুনদের নেমে আসছে হতাশা যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক বিশৃংখলা। সরকার যদি এক্ষেত্রে প্রবেশের সময় বৃদ্ধি করে তাহলে যুব সম্প্রদায় আরো কিছুদিন চাকুরির প্রস্তুতি নিলে পাঠ্যাভ্যাসের মধ্যে থাকতে পারবে। প্রবেশের বয়স ৩৫ করা হলে এবং অবসরের বয়স ৬০ কারা হলে একজন চাকুরিজীবি স্বাভাবিকভাবেই চাকুরির কাল ২৫ বছর পূর্ণ করতে পারবে। একটি দেশের উন্নতির প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ তারুণ্যের শক্তি।

এ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশের ভবিষৎত ভীতকে আরো মজবুত করা যেতে পারে। আর এ শক্তিকে কাজে লাগানোর একটি ধাপ হলো চাকুরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি। আরেকটা জিনিষ মনে রাখতে হবে বয়স বৃদ্ধি করা মানেই চাকুরি দেয়া নয়। চাকুরি বাজারে প্রবেশের চেষ্টাকে আরো সময় দেয়া এবং যুবশক্তিকে শ্রমবাজারে অর্ন্তভূক্ত করা। এতে করে সরকারের কোন আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনাও নেই। সার্বিক দিক বিবেচনায় পৃথিবী যে কঠিন সময় পার করছে এ সমস্যা মোকাবেলায় সঠিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সরকারের উচিৎ অন্ততপক্ষে চাকুরিতে প্রবেশের সময়সীমা বৃদ্ধি করা।

লেখক : শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।