শিতাংশু গুহ


ফেরদৌস আহমেদ কুরেশী চলে গেলেন। এই ভদ্রলোকের কাছে আমি ঋণী। দু:সময়ে তিনি আমার পাশে ছিলেন। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু নিহত হলে অনেকের সাথে আমিও কলকাতা যাই, ফিরে আসি আটাত্তরের শুরুতে। ফেরদৌস কুরেশী তখন জনতা পার্টির সেক্রেটারীজেনারেল; এমএজি জেনারেল ওসমানী প্রেসিডেন্ট। অফিস জয়কালী মন্দিরের কাছে। ফেরদৌস ভাই’র বাসা ছিলো পল্টনে, দোতালায়। পান্নাভাবী (সংবাদে দেখলাম ভাবীর পুরো নাম নিলুফার পান্না কুরেশী) ছিলেন চমৎকার মহিলা। ফেরদৌস কুরেশী’র ছোটভাই ইকবাল (পুরো নাম মনে নেই) আমার চেয়ে সামান্য বড় হলেও বন্ধুর মত।

কুরেশী ভাই তখন দৈনিক দেশবাংলার মালিক, সম্পাদক। আগে ছিলো ‘সাপ্তাহিক দেশবাংলা’ এবং তা মোটামুটি ভালোই প্রচারিত ছিলো। দৈনিক দেশবাংলা তেমন প্রচারিত ছিলোনা, অনিয়মিত বের হতো। ফেরদৌস ভাই’র কল্যানে আমি দেশবাংলার সাংবাদিক হয়ে গেলাম। সেই শুরু। দেশবাংলায় তখন গিয়াসুদ্দিন আহমদ, মতিউর রহমান চৌধুরী, আবু তাহের, সঞ্জীব চৌধুরী, মফিজ আহমদ কাজ করতেন। বেতন-টেতন তেমন ছিলোনা। তবু সাংবাদিক তো! আমার জন্যে এটা ছিলো আশীর্ব্বাদ। হাজার হউক সাংবাদিক, পুলিশ ঝামেলা করবে না? তাছাড়া ছিলো ওসমানী-কুরেশী ভাই’র ছত্রছায়া?

ফেরদৌস আহমদ কুরেশী প্রতিদিন অফিসে আসতেন না, সরকারি বিজ্ঞাপন থাকলে তিনি হাজির হতেন এবং পত্রিকা যাতে বের হয় তা নিশ্চিত করতেন। আমরা অজুহাত অজতাম, পেয়ে গেলে সেদিন আর পত্রিকা বের হতোনা। এসব সিদ্ধান্ত নিতেন আবু তাহের। তাঁর সাথী ছিলেন মতিউর রহমান চৌধুরী। ফটোগ্রাফার মোহাম্মদ আলম তখন দেশবাংলায় ছিলেন কিনা ঠিক মনে করতে পারছি না, হয়তো ছিলেন। মোহাম্মদ আলম নেই, মতিউর রহমান চৌধুরী সম্পাদক, আবু তাহেরকে সাংবাদিক জগতে সবাই চেনেন।

একদিন সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ নাই? রাত আট-টায় তাহের ভাই সিদ্ধান্ত দিলেন, কাল পত্রিকা বের হবেনা। আমরা চলে গেলাম। পরদিন দুপুরে ফেরদৌস ভাই অফিসে এলেন। সবাইকে ডাকলেন। যথেষ্ট রাগ করলেন পত্রিকা বের না করার জন্যে। এক পর্যায়ে বললেন, বিদ্যুৎ ছিলনা, একটু পরে তো বিদ্যুৎ এসেছিলো, তোমরা তো একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারতে? আবু তাহের বললেন, সিদ্ধান্ত তো আমরা নিয়েছি। কি সিদ্ধান্ত নিয়েছো? আবু তাহের, সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে পত্রিকা বের হবেনা। ফেরদৌস ভাই, চুপ মেরে যান!

দেশবাংলা ছিলো ‘ট্রানজিট হাউসের’ মত, এখান থেকে অনেক সাংবাদিক তৈরী হয়েছে। সবাই এখানে কাজ শুরু করে অন্য পত্রিকায় জাম্প করতো। মতিউর রহমান চৌধুরী, আবু তাহের, মোহাম্মদ আলম সবাই ধীরে ধীরে সংবাদে চলে গেলেন। ক’দিন পরে আমিও সংবাদে চলে যাই। বড়জোর ছয়মাস ছিলাম দেশবাংলায়। পত্রিকার সদস্যরা প্রায় সবাই ফেরদৌস কুরেশীর পরিবারের সদস্য হয়ে যেতো। ভাবি যথেষ্ট সুন্দরী ছিলেন, শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন চমৎকার ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, অমায়িক ভালো ব্যবহার এবং ভালো রান্না করতেন।

বছর দেড়েক আগে হটাৎ একদিন ফেরদৌস আহমদ কুরেশী’র সাথে আমার টেলিফোনে কথা হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছেন শিতাংশু? বললাম, ভালো, আপনি, ভাবি ভালো তো? বেশ কিছুক্ষন কথা হয়েছে। ভেবেছিলাম, দেশে গেলে এবার তাঁর সাথে দেখা করবো। আর হলোনা। ফেরদৌস কুরেশী কথা বলার পর গিয়াসুদ্দিন ভাই আমার সাথে কথা বলেছিলেন। জানিনা, তিনি কেমন আছেন? ফেরদৌস কুরেশী’র রাজনৈতিক বিচ্যুতি ছিলো, কিন্তু ব্যাক্তগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন চমৎকার ভদ্রলোক, সজ্জ্বন এবং ভালো মানুষ।

সম্ভবত: ১৯৭৯ সালের শুরু থেকেই ফেরদৌস কুরেশী’র সাথে আমাদের সবার যোগাযোগ কমে যায়। রাজনৈতিক দুরুত্ব বাড়তে থাকে। তিনি সাংবাবিক ও রাজনৈতিক উভয় পরিচয়ে পরিচিত ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক বিচ্যুতি ব্যাপক। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। উইকিপিডিয়া জানায়, জানুয়ারি ১৪, ১৯৪১-এ তাঁর জন্ম। মারা গেলেন ৭৯ বছর বয়সে পিডিপি’র (প্রোগ্রেসিভ ডেমক্রেটিক পার্টি) চেয়ারম্যান হিসাবে সোমবার, ৩১শে আগষ্ট ২০২০ বিকালে, ক্যান্টনমেন্টে মেয়ের বাসায়। পত্রিকা মতে, তিনি স্ত্রী, দুই কন্যা ও এক পুত্র রেখে গেছেন।

ফেরদৌস কুরেশী বাংলাদেশ গ্রীনপার্টি গঠন করেছিলেন। একদা বিএনপি’র প্রথম যুগ্ন-সম্পাদক ছিলেন। সেখানেও বেশিদিন টিকতে পারেননি। ২০০৭ সালে পিডিপি গঠন করে তিনি জাতীয় যুক্তফ্রন্টের টিকিটে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তিনি আওয়ামী লীগ-বিএনপি বাদ দিয়ে দেশে নুতন দল গঠনের আহবান জানান। ঐসময় তাঁর ভূমিকা যথেষ্ট বিতর্কিত ছিলো। এরপর তিনি রাজনীতিতে আরো পিছিয়ে পড়েন। ১/১১’র পর তিনি আসলে কিছু একটা হতে চাচ্ছিলেন? কপাল মন্দ, হ’ননি।

১৯৬০-র দশকে ফেরদৌস আহমদ কুরেশী’র ভূমিকা ভালো ছিলো। বঙ্গবন্ধু’র ৬-দফা, ১১-দফা আন্দোলনে তিনি ফ্রন্ট-লাইনে ছিলেন। ১৯৬০ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ১৯৬১ সালে ডাকসু’র ভিপি ছিলেন। পরে সম্ভবত: তিনি অলি আহাদ’দের সাথে বাংলা ছাত্রলীগে যোগদান করেন। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ১৯৬৫ সালে পাবনার শফি আহমদ ডাকসু’র জিএস ছিলেন। তাঁর সাথে আমার বড়ভাই-ছোটভাই সম্পর্ক ছিলো। শফিভাই, প্রায়শ ফেরদৌস কুরেশী সম্পর্কে একটি গল্প করতেন। সেটি হচ্ছে:

১৯৬১ সালে ডাকসু’তে কে হবেন ছাত্রলীগের ভিপি প্রার্থী এনিয়ে সমস্যা বাধে। আব্দুর রাজ্জাক এবং ফেরদৌস আহমদ কুরেশী দু’জনেই প্রার্থী। ফেভারিটি আব্দুর রাজ্জাক। কুরেশীভাই ছাড়বেন না? শেষমেশ সিদ্ধান্ত হলো, দু’জনকে প্রত্যাহার করতে হবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক রাজ্জাক ভাই প্রত্যাহার করলেন। ফেরদৌস কুরেশী করলেন না? তিনি ছাত্রলীগের প্রার্থী এবং ভিপি হ’ন। ১৯৮৬’র জাতীয় নির্বাচনে এমনই একটি ঘটনা ঘটে?

ঐ সময় এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। ১৫ দল ও ৭ দল গভীর রাত পর্যন্ত আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয় যে, তাঁরা নির্বাচনে যাবে। পরদিন উভয় দল ঘোষণা দেবে। সকালে যথারীতি আওয়ামী লীগ নির্বাচনে যোগদানের ঘোষণা দেয়। বিকালে বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন ৭-দল ঘোষণা দেয় যে, তাঁরা নির্বাচনে যাচ্ছেন না, তাঁরা বিশ্বাসঘকতা করেন। খালেদা জিয়া’র আপোষহীন নেত্রী হবার এই কাহিনী তৎকালীন সাংবাদিকরা জানেন। কারণ, রিপোর্টাররা অনেকেই বড় দুই দলের মিটিং-এ উপস্থিত ছিলেন।

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।