চৌধুরী আবদুল হান্নান


বাংলাদেশে তাঁর শ্বশুর বাড়ি, স্ত্রী শুভ্রা দেবী নড়াইলের মেয়ে। অব্রাম্মন পরিবারের মেয়ে শুভ্রার সঙ্গে বিয়েতে আপত্তি ছিল অনেক আত্মীয়ের।প্রণব তোয়াক্কা করেননি। নতুন জীবনের শুরুতেই জানান দিলেন তাঁর ইচ্ছার তেজোদৃপ্ততা। তাঁর রক্তে রাজনীতি বিদ্যমান ছিল, বাবা ছিলেন কংগ্রেস নেতা কিন্ত ছাত্রজীবনে কোনো রাজনীতিতে দেখা যায়নি তাঁকে।কর্মজীবন শুরুর একপর্যায়ে ১৯৬৩ সালে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিদ্যানগর কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দেন তিনি। ৫ বছর ওই কলেজেই ছিলেন, মুখার্জি দম্পতির বেশ পছন্দও হয়েছিল জায়গাটি, সেখানে স্হায়ী হওয়ারও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন তাঁরা। কিন্ত “ ভারত রত্ন “ তো তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে !

ষাটের দশকে কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা হরেন্দ্র নাথ মজুমদারের দৃষ্টি পড়ে প্রণবের মেধা, যোগ্যতার প্রতি এবং তাঁর হাত ধরেই প্রণব মুখার্জির রাজনীতিতে পথ চলা শুরু। এ পথই তাঁকে নিয়ে গেছে অনেক দূরের অন্য এক গৌরবময় ভূবনে।

রাজ্য সভার তরুণ সদস্য হিসেবে ভারত সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে স্বীকৃতি আদায়ে সরব ছিলেন তিনি।সে কারণেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নজরে আসেন তিনি, লুফে নেন প্রণবকে। বাংলাদেশের পক্ষে মনে প্রাণে কাজ করবে,এমন লোকই খুঁজছেন ইন্দিরাজী।

এক কোটি শরনার্থীকে সন্মানের সাথে স্বাধীন বাংলাদেশে দ্রুত ফেরত পাঠানোর জন্য তাঁর মধ্যে অস্হিরতা কাজ করতো।একটি উদাহরণ তুলে ধরি, ১৯৭১ সালের এপ্রিলে ভারতীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশ প্রশ্নে করণীয় ঠিক করতে আলোচনায় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেক শ’কেও উপস্হিত থাকতে বলা হয়েছিল।ইন্দিরা গান্ধী সেনাবাহিনী প্রধানকে বলেন, ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে মার্চ করুক—এটাই আমি চাই।উত্তরে সেনাপ্রধান বলেন, অর অর্থ হচ্ছে যুদ্ধ।ইন্দিরা বলেন, যদি এটা যুদ্ধ হয়, আমার আপত্তি নেই।মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব বুঝতে সেনাপ্রধানের বিলম্ব হয়নি,তিনি তাঁর অবস্হান ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে জানালেন,ভৌগোলিক অবস্হান আর জলবায়ুগত কারণে পাকিস্তানের পূর্ব ফ্রন্টে এখন আমাদের জন্য উপযুক্ত সময় নয়, শীতের আগমন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।আমরা যুদ্ধ করবো শতভাগ বিজয়ের সম্ভাবনা নিয়ে। আর আপনি চাইলে, আমি ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ পত্র জমা দিতে পারি।

প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন — “ আপনি শান্ত হোন,নিজের মতোই আগান । ”ইন্দিরা প্রণব বাবুর মতো লোককে পুরোপুরি কাজে লাগাতে লাগলেন এবং একের পর এক দায়িত্ব দিলেন, বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে বিভিন্ন দেশে সফরে পাঠাতে থাকেন।

১৯৭১ সালে ইন্টারপার্লামেন্টারী ইউনিয়নের প্যারিস বৈঠকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করতে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের সাথে ৩৬ বছরের প্রণবও ছিলেন। বলতে গেলে, সরাসরি যুদ্ধ ব্যতিরেকে চিরশত্রু পাকিস্তানের মতো একটি শক্তিশালী শত্রুরাষ্ট্রের একটি ডানা ভেঙ্গে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন ইন্দিরা কেবল কূটনৈতিক যুদ্ধের মাধ্যমে।প্রণব এ যুদ্ধের সহযাত্রী ছিলেন ইন্দিরার। এভাবেই বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে অকৃত্রিম বাঁধনে আবদ্ধ হন ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। ভারতের বীরভূমে জন্ম নেয়া এ বীর,রাজনীতির বীর, সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব “ ভারত রত্ন “ পাওয়ার আগেই রাজনীতির রত্ন হয়ে উঠেছিলেন ।

বাংলাদেশের সংকটকালে, জন্মলগ্নে আমাদের একান্ত বন্ধু হয়ে কাজ করেছেন, বাংলাদেশও তাকে যথাযথ সন্মান দেখিয়েছে, ২০১৩ সালে তার হাতে “ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সন্মাননা “ তুলে দেয়া হয়। ইন্দিরা গান্ধীর সান্নিধ্য তাকে রাজনৈতিক সাফল্যের পূর্ণতার দিকে নিয়ে গেছে। কংগ্রেসের রাজনৈতিক সংকটকালে, একাধিক নেতা ভিড়ে যান বিরোধী শিবিরে।দলনেত্রীর প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে প্রণব অটল থেকেছেন এবং তিনি তার যেগ্য পুরস্কারও পেয়েছেন।
অসাধারণ স্মৃতিশক্তি,মেধা এবং তাঁর পরিশ্রম করার ক্ষমতা তাঁকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে যায়। ৮৪ বছর বয়সে চলে গেলেন, বাংলাদেশের এক অকৃত্রিম বন্ধু, দুই বাংলার প্রিয়জন রাজনীতির এক উজ্জ্ব নক্ষত্র প্রণব মুখার্জি।
তাঁর প্রয়াণে আমরা এপার বাংলার মানুষ গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি ।

( বি:দ্র: কিছু তথ্য কোলকাতার “আনন্দ বাজার“ পত্রিকা থেকে নেয়া )


লেখক : সাবেক ব্যাংকার ।