নিজস্ব প্রতিবেদক : 'মৃত্তিকালগ্ন সংস্কৃতি  উদ্ভাসিত হোক বিশ্বমঞ্চে' এই স্লোগানকে ধারণ করে বগুড়া জেলার নন্দীগ্রাম উপজেলার বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষদের নিয়ে যাত্রা শুরু হল রঞ্জনি’র। রঞ্জনি মূলত সমতলের আদিবাসী সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠন। নন্দীগ্রাম উপজেলা আদিবাসী মাহাতো এবং ঊঁরাওদের মধ্যে প্রচলিত  বিভিন্ন নৃত্য আঙ্গিক ও  পরিবেশনাকে  জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরার লক্ষ্যে এ সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে মাহাতো প্রায় চল্লিশজন সদস্য  নিয়ে  এই সাংস্কৃতিক সংগঠন যাত্রা শুরু করেছে। কিছুদিনের মধ্যেই ঊঁরাও এবং চৌহান জনগোষ্ঠীর মানুষদেরকেও এ সংগঠনের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

সমতলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় নৃত্যগীত প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু সেই সংস্কৃতি বরাবরই থেকে গেছে প্রচারণার বাইরে। ফলে আদিবাসী সমাজে নৃত্যগীত পরিবেশনকারী শিল্পীগণ নির্ধারিত মূল্যায়ন পাননি; অথচ শিশুকাল থেকে তারা নৃত্যগীত পরিবেশনায় দক্ষ এবং অভ্যস্ত। এক একটি জাতির মধ্যে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের হরেক রকমের নৃত্যগীত। যা প্রতিষ্ঠিত প্রধান ধারার নৃত্যগীতের চাইতে কোন অংশেই কম নয়। শুধুমাত্র মাহাতো সম্প্রদায়ের মধ্যেই রয়েছে- মুশেহের, গড়পিছরা, খেমটা, ঝুমুর, দোড়হা, নটুয়া, চাচের ইত্যাদি নৃত্যগীত। উল্লেখিত, প্রতিটি নৃত্যের গতি, ছন্দ, কথা ও পদসঞ্চালনার ভিন্নতা রয়েছে। আসরে উপস্থিত যেকোনো দর্শককে এই সমস্ত নৃত্যগীত বিমোহীত করবে নিশ্চিতভাবেই, অথচ সমতলের আদিবাসীদের এমন সমৃদ্ধ সংস্কৃতি প্রচারণার অভাবে থেকে গেছে অন্তরালে। অন্তরালে থাকা এই সমস্ত নৃত্যগীত মূলক পরিবেশগত জাতীয় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচয় করিয়ে দেয়া এবং পরিবেশনকারীদের শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান জরুরি বলে সমন্বয়কারী মনে করেন। রঞ্জনি’র মূল উদ্যোক্তা এবং সমন্বয়কারী অমিত হাসান সোহাগ। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে 'এথনিক থিয়েটার' বিষয়ে অধ্যায়নরত। পাশাপাশি তিনি স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সমতলের একটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের কৃত্যমূলক পরিবেশনার উপর গবেষণা করছেন। গবেষণারত অবস্থায় ফিল্ড ওয়ার্কে গিয়ে আদিবাসী মানুষদের সাথে পরিচয়ের পর তিনি যখন জানতে পারেন তাদের ভিতর বহু বৈচিত্র্যময় এবং বর্ণিল সংস্কৃতি রয়েছে তখন তিনি তাদের নিয়ে গবেষণার বাইরেও কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন।

তার এই উদ্যোগে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে নন্দীগ্রাম উপজেলা মাহাতো এবং ঊঁরাও সম্প্রদায়ের মানুষ। কিন্তু তাদের নিজেদের ধর্মীয় কৃত্যমূলক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন কিংবা চর্চার জন্য ছিল না কোন নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র। এমতাবস্থায় গবেষকের নিজ উদ্যোগে এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী-শিক্ষকগণের সহযোগিতায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মাঝে বাদ্যযন্ত্র উপহার দেয়া হয়। এরপর থেকেই আদিবাসী গ্রামগুলোতে নিয়মিতভাবে নিজস্ব ভাষায় সংস্কৃতি চর্চা পুরোদমে শুরু হয়ে যায়।

রঞ্জনি’র পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনাকালে এর উদ্যোক্তা অমিত জানান যে, 'আদিবাসী সমাজের মধ্যে চর্চিত সমৃদ্ধ নৃত্যগীত ও নাট্যমূলক পরিবেশনাকে দেশে এবং দেশের বাইরের মানুষের কাছে তুলে আনার চ্যালেঞ্জ হিসেবে আমি গঠন করেছি 'রঞ্জনি'। 'রঞ্জনি' কুর্মালি ভাষার শব্দ। যার অর্থ রঙিন। আদিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত সমস্ত সাংস্কৃতিক পরিবেশনা অত্যন্ত রঙ্গিন এবং বৈচিত্র্যময়। বৈচিত্র্যময় ক্ষিপ্রগতির নাটকীয়তাপূর্ণ নৃত্য, দেশের মানুষের সামনে উপস্থাপন করা আমার কাছে জরুরি বলে মনে হয়েছে। একজন পরীক্ষার্থী গবেষক হিসেবে হয়তো আমি আমার ডিগ্রি পাব। আমার থিসিস পেপার বিভাগে জমা থাকবে। একসময় তার উপর ধুলির আস্তরণ পরবে। ইঁদুর কিংবা উইপোকা খেয়ে ফেলবে। অথবা ময়লা-আবর্জনা হিসেবে কেজি দরে বিক্রি করে দেয়া হবে। কিন্তু তাতে করে এই মানুষদের কি লাভ? এই জাতিই বা কি পাবে আমার কাছ থেকে? তখন মনে হয়েছে থিসিস পেপার এর ভেতরে এদের পরিবেশনারীতি, কৌশল কিংবা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র অথবা আদিবাসী মানুষদের দুঃখগাথা লিখে আসলে তাদের কোন লাভ হয় না। লাভ হয় গবেষকের ব্যক্তিগত। সে হয়তো ভালো চাকরি পায়। কিন্তু এই বিলীয়মান সংস্কৃতি রক্ষা পায় না। উন্নতি ঘটে না শ্রমজীবী এই মানুষদের। তাই তাদের ভেতর চর্চিত বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ নৃত্যনাট্যমূলক পরিবেশনা সমূহকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপস্থাপন করবার জন্য আমি পদক্ষেপ নিয়েছি। তাতে করে হয়তো মাহাতো কিংবা ঊরাও সমাজের মধ্যে তাদের বিলীয়মান সংস্কৃতি রক্ষার সম্ভাবনা তৈরি হবে। শিল্পী হিসেবে তারা স্বীকৃতি পাবে। হয়তো সামান্য কিছু আর্থিক পরিবর্তনও হতে পারে।' তাদের সাথে কাজ করতে গিয়ে প্রথম যে শর্তটি আমি দিয়েছি তা হল, 'নিজেদের ভেতর নিজেদের ভাষায় কথা বলতে হবে। বিশেষ করে শিশুদের সাথে তাহলেই আমি তাদের পাশে থাকবো। কারণ শিশুদের সঙ্গে নিজেদের ভাষায় কথা বললেই কেবল একটি ভাষা রক্ষা পাবে। পাশাপাশি যে সমস্ত বাদ্যযন্ত্র তাদেরকে উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছে সেগুলো নিয়মিত ব্যবহার করতে হবে। আমার এই প্রস্তাবে তারা রাজি হয়েছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় এখন তাদের গ্রামে নৃত্যগীতের আসর বসে। সারাদিনের পরিশ্রম শেষে বাড়ির আঙিনায় পাড়ার সবাই মিলে নিজেদের ভাষায় নাচ-গান করে। আনন্দমচ্ছবে শামিল হয়। হয়তো তাদের সংস্কৃতি খানিকটা পুষ্টি পাবে। তাই নতুন রূপে পুষ্টি প্রাপ্ত সেই সংস্কৃতিকে আমি মূলধারার মঞ্চে তুলে নিয়ে আসতে চাই।' এর পাশাপাশি তিনি সমাজের সকলের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।

(এএইচ/পি/সেপ্টেম্বর ৬, ২০২০ইং)