জে জাহেদ


সময় বড় কঠিন। কিছু প্রশ্নের উত্তর সব সময় অধরা থেকে যায়। তথ্য প্রযুক্তির এই আধুনিক যুগেও আদিম মানষের মতো এখনো কুসংস্কার আর গুজবে গা ভাসিয়ে চলি। পুরো ড্রাম ভর্তি দুধ যেমন এক ফোঁটা বিষে নষ্ট হয়। তেমনি পুলিশের শত ভালো কাজের মধ্যেও একটি অনাকাংঙ্খিত ঘটনায় সবকিছু ফ্যাকাসে হয়ে যায়। মরিচা পড়ে নিমেষেই নীল কাপড়ে।

শুধু পুলিশের দোষ না দিয়ে পুলিশের ভালো কাজগুলোর কথাও যে আমাদের মাঝে-মধ্যে বলা দরকার তা কেনো যেনো ভুলে যাই। আমরা সম্ভবত অতিদ্রুত ভুলে যাই যেসব পুলিশ সদস্যদেশের মঙ্গলের জন্য, এ সমাজের মানুষের জীবন বাঁচাতে প্রাণ দিয়েছেন তাদের কথা। সেইসব শহীদের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ প্রকাশের কথা স্বীকার করতে চাই না।

ভূরি ভূরি উদাহরণ দেওয়া যাবে- কুখ্যাত খুনি, চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসায়ী, গডফাদারদের ‘হাতকড়া’ পরাতে জীবনবাজি রাখে আমাদের আইনশৃঙ্খলবাহিনী। ওরা কিছুদিনের মধ্যেই জেল থেকে বেরিয়ে যায়। পুনরায় পূর্বের অপকর্মে লিপ্ত হয়ে নতুন অপরাধ সংঘটিত করে থাকে ওরা। পরবর্তীকালে অপরাধটিকে যত সহজে তুলে ধরা হয় নেপথ্যের কথা তুলে ধরা হয় না। আদালতের বিচার পর্যন্ত ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী বা গডফাদার কারাগার আটক থাকলে বাইরের জগতের সাধারণ মানুষ স্বস্তি পেতো।

এক্ষেত্রে অনেকেই মানবাধিকারের ‘পাত্র’ নিয়ে হাজির হবেন কিন্তু আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের মানবাধিকারের প্রসঙ্গটি দিব্যি এড়িয়ে যাবেন। এটাই হয়ে আসছে দীর্ঘকাল ধরে । কিছু দিন ধরেই দোষের ‘তীর’ পুলিশ-র‌্যাব তথা আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর দিকে। আমাদের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে সুযোগ পেলেই সুশীলদের অনেকেই ‘জ্ঞান’ দেওয়া শুরু করেন। অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সততা ও নিষ্ঠার সংবাদটি আমরা সাংবাদিকতার চোখে দেখতে চাই না। কাউকে আঘাত দেওয়ার উদ্দেশে বলছি না, বাস্তবতাকেই আমরা স্বীকার করতে চাই না। হাঁ, দিনাজপুরের ইউএনও অত্যন্ত দক্ষ, সৎ, যোগ্য এটি খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে।

কিন্তু একজন সৎ হলেই কী হয়? সন্ত্রাসী হামলার পর নানামহল থেকে উস্কানিমূলক কথা-বার্তা শোনা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, রাজনীতিবিদ নামের হাইব্রিডের দৌরাত্ম্য, অযোগ্যদের আস্ফালনের প্রসঙ্গগুলো উঠছেই না। থানার ওসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়, ‘এই মামলাটি নেওয়া যাবে না, তবে এটি নেওয়া যাবে।’ অর্থাৎ পুলিশকে শতভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হয় না। অনুপ্রবেশকারীদের কথা ভাবা হচ্ছে কোথায়? স্বীকার করতেই হয়, কোনো কোনো কাজে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার ব্যর্থতা আছে, সাফল্যও কিন্তু আছে।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ইউএনও ওয়াহিদাকে দেখতে যান গতকাল। সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইউএনওর ওপর হামলার ঘটনায় করা মামলাটি তদন্তাধীন। এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তার করা হবে।’ শোনা যায়, জড়িত ‘সবাইকে গ্রেপ্তার’ করা হলে রাঘববোয়াল ধরা পড়বে। গত ২ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে ঘোড়াঘাটের সরকারি বাসভবনে ইউএনও ওয়াহিদা ও তার বাবা ওমর আলীকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে দুর্বৃত্তরা। পরদিন সকালে আহত বাবা-মেয়েকে প্রথমে রংপুর নেওয়া হয়। পরে ইউএনও ওয়াহিদাকে হেলিকপ্টারে ঢাকায় আনা হয়। এরপর থেকেই র‌্যাব-পুলিশ-ডিবি পৃথকভাবে কাজ করছে সেখানে। উদ্দেশ্য অপরাধীকে ‘পাকড়াও’ করা।

আইশৃঙ্খলা বাহিনির ডিআইজি পর্যায়ের একজন সদস্য চা খেতে খেতে বলেছিলেন, ‘অফ দ্য রেকর্ড বলছি, মাঠ থেকে শুধু উল্টাপাল্টা খবর পাচ্ছি। কেউ কেউ সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে ওসিকে ভীষণ ডিস্টার্ব করছে। অথচ সেই পুলিশ তো এদেশের মানুষের জন্যই প্রয়োজনে জীবন দিয়ে থাকে।

দ্রুত অতীত ভুলে যাওয়া যাবে না। বাস্তবতা ভয়াবহ। ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীসহ সারাদেশে হেফাজতে ইসলাম কর্মীদের নাশকতার ঘটনায় দায়ের করা ৮৩ মামলা হয়েছিল। এরমধ্যে পুলিশ হত্যা মামলাও রয়েছে। পুলিশ বলছে, ঘটনার সঙ্গে শত শত মানুষের সম্পৃক্ততা থাকায় নির্দিষ্ট করে ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে দেরি হচ্ছে।

২০১০-এ জন্ম নেয় হেফাজতে ইসলাম। সংগঠনটি ২০১৩ সালের শুরুতে ইসলাম ধর্মের অবমাননা বন্ধে আইন পাসসহ ১৩ দফা দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিল । পরে এর রাজনৈতিক রূপও দেখা যায়। ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীসহ সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতা ও নাশকতার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছিল এই রূপটি। ওই ঘটনায় রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের ২২ কর্মীসহ ৩৯ জন নিহত হন। এসব ঘটনায় ৮৩ মামলায় ৩ হাজার ৪১৬ জনের নামসহ ৮৪ হাজার ৯৭৬ জনকে আসামি করা হয় বলে জানায় পুলিশ সদর দফতর।

এসব হামলায় হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, নেজামে ইসলাম, খেলাফত মজলিশ, খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাকর্মী ছিল। দায়িত্ব পালনের সময় এসআই শাহজাহানকে হত্যা করা হয় , পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশকে পুড়িয়ে মারা হয়। অবৈধভাবে মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে সরকার উৎখাতের হুমকি দেওয়া হয়। এমন কী তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। মতিঝিল-দিলকুশাকে এক ভয়ঙ্কর জনপদে পরিণত করা হয়। তারা পুলিশের ওপর নৃশংস হামলা চালায়। এরপর র‌্যাব-পুলিশ-বিজিবি রাতে একযোগে অভিযান চালিয়ে জায়গা খালি করেছিল। তখন ডিএমপির কমিশনার হিসেবে ড. বেনজীর আহমেদের দায়িত্ব ছিল বেশি এবং তিনি তা ধৈর্যের সঙ্গে পালনও করেন। অত্যন্ত মেধাবী এ উচ্চপদস্থ পুলিশকর্মকর্তার দক্ষতা পুলিশ বিভাগে গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়।

দেলওয়ার হোসেন সাঈদীর মুখ চাঁদে দেখা গেছে- এ গুজবকে কেন্দ্র করে প্রথম আক্রমণটা চালানো হয় পুলিশের ওপর। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সুন্দরগঞ্জের শিববাড়ি মোড়ের ডাক বাংলার ভেতরের পুলিশের তদন্ত কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে চার নিরস্ত্র পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা। জীবন বাঁচাতে পুলিশ সদস্যরা টেবিলের নিচে ও বিভিন্নস্থানে লুকানোর চেষ্টা করেও তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। সম্পূর্ণভাবে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল তদন্ত কেন্দ্রটি। ২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকানোর জন্য সবচেয়ে বেশিবার ও বেশিসংখ্যক পুলিশের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। নিরীহ মানুষ হত্যার পাশাপাশি পুলিশ-র‌্যাবের ওপর হামলা চালানোর কারণ, পুলিশকে দুর্বল করা।

১ জুলাই ২০১৬, শুক্রবার রাত। অতর্কিত হামলা, গুলি চলায় জঙ্গিরা। গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কে স্প্যানিশ রেস্তোরাঁ হলি আর্টিজান বেকারিতে কয়েকজন জঙ্গি অতর্কিত হামলা চালায়। সেখানে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন ও ডিবির এসি রবিউল আলম প্রাণ হারান জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের হাতে। শুরুতেই গুলিতে প্রদীপ ও আলমগীর নামের পুলিশের দুজন কনস্টেবলসহ বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন এবং আহত কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তখন র‌্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন ড. বেনজীর আহমেদ। সেদিন ঘটনাস্থলে পৌঁছেই র‌্যাবের মহাপরিচালক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ঢাকার কল্যাণপুরে একটি ‘জঙ্গি আস্তানায়’ পুলিশী অভিযানে নয়জন জঙ্গি নিহত হয়। শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় শতাধিক সফল জঙ্গিদমন অভিযান চালিয়েছে পুলিশ।

করোনা কালে এই পুলিশেরাই জীবনের ঝুকি নিয়ে বাড়ী বাড়ি গিয়ে আমাদের গরীব মানুষের খাবার জুটিয়েছিল। কুতুবদিয়ার মানুষকে কর‍োনা মুক্ত রাখতে রাত-দিন পরিশ্রম করেছিলেন মাস্ক নেই, পিপি নেই বলে ঘরে বসে থাকেনি পুলিশ। নিজেদের গাড়ি করে অসুস্থ করোনা রুগীদের গভীর রাতে হাসপাতালে নিয়েছিল, এ্যাবুলেন্স আনিয়ে রুগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল। গ্রামের সবাই যখন মৃত করোনা রুগীর দাফনে এগিয়ে আসেনি, এই পুলিশ নিজেই দাফন-কাফনের দায়িত্ব নিয়েছিল। এই পুলিশের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে কুতুবদিয়াতে করোনা মহামারি আকারে ছড়াতে পারে নাই, একটা মানুষও করোনাতে মারে নাই। হায়রে খারাপ পুলিশ?

এই পুলিশের কঠোর পরিশ্রমের কারণেই জলদস্যু প্রবন কুতুবদিয়া ও আশপাশের এলাকা জলদস্যু মুক্তই ছিলো। আড়াই বছরে একটিও হত্যাকান্ড হয়নি, মাদক প্রায় নির্মূল হয়েছিল। ইভটিজিং একেবারেই বন্ধ হয়েছিল, বন্ধ হয়েছিল সামাজিক সব অনাচার। জীবনের ঝুকি নিয়ে পুলিশেরা আধুনিক কুতুবদিয়া উপহার দিয়েছিল। কিন্তু আজ কাঠগড়ায়; মানুষ এত সহজে ভূলে গেলেন পুলিশের শত ভাল কাজ।

বৈশ্বিক সমস্যা জঙ্গিসন্ত্রাস। জঙ্গিদমনে আমাদের বাংলাদেশ পুলিশ যা করেছে তা সারা বিশ্বে প্রশংসনীয়। পুলিশ অসংখ্য নাশকতামূলক ঘটনা দমন করে জানমাল রক্ষা করেছে। আমরা কয়টার খোঁজ রাখি। করোনাকালে পুলিশের মানবিক আচরণ কী আমরা দেখিনি!

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী, চট্টগ্রাম।