রণেশ মৈত্র


বিগত ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় সন্ধ্যা সাতটার দিকে মৃত্যুবরণ করেন শতবর্ষী আল্লামা মওলানা আহমেদ শফি-যিনি ‘তেঁতুল হুজুর’ বলে দেশ ব্যাপী খ্যাত। ব্রেকিং নিউজ হিসেবে তৎক্ষণাৎ টিভি চ্যানেলগুলিতে খবরটি প্রচারিত হলো।

সঙ্গে সঙ্গে হাট-বাজারে, হোটেল-রেস্তোঁরায় পাড়ায় পাড়ায় মানুষ নানা প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন। ফেসবুকেই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকে যার প্রধান সুর ছিল, বাংলাদেশ আলেম নামধারী এক সমাজ-দুশমনের কবল থেকে মুক্ত হলো। সাথে সাথে পাল্টা প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে লিখলেন, একজন মৃত মানুষের ব্যাপারে তাঁর বিরুদ্ধে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া জনারণ্যে প্রকাশ করা অসমীচীন। এই প্রতিক্রিয়া প্রকাশের সাথে সাথে অনেকেই তৎপর হয়ে হেফাজতের আমীর আল্লামা শফি আহমেদ ২০১৩ সালে হঠাৎ ঢাকা ঘেরাও করে মতিঝিল চত্বরে দখল নিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে গাড়ী করে এনে জড়ো করে বিশাল সমাবেশ করে হেফাজতের পক্ষ থেকে ১৩ দফা গণ-বিরোধী দাবীর কথা উল্লেখ করে, ঘরের বাইরে নারীর স্থান নেই কারণ নারী হলো তেঁতুল তুল্য। তাদের দেখলেই পুরুষের লোলুপ জিহ্বায় পানি আসে। ঢাকার শাহবাগে অনুষ্ঠিত বিশাল লাখো তরুণ যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচার ও ফাঁসির দাবী জানাচ্ছিল তাদের বিরুদ্ধে হুমকি-ধামকি ও গুন্ডা লেলিয়ে দিয়ে হামলা চালানোর নির্দেশ দিতে পরোয়া না করা, ইসলামী রাষ্ট্র গঠন, শিক্ষানীতি বদলে দিয়ে তার সাম্প্রদায়িকীকরণ, নারী অধিকার সংকোচন সহ ঐ ১৩ দফা কর্মসূচীর দ্বারা তাঁর পাকিস্তান পন্থী মনোভাবের সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটান এমন কি, ঐ সমাবেশের খবর সংগ্রহ করতে আসা ৭১ টিভি চ্যানেলের এক নারী সাংবাদিককে গু-া লেলিয়ে দিয়ে আহত করার মত ন্যক্কারজনক কাজগুলির উল্লেখ করে অসংখ্য পোষ্ট দিতে সুরু করেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সমূহে।

বিগত ১৯ সেপ্টেম্বর-অর্থাৎ আল্লামা শফির মৃত্যুর পরদিনের ভোরের কাগজ পত্রিকায় “হেফাজত আমির আল্লামা শফির জীবনাবসান” র্শীষক প্রকাশিত প্রতিবেদনে তাঁর কর্মময় জীবন, পারিবারিক তথ্যাদির খবর দিয়ে লিখেছেঃ

হেফাজতে ইসলাম হাটহাজরী মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আল্লামা শফির সাথে তাঁরই শিষ্য জুনায়েদ বাবুন গবীর ছিল গলায় গলায় খাতির। দুজনে এক সঙ্গে “নাস্তিক ব্লগারদের” ফাঁসি চেয়েছেন। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধী শক্তি। এদেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে এবং নানা অপপ্রচার চালিয়ে তথাকথিত ‘নাস্তিক ব্লগারদের’ বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তাঁরা। ঐ বছরের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে লাখো মানুষের সমাবেশের নামে ভাংচুরের তা-ব চালিয়ে জানান দিয়েছিলেন নিজেদের শক্তিমত্তা । এমন কি সরকার উচ্ছেদের হুমকিও উচ্চারিত হয়েছে ঐ সমাবেশের নেতাদের মুখ থেকে।

সেদিন রাতে র‌্যাব-পুলিশের অভিযানের মুখে হেফাজত কর্মীরা ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হলেও বিভিন্ন ব্লগের মাধ্যমে এই সংগঠনের কর্মীদের আস্ফালন অব্যাহত ছিল। কেউ তাদের মতের বিরুদ্ধে গেলেই তাকে ‘নাস্তিক মুরতাদ’ ফতোয়া দেওয়া হতো। একের পর এক ব্লগারদের খুন করার পর হেফাজত নেতাদের উল্লাস করতেও দেখা গেছে।

গত বুধবার ১৫ সেপ্টেম্বর আল্লামা শফির বিরুদ্ধে তাঁরই হাটহাজারী মাদ্রাসার একটি বড় অংশের শিক্ষার্থী আন্দোলন শুরুর পর রাতে মাদ্রাসার সুরা কমিটির বৈঠক করে আল্লামা শফির পুত্র আনাস মাদানীকে অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বিক্ষুব্ধরা শান্ত হলেও সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার গুঞ্জনে পরদিনও আবার বিক্ষোভ হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার মাদ্রাসাটি বন্ধের নির্দেশ দেয়।

সরকারি নির্দেশের পর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে রাতে আহমেদ শফির নেতৃত্বে বৈঠকে বসে মাদ্রাসার গুরা কমিটি। বৈঠকে ১২ সদস্যের গুরা কমিটির পাঁচ সদস্য এবং মাদ্রাসার প্রবীন সিনিয়র শিক্ষকরা উপস্থি ছিলেন। মাদ্রাসার গুরা কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন নানুপুরী বলেন, অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে মহাপরিচালকের পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন বড় হুজুর। তবে তিনি আমৃত্যু দলে মুহাতামিম (উপদেষ্টা) হিসেবে থাকবেন। তিনি মাদরাসা পরিচালনা ও নতুন মুহতামিম মনোনায়নের দায়িত্ব গুরা কমিটিকে দিয়েছেন।

স্বার্থের দ্বন্দ্ব পুনরুজ্জীবিত

আল্লামা শফি জীবিত থাকাকালেই তাঁর মাদ্রাসা ও হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব নিয়ে যে ব্যাপক দ্বন্দ্ব সংঘাত দীর্ঘদিন যাবত চলে আসছিল তার পুনরুজ্জীবন স্বাভাবিকভাবেই ঘটবে। কারণ বিষয়টি ছিল স্বার্থের দ্বন্দ্ব। জানা যায়, হাটহাজারী মাদরাসা ও হেফাজতের বিপুল সম্পত্তি নিয়ে সংগঠনের আমীর আল্লামা শফির সাথে মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর দ্বন্দ্ব-সংঘাত বেশ কিছুদিন ধরেই চলছিল-যে কারণে জুনায়েদ বাবুনগরীকে তাঁর পদ থেকে আল্লামা শফি বহিস্কার করে সেই দায়িত্ব নিজ পুত্রকে দিয়েছিলেন। জানা যায়, আল্লামা শফির মৃত্যুর পরপরই বিক্ষুব্ধ ছাত্র সমাজের সহযোগিতা নিয়ে শফির সা¤্রাজ্য এখন বাবুনগরীর কব্জায়। আল্লামা শফির লাশ হাসপাতালে থাকাকালেই নাকি এমনটি ঘটেছে। এর পরিণতিতে মওলানা শফির দাফক কাফনের পর উদ্ভূত নতুন পরিস্থিতিতে বিদ্যমান স্বার্থান্ধ গ্রুপ দুটির মধ্যে দাঙ্গ-হাঙ্গামার সৃষ্টি হতে পারে বলে অনেকেই আশংকা করছেন। আজ কয়েকদিন যাবত মাদ্রাসটি ঘিরে রেখেছে পুলিশ।

দ্রব্যমূল্য-করোনা জনিত দেশে বিরাজমান উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পরোয়া না করেই এ সংঘাত ভয়াবহ রূপও নিতে পারে যদি নেতৃত্ব সংকটের শান্তিপূর্ণ সুরাহা না হয়।

শোকবার্তা নিয়ে বিতর্ক

টেলিভিশনের পর্দায় ব্রেকিং নিউজ হিসাবে গত ১৮ সেপ্টেম্বর আল্লামা শফির মৃত্যু ঘোষণার সাথে সাথেই ঘোষিত হলো রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোকবার্তা। শোকবার্তা এই দুজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। অন্তত: ৭/৮ জন মন্ত্রী, বিএনপির মহাসচিব, জাতীয় পার্টির প্রধান প্রমুখও শোকবার্তা পাঠিয়েছেন। শাপলা চত্বরের সমাবেশে কৃষক শ্রমিক লীগ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকিও উপস্থিত হয়েছিলেন। এই নিবন্ধ লেখা অবধি অবশ্য তাঁর কোন শোকবার্তা চোখে পড়ে নি।

মানুষের মৃত্যু ঘটলে শোকবার্তা মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর পক্ষ থেকে জানানোর নীতিমালা আমার জানা নেই। তবে সাধারণ রাজনৈতিক ও সামাজিক জ্ঞানে বুঝি, এক্ষেত্রে তাঁদের রাষ্ট্রীয় সীমাবদ্ধতা আছে যা তাঁরা শপথ গ্রহণের মাধ্যমে মেনে চলতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। তাই জামায়াতে ইসলামী, আই.এস. প্রভৃতির যত বড় নেতারই মৃত্যু ঘটুক না কেন তাদের জন্য রাষ্ট্র কোন শোক প্রকাশ করতে পারে না। করা হয়ও নি ইতোপূর্বে। রাষ্ট্রীয় চার মৌলনীতি, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের বিরোধিতাকারী কারও মৃত্যুতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র কোনক্রমেই শোক প্রকাশ করতে পারে না। সেই বিবেচনায়, রাষ্ট্রের মূল কর্ণধার হিসেবে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী যেহেতু চার মৌলনীতি সংরক্ষণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তাই ধর্মনিরপেক্ষতা বিরোধী, সাম্প্রদায়িক, নারী বিদ্বেষী, পরমতে অসহিষ্ণু তার মাধ্যমে গণতন্ত্র বিরোধী, জাতীয় নারী নীতি ও শিক্ষানীতির ঘোর বিরোধী এবং উগ্র ধর্মান্ধতার প্রবক্তা আল্লামা শফির মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় শোক প্রকাশ ও রাষ্ট্রীয় মৌলনীতি বিরোধী।

হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা শফি ভারতের দেওবন্দে শিক্ষা প্রাপ্ত। দেওবন্দে যে উগ্র ইসলামের চর্চা হয়-তা তো সবারই জানা, দেওবন্দের উক্ত নীতির প্রতি অসীম আনুগত্য তিনি আমৃত্যু পোষণ করেছেন। সে কারণেই মতিঝিল শাপলা চত্বরের ১৯৯৩ সালের সমাবেশে নারী সাংবাদিককে লাখো লোকের সামনে আঘাত-আহত করতে তিনি এবং তাঁর হেফাজত নেতা-কর্মীরা বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত হন নি। ওই রাষ্ট্রীয় শোক প্রকাশের পর আহত নারী সাংবাদিকটির মনোভাব কেমন দাঁড়াবে?

শুধু তাই না, যিনি নারীকে গৃহবন্দী করে রাখতে চান, যিনি নারী শিক্ষা, নারী প্রগতির ঘোর বিরোধীতা করে গেলেন প্রকাশ্যে এবং আজীবন, এই সরকার প্রণীত নারী নীতি বদলানোর জন্য সমাবেশ ডেকে হুমকি দিলেন, হুমকী দিলেন শিক্ষানীতির সাম্প্রদায়িকীকরণ করার দাবীতে যিনি প্রকাশ্য সমাবেশে একটি প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উচ্ছেদের ডাক দেওয়ার মাধ্যমে তাঁর উগ্রতা বোধের পরিচয় দিলেন, যিনি ব্লগার হত্যার প্রকাশ্য উস্কানী দাতা এবং যিনি ২০১৩ সালে দেশপ্রেমিক তরুণদের আয়োজিত ঐতিহাসিক শাহ্বাগ সমাবেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীর বিরোধিতা করতে দ্বিধাবোধ করেন নি-উনি ঐ হাটজারী মাদরাসাকে জঙ্গী উৎপাদানের কারখানায় পরিণত করেছেন বলে ব্যাপকভাবে অভিযোগ উচ্চরিত হয় সেই আল্লামা শফি কি তবে প্রকাশ্যেই তাঁর পাকিস্তানীপন্থী চিন্তাধারা ও ক্রিয়াকলাপ চালিয়ে যেতে দ্বিধাবোধ করেন নি, তবুও তাঁর মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় শোক প্রকাশের মাধ্যমে যে বার্তা দেওয়া হলো তার সাথে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শের প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের পর্য্যায়ে পড়ে বলে মনে করি ।

যা ভেবেছি তা প্রকাশ্যেই প্রকাশ করলাম। তাই শেষ কথা যা বলতে চাই, রাষ্ট্রীয় শোকবার্তার গৌরব এহেন আল্লামা শফি বা তাঁর সহকর্মী, সমর্থক ও বংশধরেরা পেতে বিন্দুমাত্র অধিকারী নন-রাষ্ট্রের পক্ষে এমন শোকবার্তা প্রকাশও পূরোপূরি অবাঞ্ছিত। কী ভূমিকা ছিল ভাষা আন্দোলনে মুক্তিযুদ্ধে ঐ শফি হুজুরদের তাও প্রকাশ করা হোক।

যদি রাষ্ট্রীয় সম্মাননা তিনি তবুও পান বা তাঁর উত্তর সূরীরা ঐ ভিনদেশী আদর্শ বাংলাদেশ বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী আদর্শ লালান সত্বেও রাষ্ট্র তার প্রতি ন্যূনতম সম্মাননা দেন-তখন ভাবতেই হয় আমরা মুক্তিযোদ্ধা, ভাষা-সৈনিক ও দেশপ্রেমিকেরা নই, শফি হুজুররাই থাকবেন। তাঁরাই পাবেন অমরত্ব আমাদের এই কষ্টার্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে।

লেখক : সভাপতি ম-লীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।