রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরা শহরের পারকুকরালির ডাঃ মোখলেছুর রহমান জনি সদর থানা লকআপ থেকে নিখোঁজের ঘটনায় তৎকালিন দু’ থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমদাদ শেখ ও ফিরোজ হোসেন মোল্লার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত বিভাগীয় মামলায় ৯ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। রোববার ও সোমবার সাতক্ষীরা পুলিশ পরিদর্শকের অফিসে মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা খুলনা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ওয়াসিম ফিরোজ এ সাক্ষ্য গ্রহণ করেন।

সাক্ষ্যদাতারা হলেন- নিখোঁজ মোখলেছুলের বাবা শেখ আব্দুর রাসেদ, তার মা আনোয়ারা বেগম, চাচা শেখ সাদিকুর রহমান, স্ত্রী জেসমিন নাহার রেশমা, সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁ, সিপাহী ফসিয়ার রহমান, সিপাহী ইলিয়্সা হোসেন, সিপাহী মহিদুল ইসলাম ও উপপরিদর্শক রইচউদ্দিন।

সাক্ষ্যপ্রদানকালে প্রথমাক্ত ৫ জন কিভাবে ও কোথা থেকে মোখলেছুরকে ধরে আনা হয় ও পুলিশ তাদের সঙ্গে কি ধরণের আচরণ করেন তার বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরেন।

খুলনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ওয়াসিম ফিরোজ বলেন, সাতক্ষীরার দু’ সাবেক ওসি’র বিরুদ্ধে থানা লকআপ থেকে ডাঃ মোখলেছুর নিখোঁজ সম্পর্কিত ১৬/২০ ও ১৭/২০ বিভাগীয় মামলায় রবিবার ৫ জন সাক্ষী দিয়েছেন। সোমবার একজন উপপরিদর্শক ও তিনজন সিপাহী সাক্ষী দেন। তিনি আরো জানান, এর বাইরেও কয়েকজনকে সাক্ষী হিসেবে ডাকা হবে। সোমবার বিকেলে তিনি এ সংক্রান্ত তথ্য নিতে সদর থানায় যাবেন।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৪ আগষ্ট রাত সাড়ে ৯টার দিকে অসুস্থ বাবার জন্য বাইসাইকেলে ঔষধ কিনতে যেয়ে সাতক্ষীরা শহরের লাবনী সিনেমা হলের সামনে ফটোস্টাটের দোকান থেকে সদর থানার উপপরিদর্শক হিমেল হোমিও চিকিৎসক মোখলেছুর রহমান জনিকে থানায় ধরে নিয়ে যায়। ৫,৬ ও ৭ আগষ্ট স্ত্রী জেসমনি নাহার রেশমা শ্বশুর ও স্বজনদের নিয়ে থানা লক আপে তাকে খাবার দিয়েছেন, তার সঙ্গে কথা বলেছেন। থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমদাদুল হক শেখ ও উপপরিদর্শক হিমেলের সঙ্গে কথা বললে জনির জঙ্গি সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জানানো হয়। স্বামীর মুক্তির বিনিময়ে তৎকালিন থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও উপপরিদর্শক হিমেল জনির স্ত্রী রেশমার কাছে দাবি করেন মোটা অংকের টাকা। ৮ আগষ্ট থানায় গেলে জনিকে পাওয়া যায়নি। পুলিশ জনির অবস্থান সম্পর্কে জানাতে পারেনি।

বিষয়টি সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি, ক্ষমতাসীন দলের নেতা, মানবাধিকার কর্মী জেলা প্রশাসক ও পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাকে অবহিত করেন। ২৪ আগষ্ট জানানো হয় সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেনকে। ওই বছরের ২৬ ডিসেম্বর থানায় সাধারণ ডায়েরী করতে গেলে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফিরোজ হোসেন মোল্লা তা গ্রহণ করেননি। কোন উপায় না দেখে ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন রেশমা।

২১ জানুয়ারি আইন ও শালিস কেন্দ্রের তদন্তকারি টিমের সদস্য অনির্বান সাহা, মাহাবুবর রহমান, মানবাধিকার কর্মী রঘুনাথ খাঁ, মাধব চন্দ্র দত্তসহ কয়েকজন তাদের বাড়িতে যান। পরে তারা থানায় যান। থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফিরোজ হোসেন মোল্লার কাছে জেসমিনের দেওয়া জিডি না নেওয়ার কথা জানতে চাইলে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ফিলিস্তিনি তিন বছরের শিশুকে বোমা হামলা করে মারা হয় যখন তখন কোথায় থাকে আপনাদের মানবাধিকার ? অবশেষে ২০১৭ সালের ২ মার্চ হাইকোর্টে রিট পিটিশন (২৮৩৩/১৭) দাখিল করেন জেসমিন নাহার রেশমা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আটজনকে বিবাদী করা হয়।

আদালতের নির্দেশে ১৯ মার্চ আদালতে উপস্থাপন করা পুলিশ সুপারের ব্যাখ্যায় বলা হয়, নিখোঁজ মোখলেছুর রহমান নিষিদ্ধ সংগঠন ‘আল্লাহ’র দল’ এর সঙ্গে যুক্ত এবং তাকে গ্রেফতার করা হয় নাই। ১৯ মার্চ শুনানী শেষে আদালত ডাঃ জনিকে ১২ এপ্রিলের মধ্যে বিচারিক আদালতে হাজির করানোর নির্দেশ দেন। একই সাথে ৯ মে এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ঢাকা লিগ্যাল সেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এএসএম জাভিদ হাসানকে নির্দেশ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ি একরামুল হাবিব সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন পিপিএমসহ ১০জন পুলিশ সদস্য ও পাঁচজন সাধারণ মানুষের জবানবন্দি নিয়ে মোখলেছুর রহমান জনিকে ২০১৬ সালের ৪ আগষ্ট পুলিশ আটক করেনি বা তাকে কেউ থানার মধ্যে দেখেনি মর্মে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরে আদালতের নির্দেশে ২০১৭ সালের বছরের ৩ জুলাই সাতক্ষীরার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম হাবিবুল্লাহ মাহমুদ হাইকোর্টে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

প্রতিবেদনে থানা লক আপ থেকে ডাঃ জনির নিখোঁজ হওয়ার সত্যতা পাওয়া গেছে মর্মে প্রতীয়মান হয়। পরবর্তীতে এক আদেশে ওই বছরের ৩ অক্টোবরের মধ্যে এ সম্পর্কিত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পিবিআইকে (পুলিশ ব্যুরো ইনভেসটিগেশন) নির্দেশ দেওয়া হয়। পিবিআই তদন্ত প্রতিবেদনে ডাঃ জনিকে থানায় এনে আটক রাখার সত্যতা মেলেনি বলে উল্লেখ করে থানায় জিডি নিয়ে তার তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমদাদুল হক শেখ, ফিরোজ হোসেন মোল্লা ও উপপরিদর্শক হিমেল হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা গ্রহণ করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়। একইসাথে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

২০১৮ সালের পহেলা অক্টোবর উপপরিদর্শক হিমেল হোসেনের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় বিভাগীয় মামলা(০৬/১৮) দায়ের করা হয়। এ ঘটনায় ২০১৮ সালের ১৮ নভেম্বর সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইলতুৎ মিশের কাছে ও ২২ নভেম্বর খুলনার সহকারি পুলিশ সুপার আব্দুল কাদের বেগ এর কাছে জেসমনি নাহার রেশমা, তার শ্বশুর আব্দুর রাশেদ, শ্বাশুড়ি আনোয়ারা খাতুন সাক্ষী দেন। একইভাবে ২৮ নভেম্বর মঙ্গলবার মানবাধিকার কর্মী রঘুনাথ খাঁ ও তিন পুলিশ সদস্যের সাক্ষী গ্রহণ করা হয়।

(আরকে/এসপি/সেপ্টেম্বর ২১, ২০২০)