মশিউর রহমান সুমন: প্রতারক মো. সাহেদ করিমের ঘটনা মিডিয়ায় আসার পর নড়েচড়ে বসেছেন ভিভিআইপি, ভিআইপি অনেকেই।  কারণ তাদের সঙ্গে ছবি ব্যবহার করে প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে এক শ্রেণির মানুষ। সাধারণ মানুষকে প্রলুব্ধ করতে প্রতারকরা নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। প্রতিদিনই এমন ঘটনা সংবাদপত্র, অনলাইন নিউজ পোর্টাল এমনকি ফেসবুকে উঠে আসছে।  এরপরও প্রতারণা বন্ধ হচ্ছে না। এমনই এক প্রতারণা প্রতিষ্ঠান পুষ্পধারা প্রপার্টিজ লিমিটেড।

এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ আলীনুর ইসলাম, ডিরেক্টর অ্যাডভোকেট মো. মনিরুজ্জামান, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা মঈন উদ্দিন খানসহ অন্য কর্মকর্তারা মন্ত্রী, এমপি, বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক, নায়ক-নায়িকাসহ সমাজের বিশিষ্ট শ্রেণির লোকজনের সঙ্গে তোলা ছবি প্রতারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন।
প্রতিষ্ঠানটির অফিসে মন্ত্রী-এমপি ও বিশিষ্টজনদের সঙ্গে এমডি, পরিচালকের ছবি যেমন বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে, তেমনি ফেসবুক পেজে এ সব ছবি পোস্ট করে বিভিন্ন কমেন্টসের মাধ্যমে সাধারণ ক্রেতাকে আকৃষ্ট করে প্রতারণার ফাঁদ পাতছে তারা। অথচ এ প্রতিষ্ঠানটির নেই কোনো সরকারি অনুমোদন। রাজউকের নামমাত্র নিবন্ধন থাকলেও তা হালনাগাদ করা হয়নি। নেই তাদের পরিবেশ ছাড়পত্রও।
অনুমোদনবিহীন পুষ্পধারা প্রপার্টিজ লিমিটেড কীভাবে তাদের প্লট কয়েক হাজার গ্রাহকের কাছে বিক্রি করছে সেটি বড় প্রশ্ন। একইসঙ্গে তারা রাজধানীর মালিবাগে অফিস খুলে নতুন নতুন গ্রাহক তৈরি করছেন। রাজধানীর সেনা কল্যাণ ভবনেও তাদের অফিস রয়েছে। বিদেশিদের টার্গেট করে তারা অফিস খুলেছে মালয়েশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে। তাদের এ অবৈধ কার্যক্রমের পেছনে কোনো সিন্ডিকেট জড়িত কিনা তাও তদন্তের দাবি রাখে।
ঢাকা-মাওয়া রোডে পদ্মা সেতু সংলগ্ন এলাকায় পুষ্পধারার প্লট বিক্রি করা হচ্ছে। এরইমধ্যে তারা শত শত বিঘা জমি বিক্রি করেছে কাগজ-কলমে। কিন্তু কিনেছেন নামমাত্র জমি। জলাধার ভরাট করে চলছে তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম।
অনুসন্ধান করে জানা গেছে, পুষ্পধারা এ ধরনের কার্যক্রম চালানোর কোনো অনুমোদন পায়নি। তাদের নেই কোনো পরিবেশ সার্টিফিকেট। অথচ আরও গ্রাহক বাড়ানোর জন্য প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের নিয়ে বিভিন্ন সময়ে গ্রাহক সমাবেশের আয়োজন করে। বেশির ভাগ সময়ই তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছাকাছি মতিঝিলে কোনো কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠান করে। এর কারণ প্রতিষ্ঠানটির এক পরিচালকের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিশেষ সখ্য। তিনি গ্রাহক সমাবেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের হাজির করেন। এতে সাধারণ গ্রাহক প্রলুবধ হয়ে বিনিয়োগ করে। বিভিন্ন সময়ে এসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক গোলাম মোস্তফা, বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক ইউনুস আলী, মহাব্যবস্থাপক আবদুল কাইয়ুম, বাংলাদেশ ব্যাংকের জিএম ইসহাক আলী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিএম রফিকুল ইসলাম, ডিজিএম বিষ্ণুপদ বিশ্বাস, ডিজিএম সিরাজুল ইসলাম, ডিজিএম আবদুল হালিম, ডিজিএম নেসার আহমেদ ভূঁইয়া, ডিজিএম শিকদার সিদ্দিকুর রহমান প্রমুখ। প্রতারণাকে বিশ্বাসযোগ্য করতেই সুকৌশলে পুষ্পধারা এই কাজটি করে।
গ্রাহক সমাবেশে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা প্লট কিনতে অনুরোধ করেন গ্রাহকদের। সরকারি কর্মকর্তা হয়ে প্রকাশ্যে এরকম করতে পারেন কি না সেটিও ভাবার বিষয়।
এমন এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক গোলাম মোস্তফা যখন বলেন, ‘নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু ঘিরে পুষ্পধারার আবাসন প্রকল্প। আমি নিজেও প্লট কিনেছি। তার এ বক্তব্য খুব সহজেই বিশ্বাস করেন সাধারণ ক্রেতা। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সহজ কিস্তির নামে পুষ্পধারা নিয়মিতভাবে গ্রাহকদের পকেট কেটে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।’
গ্রাহকরা পুষ্পধারার প্লট কিনে তাদের আবাসন সুবিধার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেন, এ কথা পদ্মাসেতুর মতোই বাস্তব। চোখের সামনে যেমন গড়ে উঠছে পদ্মাসেতু, তেমনি পদ্মা এলাকায় গড়ে ওঠা পুষ্পধারা পদ্মাসেতুর অলঙ্কার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে শিগগিরই।- গ্রাহক সমাবেশে এমন চটকদার কথা বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক ইউনুস আলী। এমন বিবেকহীনদেরকে কব্জা করে পুষ্পধারার এমডি আলী নুর তার সম্পদের পাহাড় গড়ছেন। গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকায় আলিশান ফ্ল্যাটে থাকেন পুষ্পধারার সংশ্লিষ্টরা। ব্যবহার করেন কোটি টাকার দামি গাড়ি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্লটের ব্যবসার নামে পদ্মা সেতু সংলগ্ন ঢাকা-মাওয়া সড়কের পাশে পুষ্পধারা প্রপার্টিজ লিমিটেড ভাড়া নেয় অন্যদের জমি। এরপর সেই ভাড়া জমিতে বিশাল সাইনবোর্ডে বিজ্ঞাপন ঝুলিয়ে সাধারণ মানুষকে বোকা বানায়। মানুষ বিশিষ্টজনদের গুণকীর্তন ও সাইনবোর্ডের বাহার দেখে পরিশ্রমের টাকা বিনিয়োগ করছে। কয়েক হাজার গ্রাহকের কাছে প্লট বিক্রি করলেও পুষ্পধারার নিজের প্লট নামেমাত্র।
শ্রীনগর ভুমি অফিসের মৌজাধীন এলাকায় মহাজালিয়াত এ প্রতিষ্ঠানটির নামে কেনা এ জমিটুকুই আসল। সরকারি বিধি মেনে এ জমিতে প্লট হতে পারে ৫-৭টি! অথচ ভাড়া জমির কয়েক হাজার প্লট বিক্রি করে ফেলেছে পুষ্পধারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুষ্পধারা প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজধানী ঢাকা শহরের নামিদামি কমিউনিটি সেন্টার, ভিআইপি লাউঞ্জ ভাড়া নিয়ে জমকালো গ্রাহক মেলার আয়োজন করে কিস্তিতে শত শত প্লট বুকিং করেছে। অথচ করে প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হবে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
এ বিষয়ে দৈনিক বাংলা ৭১ এর পক্ষ থেকে কথা বলা হয় প্রতিষ্ঠানটি জি এম আবু বকর সিদ্দিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কোনো গ্রাহক আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন এরকম নজির নেই। আমরা নিয়ম-কানুন মেনে ব্যবসা করছি। যে সব কাগজের মেয়াদ শেষ হয়েছে সেগুলো হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।’
আপনাদের পরিবেশ ছাড়পত্র নেই জানালে তিনি বলেন, ‘পরিবেশ ছাড়পত্র পেতে সময় লাগবে। সেটি পাওয়ার জন্য কিছু ফরমালিটিজ আছে। তবে ব্যবসা চালাতে অসুবিধা নেই।’
প্রতিষ্ঠানের জি এম এর কাছে এমডি সৈয়দ আলীনুরের সঙ্গে কথা বলতে মোবাইল নম্বর চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনারা অফিসে এসে কথা বলুন। নম্বর দেওয়া যাবে না।’
এ দিকে পুষ্পধারার পরিচালক মো. মনিরুজ্জামানকে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

(এমআরএস/পিএস/২২ সেপ্টেম্বর, ২০২০)