শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর : দিনাজপুরে বনাঞ্চল গিলে খাচ্ছে,করাত কল। বিপন্ন হচ্ছে, পরিবেশ। জেলায় ৪ শতাধিক করাত কলের মধ্যে ১২০টি’র লাইসেন্স রয়েছে। বাকি পৌনে ৪ শতাধিক করাত কল চলছে, অবৈধ ভাবে। করাত কলের উপর আরোপিত সরকারি নিদের্শনা প্রয়োগ না হওয়ার একদিকে যেমন সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে উজার হচ্ছে বনাঞ্চল, বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি নীতিমালা উপেক্ষা করে যত্রতত্র গড়ে ওঠায় বায়ু ও শব্দদূষণ বাড়াচ্ছে করাত কল। এতে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে। এ নিয়ে বৈধ করাত কল কর্তৃপক্ষরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

দিনাজপুর সামাজিক বন বিভাগের হিসেবেই জেলায় করাত কলের সংখ্যা ৩শ’ ৫৩টি। এর মধ্যে অনুমোদিত মাত্র ১শ’২০টি। সরকারি হিসাবেই অনুমোদন নেই এমন করাত কলের সংখ্যা ২শ’ ৩৩টি। তবে বাস্তবে জেলায় করাত কলের সংখ্যা প্রায় ৪শ’। জেলার সামাজিক ও সংরিক্ষত বন থেকে চোরাই পথে আনা বিভিন্ন বয়সের গাছ অবাধে চেড়াই ও বিক্রি হচ্ছে এসব করাত কলে।

লাইসেন্স না নিয়ে অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বৈধ করাত কল মালিকরা। সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত করাত কল চালানোর নিয়ম থাকলেও রাতদিন চলছে কাঠ চেড়াই।

সরকারি বিধিমালা অমান্য করে আবাসিক এলাকা, হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে গড়ে উঠায় জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশকে হুমকিতে ফেলছে করাত কলের শব্দ ও বায়ুদূষণ। এমনটাই অভিযোগ, বিশিষ্ট আইনজীবী এ্যাডভোকেট সলিমুল্লাহ সেলিম,নাট্যকর্মী তুষার,ইউপি চেয়ারম্যান ফারুক আযমসহ অনেকের।

দিনাজপুরে সরকারি বনাঞ্চলের গাছ পাচারে যুক্ত বন বিভাগের এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। তাদের যোগসাজশেই সংরক্ষিত বনের কাছে গড়ে উঠেছে অবৈধ করাত কল। উচ্ছেদ অভিযানে থামানো যাচ্ছে না স্থানীয় প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের অবৈধ কাঠের ব্যবসা। কাঠ পাচারের পথ সহজ করতে নীতিমালা উপেক্ষা করে সংরক্ষিত বনের কাছে অবৈধ করাত কল গড়ে তুলেছেন প্রভাবশালীরা। ছোট-বড় গাছ নিমিষেই কাঠে পরিণত হয়ে চলে যাচ্ছে সারাদেশে। বিপন্ন হচ্ছে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জের আশুরা,ভাদুরিয়া,আফতাবগঞ্জ, বিরামপুর রেঞ্জ, চরকাই রেঞ্জ, পার্বতীপুরের মধ্যপাড়া, বিরলের ধর্মপুর বিট, বীরগঞ্জের শিংড়া ও শালবনের মতো সংরক্ষিত বনাঞ্চল।

জেলার বনাঞ্চল বিপন্ন হওয়ার পেছনে বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে অবৈধ করাত কল মালিকদের যোগসাজসের অভিযোগ রয়েছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও প্রত্যন্ত এলাকায় রাস্তার দু’ধার থেকে বিভন্ন ধরনের গাছ উধাও হয়ে যাচ্ছে। ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে গাছ পাচার সিন্ডিকেটের কঠোর শাস্তি ও অবৈধ করাত কল উচ্ছেদের দাবি জানিয়েছেন পরিবেশকর্মীরা।

দিনাজপুর নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি ও পরিবেশবাদী আজাদ আবুল কালাম, পরিবেশকর্মী ও সংগঠক মুকিদ হায়দার,উদ্ভিদবিদ ও সমাজকর্মী মোসাদ্দেক হোসেন এবং বিরল প্রেক্লাবের সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস জানান, করাত কল বিধিমালা ২০১২ তে বলা আছে, কোন সরকারি অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বিনোদন পার্ক, উদ্যান এবং জনস্বাস্থ্য বা পরিবেশের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে এমন স্থান থেকে কমপক্ষে ২০০ মিটার এবং সরকারি বন ভূমির সীমানা হতে কমপক্ষে ১০কিলোমিটারের মধ্যে করাত কল স্থাপন করা যাবে না। কিন্তু এই নিদের্শনা মানছেনা কেউ। বিধিবর্হিভুতভাবে যত্রতত্র বসানো হয়েছে করাত কল । এর ফলে প্রতিনিয়ত শব্দ দূষণের শিকার শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ।

বিশিষ্টজনেরা বলেন,শহরের রাস্তাগুলোর দু’পাশ দখল করে করাত কল ব্যবসা পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে।শহরের করাত কলগুলোতে প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে গাছ এনে রাস্তার দু’পাশ দখল করে স্তুপ করে রাখে। তাছাড়া ট্রাক ও ট্রলি করাত কলেন সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা থামিয়ে মাল উঠা নামা করায় ও দু’পাশে গাছ রাখায় যানবাহন আটকে চরম ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ।দিনাজপুরে কিছু অসাদু প্রভাবশালী ব্যক্তি পরিচালনা করছে এসব লাইসেন্স বিহীন অবৈধ করাত কল। বনাঞ্চলের কাছে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব করাত কলে দিনরাত কাঠ চিরাই চলছে। এছাড়াও এসব করাত কলের আশপাশে মজুত রয়েছে প্রায় কয়েক লাখ ঘনফুট গাছ।

প্রকৃতি পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলাছ যত্রতত্র করাতকল স্থাপনে নিরুৎসাহিত করা,বনের পাশে করাত কল স্থাপন নিষিদ্ধ করার বিধিমালা করা তা মানা হচ্ছে না বলে সত্যতা স্বীকার করলে দিনাজপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক মো. মিজানুর রহমান। তিনি জানান,করাতকল মালিকরা যে কোনো বয়সের গাছ কেটে বন উজাড় করছে। প্রতিটি করাত কলে বিপুল সংখ্যক কাঠ মজুদ রয়েছে। সরকারি নিয়মে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত করাত কল চালানোর নিয়ম থাকলেও অবৈধ করাতকলের মালিকরা তা মানছেনা। রাতদিন চলছে কাঠ চিরাই।

দিনাজপুর সামাজিক বন বিভাগ কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছেন,অবৈধ করাত কলের দাপটের কথা। তবে অবৈধ করাত কলগুলো উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন দিনাজপুর সামাজিক বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আবদুর রহমান।

তিনি বলেন, অবৈধ করাত কলের তালিকা করে আমরা ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসক বরাবরে দিয়েছি। এগুলো পর্যায়ক্রমে উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি উচ্ছেদ করাসহ জরিমানাও করা হয়েছে।

তবে, অভিযোগ রয়েছে, করাত কলের মালিকরা বন বিভাগের কতিপয় দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই পরিচালনা করছেন এসব অবৈধ করাত কল। এতে উজার হচ্ছে, বনাঞ্চল, বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ।

সরজমিনে দেখা গেছ, যেখানে সেখানে গড়ে তোলা এসব করাত কলের কড়াল গ্রাসে শুধু বনাঞ্চলেই উজার হচ্ছে না,বিনষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। তাই, বনাঞ্চল ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়, শুধু কাগজ-কলমে নয়, বাস্তবে নীতি-মালার আলোকে এসব করাত কল স্থাপন এবং অবৈধ করাত কলগুলো উচ্ছেদের দাবী জানিয়েছে, পরিবেশবিদ ও প্রকৃতি প্রেমিরা।

(এস/এসপি/সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২০)