রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার দারুল উলুম চৌমুহুনী ফাজিল মাদ্রাসার চাকুরির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া অধ্যক্ষ কাদির হেলালীকে কর্মস্থানে যোগদান, তার বেতন ভাতা প্রদান ও কাদির হেলালীর অনুকূলে দেওয়া বিাবদীদের বিরুদ্ধে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত সাতক্ষীরার যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ ২য় আদালতের বিচারক ফারুক ইকবালের গত ২৪ ফেব্রুয়ারির  আদেশ কেন স্থগিত করা হবে না তা জানতে চেয়ে হাইকোর্টের রুল জারি করা হয়েছে। গত ২০ সেপ্টেম্বর মহামান্য হাইকোর্টের বিচারপতি মামুনুর রহমান ও বিচারপতি খিজির হায়াত এর  যৌথ বেঞ্জ এ রুল জারি করে নোটিশ প্রাপ্তির দু’ সপ্তাহের মধ্যে জবাব দেওয়ার নির্দেশ দেন।

দারুল উলুম চৌমুহুনী ফাজিল মাদ্রাসা সূত্রে জানা যায়, মাওলানা আব্দুল কাদির হেলালী ১৯৬৪ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর জন্ম তারিখ উল্লেখ করে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের বিধিমালা বহির্ভুতভাবে সাড়ে নয় বছরে দাখিল পাশ দেখিয়ে ১৯৮০ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর নাবালক অবস্থায় গান্দুলিয়া দাখিল মাদ্রাসায় সুপারইনটেনডেন্ট পদে যোগদান করেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিধিতে মাদ্রাসা অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদানের জন্য যে অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার কথা বলা আছে তা লঙ্ঘন করে তিনি ১৯৯০ সালে দারুল উলুম চৌমুহুনী ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন।

সূত্রটি আরো জানায় আব্দুল কাদির হেলালী ২০১২ সালের ফতেপুরের নাশকতা, ২০১৩ সালে বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মোসলেম আলী হত্যা মামলা এজাহার ও চার্জশীট ভুক্তসহ কমপক্ষে একডজনর মামলার আসামী।। ২০১৮ সালের ২৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে সাতটায় নাশকতার পরিকল্পানাকারি হিসেবে উপপরিদর্শক সুধাংশু শেখর হালদার তাকে মুকুন্দ মধুসুধনপুর চৌমুহুনী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে জেল হাজতে পাঠান। অথচ আব্দুল কাদির হেলালীর চাকুরিতে বহাল হওয়া সংক্রান্ত এক আবেদনের প্রেক্ষিতে জেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুল্লাহ আল মামুন ২০১৮ সালের ২৬ জুলাই কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের মহাপরিচালকের কাছে যে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন তাতে ২০১৮ সালের ২৩ এপ্রিল মাদ্রাসায় হাজির হওয়ার আড়াই ঘণ্টার মধ্যে মাদ্রাসা থেকে হেলালীকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে উল্লেখ করেছেন।

যা’ আইনের পরিপন্থি। গত ২২ মার্চ ওই শিক্ষা কর্মকর্তা কাদির হেলালীকে তার কর্মস্থলে জিবি কমিটির সদস্যরা যোগদান করতে দেয় নাুই মর্মে আদালতে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন। এ ছাড়া গত ১৩ সেপ্টেম্বর সহকাাির কমিশনার (শিক্ষা) উম্মে মুসলেমার এক নির্দেশনা অনুযায়ি ওই শিক্ষা অফিসার পরদিন জেলা প্রশাসক বরাবর এক প্রতিবেদন দাখিল করেন। তাতে জিবি কমিটির সদস্যরা আদালতের আইন মানছেন না ও ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সাম্প্রতিক আদেশ গোপন করে ২০১৭ সালের জিবি কমিটির মেয়াদ শেষ ও পরবর্তী নির্দেশনা সম্পর্কিত একটি আদেশ উল্লেখ করেন।

কাদির হেলালীর দারা বিশেষ সুবিধা প্রাপ্ত হয়ে জেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুল্লাহ আল মামুন পুলিশ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে ও জিবি কমিটি আদালতের আদেশ মানছেন না মর্মে জেলা প্রশাসক বরবার যে প্রতিবেদন দাখিল করেন তার যথাযথ তদন্তের জন্য কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা মন্ত্রির কাছে অভিযোগ করেন জিবি কমিটির সভাপতি নূরুল হক।
এদিকে আব্দুল কাদির হেলালী তাকে বরখাস্ত করাকে অবৈধ, অধ্যক্ষের চলমান দায়িত্বে থাকা মনিরুজ্জামান অবৈধ, যোগদান করার পর সমুদয় বেতন ভাতা প্রদান ও কর্মস্থলে শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করার সুবিধার্থে জিবি কমিটির ১২জন সদস্যেকে বিবাদী করে গত ১৫ জানুয়ারি সাতক্ষীরার যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ ২য় আদালতে দেওয়ানী টিএস-৪/২০ নং মামলা করেন।

বিবাদী পক্ষ আদালতে যথাসময়ে হাজির হয়ে জবাব দাখিল করেন। গত ২৪ ফেব্র“য়ারি সাতক্ষীরার যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ -২য় আদালতের বিচারক ফারুক ইকবাল এক আদেশে টিএস ৪/২০ মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ১৫ মার্চের মধ্যে বাদি কাদির হেলালীকে তার পদে যোগদান করে নিয়মিত হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করার সূযোগ দিতে বিবাদী পক্ষকে নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি যোগদানের পর থেকে বাদি সম্পূর্ণ বেতন ভাতা পাবেন বলে উল্লেখ করেন। বিবাদী পক্ষ আদালতের আদেশ প্রতিপালন করছেন কিনা সে বিষয়ে জেলা শিক্ষা অফিসারকে ২৫ মার্চের মধ্যে আদালতে লিখিত প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেন। একই সাথে বাদি পক্ষের অনুকুলে অস্থায়ী নিষেজ্ঞার আদেশ দেন।

২৩ জুনের ১০ নং আদেশের একাংশে উল্লেখ করেন যে,২২ মার্চ শিক্ষা অফিসার বাদিকে বিবাদীপক্ষ কর্মস্থলে যোগদান করতে দেন নাই বলে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। ২৪ ফেব্র“য়ারির আদেশের বিরুদ্ধে বিবাদীপক্ষ মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে গত ২৩ মার্চ মিস আপীল ২৬৫/২০২০ দাখিল করেন। মহামান্য হাইকোর্ট ২৩ জুন পর্যন্ত কোন স্থগিতাদেশ না দেওয়ায় আদালতের আদেশ প্রতিপালন না করায় বিবাদীদের বিরুদ্ধে কেন পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তা জানাতে আদেশ প্রাপ্তির ১০ দিনের মধ্যে কারণ দর্শাতে বলা হয়।

এদিকে অধ্যক্ষ হিসেবে হেলালীর যোগদান ও বকেয়া সমুদয় বেতন ভাতা প্রাপ্তি নিয়ে গত ৩০ জুলাই নুরুল হক সাতক্ষীরার যুগ্ম জেলা জজ -২ এর আদালতে দেঃ ৬৭/২০২০ মামলা করেন। বিচারক ফারুক ইকবাল গত ১৬ আগষ্টের আদেশে একাংশে উল্লেখ করেছেন যে, ১৯৬৪ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর জন্ম তারিখ হলেও ১৯৭৪ সালে দাখিল পাশ, ১৯৮০ সালের ৫ অক্টোবর সাবালক না হয়েও গান্দুলিয়া মাদ্রাসায় প্রভাষক হিসেবে যোগদান, ১০ বছরের অভিজ্ঞতা হওয়ার পূবেই চৌমুহুনী দারুল উলুম ফাজিল মাদ্রসায় অধ্যক্ষ পদে যোগদান করায় কাদির হেলালীর চাকুরিতে বহাল বেআইনি মর্মে ঘোষণা চেয়ে মামলা করেছেন।

বিচারক তার আদেশে উল্লেখ করেছেন যে কাদির হেলালীর সার্টিফিকেট তঞ্চকতা মতে সংগ্রহ করে অথবা সাবালক হওয়ার আগেই চাকুরিতে যোগদান করে এ সংক্রান্ত বিষয়ে কোন অনিয়ম হয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার ম্যানেজিং কমিটির রয়েছে।

এদিকে সাতক্ষীরা জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাড. শাহাদাত হোসেন বলেন যে, টিএস ৪/২০২০ মামলায় বিবাদীপক্ষ আদালতের আদেশ প্রতিপালন না করার অপরাধে বাদি আদালতে ভাইয়োলেশন মামলা দাখিল করতে পারতেন। তিনি তা করেন নি। উপরন্তু বাদির আবেদন ও জেলা শিক্ষা অফিসারের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আদালত বিবাদীদের একাংশের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিয়েছেন। গত ৬ আগষ্ট বাদিপক্ষের আইনজীবী অ্যাড. আজিজুর রহমান বিবাদীপক্ষের ২৩ মার্চের দরখাস্তসহ মহামান্য হাইকোর্টের আইনজীবী বিভাস চন্দ্র বিশ্বাসের প্যাডে লেখা ২৪ ফেব্রুয়ারির আদেশের বিরুদ্ধে মিস আপিল ২৬৫/২০২০ মোকদ্দমা সম্পর্কিত অবহিতকরণ চিঠিটি ভুয়া বলে উল্লেখ করেছেন।

একই সাথে বাদিপক্ষের ২৬ জুলাই একই সার্চিং প্রতিবেদন জমা দিয়ে ২৬৫/২০২০ মিস আপিলের অস্তিত্ব নাই বলে দরখাস্তে উল্লেখ করেছেন যা’ ন্যয় বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে চরম মিথ্যাচারের সামিল। অপরদিকে সাতক্ষীরার যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ ২য় আদালতের ২৪ ফেব্রুয়ারির আদেশে সংক্ষুব্ধ হয়ে বিবাদী পক্ষ মহামান্য হাইকোর্টে মিস আপীল ২৬৫/২০২০ দাখিল করেন। কভিড-১৯ এর পরিস্থিতির কারণে শুনানী করতে পারেননি আপিলকারী পক্ষের আইনজীবী বিভাস চন্দ্র বিশ্বাস।

বিষয়টি তারা এক দরখাস্তের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর প্যাডে যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ ২য় আদালতকে অবহিত করেন। সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টের আইনজীবীর প্যাডে চিঠি লিখে সংশ্লিষ্ট নিম্ন আদালতকে অবহিত করার পর নিম্ন আদালতে ওই মামলার কার্যক্রম স্থগিত রাখার সুস্পষ্ট বিধান থাকলেও টিএস-৪/২০২০ মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়নি। হাইকোর্টের মিস আপিল ২৬৫/২০২০ দাখিল মেনে নিয়ে নিম্ম আদালতের বিচার কার্যক্রম স্থগিত না রেখে স্থগিতাদেশ না থাকার গ্রাউন্ড দেখিয়ে বিবাদীপক্ষের বিরুদ্ধে আদালতের আদেশ প্রতিপালন না করার অভিযোগে টিএস-৪/২০২০ মামলায় বিবাদীদের গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করানোর জন্য নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে দারুল উলুম চৌমুহুনী ফাজিল মাদ্রাসা পরিচালনা পরিষদের সভাপতি নুরুল হক বলেন, শিক্ষক কর্মচারিদের আগষ্ট মাসের বেতন সংক্রান্ত কাদির হেলালীর আপত্তি ও সহকারি কমিশনার উম্মে মুসলেমার এক নির্দেশনা অনুযায়ি ১৪ সেপ্টেম্বরের জেলা শিক্ষা অফিসারের তদন্ত প্রতিবেন পূর্ণবিবেচনার জন্য তিনি গত ১৫ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসক বরাবর এাক আবেদন করেন।

পরবর্তীতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মহোদয় এক জরুরী সভা করে জিবি কমিটির এক সহসভাপতিকে সভাপতি ও কাদির হেলালীকে অধ্যক্ষ করে একটি অসম্পূর্ণ কমিটি গঠণ করে কাদির হেলালীর সমুদয় বেতন ভাতা ও শিক্ষক কর্মচারিদের বেতন ভাতা তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন বলে দায়িত্বশীল সূত্রে জানতে পেরেছেন। অপরদিকে ২০ সেপ্টেম্বর মহামান্য হাইকোর্টের বিচারপতি মামুনুর রহমান ও বিচারপতি খিজির হায়াত এর যৌথ বেঞ্চ গত ২৪ ফেব্র“য়ারির সাতক্ষীরার যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে রুল জারি করেছেন। আদেশের সত্যয়াতি কপি না পাওয়ায় নিম্ন আদালত বিবাদীদের বিরুদ্ধে বিরাগভাজন হওয়ায় তারা তাদের আইনজীবীর মাধ্যমে মিস আপিল মামলার আদেশ আইনজীবী সার্টিফিকেট সংশ্লিষ্ট আদালতে ২১ সেপ্টেম্বর বা পরবর্তীতে জমা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।

(আরকে/এসপি/সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২০)