আন্তর্জাতিক ডেস্ক : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) পছন্দ করেন না, সেটা গোপন কিছু নয়। গত চার বছর তিনি সবসময়ই ব্রেক্সিটের পক্ষে কথা বলেছেন; দাবি করেছেন, ইইউ গঠিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফায়দা নেয়ার জন্যই। সুতরাং ইউরোপীয় দেশগুলোতে ট্রাম্পের নিয়োগ দেয়া রাষ্ট্রদূতরা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে কিছু করলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

চলতি সপ্তাহেই দেখা গেছে, নেদারল্যান্ডসে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিট হোকস্ট্রা দূতাবাসের মধ্যেই ফোরাম ফর ডেমোক্র্যাসি (এফভিডি) নামে স্থানীয় একটি রাজনৈতিক দলকে নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে উগ্র ডানপন্থী, অভিবাসন ও ইইউ-বিরোধী দলটি নেদারল্যান্ডসে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। একটি ডাচ সাময়িকী দাবি করেছে, এফভিডির জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই মূলত মার্কিন দূতাবাসে ওই অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছিল।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক মুখপাত্র অবশ্য বলেছেন, নেদারল্যান্ডসে ওই অনুষ্ঠানটি ছিল টাউন হল আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর সভা। তাদের দাবি, হোকস্ট্রা আগেও আটটি ভিন্ন দলের সঙ্গে এ ধরনের ১৫টি টাউন হল সভার আয়োজন করেছেন। অর্থাৎ, এফভিডির সঙ্গে অনুষ্ঠান তাদের জন্য অস্বাভাবিক কিছু নয়।

তবে মার্কিন প্রশাসনের এ দাবির সঙ্গে একমত নন অনেকেই। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য এবং স্ট্যানফোর্ড সাইবার পলিসি সেন্টারের আন্তর্জাতিক নীতি বিয়ষক পরিচালক মারিয়েতে শাকে বলেন, ‘তহবিল সংগ্রহ হোক বা না হোক, একটি রাজনৈতিক দলের অনুষ্ঠান আয়োজনকে আপনি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সমর্থন হিসেবে দেখতে পারেন। সাধারণত, কূটনীতি হচ্ছে সরকারের সঙ্গে সরকারের মিথস্ক্রিয়া, নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার এবং রাজনৈতিকভাবে জোটবদ্ধ হওয়ার ধারণা দেয়া নয়।’

তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসন আগেও দেখিয়েছে, আবারও দেখাচ্ছে, তাদের মিত্ররা নাইজেল ফ্যারাগে (ব্রেক্সিটপন্থী ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ) ও এফভিডির মতো ইউরোপীয় শক্তির বিরোধী।’

যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত উডি জনসনের নামেও রয়েছে অভিযোগ। তিনি নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে ট্রাম্পের মালিকানাধীন কোনও একটি কোর্টে ব্রিটিশ ওপেন গলফ টুর্নামেন্ট আয়োজনের চেষ্টা করেছেন, এমন অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে।

তবে তদন্তে দোষ প্রমাণের আগেই এ প্রচেষ্টার কথা গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করে নিয়েছেন জনসন। যদিও, ট্রাম্প বলেছেন, তিনি এ রাষ্ট্রদূতকে কখনোই এমন কিছু করার জন্য বলেননি। তাছাড়া, যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত এ মার্কিন রাষ্ট্রদূত সরাসরি ব্রেক্সিটের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তার মতে, ব্রেক্সিটের ফলে যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে।

প্রায় একই চিত্র দেখা গেছে জার্মানিতেও। সেখানকার সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত রিচার্ড গ্রেনেল এমন কাজ করেছেন যা সাধারণত কূটনীতিকদের করা মানায় না। যেমন- তিনি টুইট করেছেন, ‘ইরানে ব্যবসা করা জার্মান প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত তাৎক্ষণিকভাবে কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া।’

ইরানের বিরুদ্ধে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পদক্ষেপগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য এমনিতেই গলধঃকরণ কঠিন। ইইউ’র পৃষ্ঠপোষকতায় ইরানের সঙ্গে হওয়া পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহার করিয়েছেন ট্রাম্প, যেটা মোটেও ভালো চোখে দেখেনি ইউরোপীয় দেশগুলো।

আবার, ডানপন্থী সংবাদমাধ্যম ব্রেইটবার্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে গ্রেনেল খোলামেলাই বলেছেন, তিনি ইউরোপজুড়ে রক্ষণশীলদের ক্ষমতায় দেখতে চান। কোনও দেশে যে ধরনের সরকারই ক্ষমতায় থাক না কেন, তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রদূতের। সেখানে সরাসরি একটি পক্ষকে সমর্থন জানানো সাধারণত কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত।

শুধু রাষ্ট্রদূতদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডই নয়, ট্রাম্পের শাসনামলে ইউরোপীয় ঐক্যের বিরোধিতা করা নেতাদের সঙ্গেও সম্পর্ক বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি গত এক দশক ধরে নিজ দেশের আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, গণমাধ্যমের ওপর প্রভাব বিস্তার করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। হাঙ্গেরিয়ান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের তদন্ত করছে ইইউ।

এরপরও গত বছর অরবান যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলে তার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘অরবান বিভিন্ন উপায়ে অনেক ভালো কাজ করছেন। তিনি ইউরোপজুড়ে খুবই সম্মানিত। সম্ভবত আমার মতো কিছুটা বিতর্কিত। তবে, সেটা ঠিকই আছে।’

এসব বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাবেক এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘ইইউ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কী আর আছে? সরকারের রাজনৈতিক রেখায় পার্থক্য যা-ই হোক না কেন, সেটি আমাদের একত্রিত করবে। কিন্তু এখন যদি ঠিকভাবে দেখেন, তাহলে শুধু বিভাজনই দেখা যাবে।’

তিনি বলেন, ‘ট্রাম্পের অধীনে দেখা যাচ্ছে, তারা (যুক্তরাষ্ট্র) ইইউর ক্ষতি করার চেষ্টা কখনো হাতছাড়া করে না। যৌথ স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে তারা কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আগে আমাদের সঙ্গে কখনও পরামর্শ করে না; যেমন- ইরানের বিষয়, জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস সরানো। এখন একটা চিন্তাই বাড়ছে, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আর আগের মতো ভরসা করতে পারব না।’ সিএনএন।

(ওএস/এসপি/সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২০)