রঞ্জন কৃষ্ণ পন্ডিত, টাঙ্গাইল : বঙ্গবন্ধুসেতুর পূর্বপাড়ের গাইড বাঁধের পুনঃনির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার দুই সপ্তাহের মাথায় ফের যমুনার ভাঙন শুরু হয়েছে। শনিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে আটটার দিকে পুনঃনির্মিত বাঁধটির মধ্যবর্তী অংশে ভাঙন দেখা দেয়। অল্প সময়ের মধ্যে ১৫০ মিটার বাঁধ ও বাঁধের অভ্যন্তরে থাকা পাকা দালানসহ তিনটি বাড়ি যমুনার পেটে চলে যায়। এর আগেও চলতি বছরের জুলাই মাসের শুরুতে ভাঙনের কবলে পড়ে বাঁধটির শেষ প্রান্তের ৫০ মিটার অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়। এ সময় ২৭টি বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।  

বঙ্গবন্ধুসেতুর পূর্বপাড়ে কালিহাতী উপজেলার গড়িলাবাড়ী এলাকায় ভাঙনরোধে গাইডবাঁধ নির্মাণে বাসেক ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অদক্ষ প্রকৌলশীদের কারণে সরকারের সাড়ে ৩৩ কোটি টাকার প্রকল্প ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ফলে ওই এলাকায় আরও ভাঙনের আশঙ্কা প্রবলতর হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধুসেতুর পূর্বপাড়ে গড়িলাবাড়ীতে প্রতিবছর যমুনার ভাঙনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। এতে দেশের বৃহত্তর স্থাপনা হুমকিতে পড়ায় বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বাসেক/বিবিএ) সেতুর দুই কিলোমিটারের মধ্যে চেইনেজ ৪৫মিটার থেকে চেইনেজ ৫০০মিটার এলাকায় গাইডবাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। সে লক্ষে বাসেক প্রাক্কলন প্রস্তুত পূর্বক ২০১৯ সালের ৭ এপ্রিল দরপত্র আহ্বান করে। দরপত্রে ঠিকাদারের যোগ্যতায় একক কার্যাদেশে ২৪ কোটি টাকার কাজ করার অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। এতে হাতেগোনা কয়েকটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ গ্রহন করার সুযোগ পায়। অথচ একক কার্যাদেশে ২০-২২ কোটি টাকার কাজ করার অভিজ্ঞতা চাইলে শতাধিক যোগ্যতা সম্পন্ন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ গ্রহন করার সুযোগ পেত। এতে যোগ্য ঠিকাদার নির্ণয়ের সুযোগ থাকার পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় বেশি ও যথাসময়ে কাজ সম্পন্ন হত।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বঙ্গবন্ধুসেতুর পূর্ব পাড়ে দক্ষিণ দিকে নিউ ধলেশ্বরী নদীর মুখ থেকে উত্তর অর্থাৎ যমুনা নদীর বাম তীরে স্থায়ী প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বাসেকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী(সড়ক ও সেতু) মো. লিয়াকত আলীকে আহ্বায়ক এবং ঢাকাস্থ বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের পূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম ও বাসেকের তৎকালীন সহকারী প্রকৌশলী(সড়ক) মো. ওয়াসিম আলীকে সদস্য করে একটি প্রাক্কলন কমিটি গঠন করা হয়।

প্রাক্কলন কমিটি সরেজমিন পরিদর্শন করে বাসেকের নদী শাসন কাজের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইনষ্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং(আইডব্লিউএম) ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক প্রদত্ত ডিজাইন মোতাবেক উল্লেখিত এলাকায় ৪৫৫মিটার দৈর্ঘ্যে স্থায়ী প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহন কাজের ৩৭ কোটি ২২ লাখ ৯৫ হাজার ৩১৫.৮৬ টাকার প্রাক্কলন তৈরি করেন।
বাসেক দরপত্রে অংশ নেয়া ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যৌথ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান রানা বিল্ডার্স(প্রা.) লিমিটেড ও মেসার্স শহীদ ব্রাদার্সকে ৩৩ কোটি ৫০ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৪ টাকায় কাজটি ১২ মাসে সম্পন্ন করার নিমিত্তে ২০১৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কার্যাদেশ প্রদান করে।

কার্যাদেশ পেলেও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান গড়িলাবাড়ী এলাকায় যথাসময়ে কাজ শুরু না করে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর ওই এলাকায় ভেকু নামিয়ে তীরে মাটির কাজ শুরু করে। ১৯-২০দিন ভেকু দিয়ে নদীতীর লেভেল করতে গিয়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতার কারণে পূর্বের ডাম্পিং করা পুরনো বালুভর্তি জিওব্যাগ-পাথরসহ শক্তমাটি আলগা করে ফেলে। ফলে ২০১৯ সালের ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর অসময়ে যমুনার ভাঙনে ৫টি পাকা বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয় এবং আরো ১০টি বাড়ি ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দেয়। পরে তড়িঘড়ি করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নদীতীর রক্ষার জন্য ব্লক ফেলতে শুরু করে। নদীতে পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করায় দ্রুত ব্লক ও জিওব্যাগ ফেলে নামকাওয়াস্তে কাজ শেষ করার চেষ্টা চালায়। এরইমধ্যে চলতি বছরের জুলাই মাসের শুরুতে ভাঙনের কবলে পড়ে বাঁধটির শেষ প্রান্তের ৫০ মিটার অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়। সে সময় ভাঙনের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দায়ী করা হলেও ওই এলাকায় পাউবো’র কোন প্রকল্পই ছিলনা। যমুনার ভাঙন অব্যাহত থাকায় হুমকির মুখে পড়েছে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা(কেপিআই) বঙ্গবন্ধুসেতু সহ আশেপাশের বেশ কয়েকটি গ্রাম।

যমুনা পাড়ের গড়িলাবাড়ী এলাকার আ. ছালাম, ইয়াজউদ্দিন, সুলতান, লাল মিয়া সহ অনেকেই জানান, নদীতীরে ডাম্পিং না করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জিওব্যাগ ফেলে সিসি ব্লক বসিয়ে কোন রকমে কাজ শেষ করেছে। ফলে যমুনার স্রোতে বার বার গাইড বাঁধ ভেঙে বাড়িঘর নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে। তারা জোর দিয়ে জানান, প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন প্রকৌশলী রাখা হয়নি বলে তারা শুনেছেন। পাউবো’র প্রকৌশলী পরামর্শক হিসেবে নিয়ে গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হলে টেকসই হত বলে তারা মনে করেন।

প্রকল্প বাস্তবায়নে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে কাজ না করায় বার বার ওই এলাকার মানুষ যমুনার ভাঙনে বাড়িঘর হারিয়ে ভূমিহীন হয়ে পড়ছে। কাজ শেষ হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে গাইড বাঁধ ভেঙে নদীতে বিলীন হওয়ায় প্রকল্পের টাকা যমুনা গিলে খাচ্ছে।

ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রতিনিধি মো. মুক্তার আলী জানান, তারা যথাযথভাবে সিডিউল মোতাবেক কাজ শেষ করেছেন। যমুনার আকস্মিক স্রোতের তীব্রতা যেকোন স্থাপনাই ধংস করে দিতে পারে। গাইড বাঁধে ভাঙন তারই অংশ- এটা এক ধরণের দুর্ঘটনা।

বাসেক’র বঙ্গবন্ধুসেতু সাইট অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী এহসানুল কবীর পাভেল জানান, যমুনা নদীর ভাঙন থেকে বঙ্গবন্ধুসেতু রক্ষার্থে ২০০৪ সালে সেতুর পূর্ব পাড়ের দক্ষিণ পাশে কার্পেটিং ও সিসি ব্লকের মাধ্যমে গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হয়। তবে দীর্ঘদিন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ২০১৭ সালে প্রমত্ত্বা যমুনার আঘাতে ভাঙন দেখা দেয়। সে সময় বাঁধ ও বাঁধের অভ্যন্তরের কয়েকশ’ বসতভিটা যমুনা গ্রাস করে নেয়। পরে বাসেক পুনঃবাঁধ নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ৩৩ কোটি ৫০ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৪ টাকা টাকা ব্যয়ে ৪৫৫ মিটার ওই গাইড বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু এবং গত ১২ সেপ্টেম্বর প্রকল্পের কাজ শেষ করে রানা বিল্ডার্স(প্রা.) লিমিটেড ও মেসার্স শহীদ ব্রাদার্স নামীয় দুই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।

এ বিষয়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রফেসর ড. এএসএম সাইফুল্লাহ জানান, শুধুমাত্র প্রকল্প প্রণয়নে নয়, বাস্তবায়নেও নদী শাসনে বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান সেণ্টার ফর এনভায়রমেণ্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস(সিইজিআইএস) ও পাউবোকে সম্পৃক্ত রাখা প্রয়োজন। প্রয়োজনে নদী প্রবাহের ম্যাপিং করে তার ভিত্তিতে প্রজেক্ট ডিজাইন করা হলে বাঁধ দীর্ঘস্থায়ী হবে।

(আরকেপি/এসপি/সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২০)