নিউজ ডেস্ক : প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আইসিডিডিআরবি’র নির্বাহী পরিচালক পদে নিয়োগ পেয়েছেন ড. তাহমিদ আহমেদ। আইসিডিডিআরবি’র আন্তর্জাতিক বোর্ড অব ট্রাস্টিজ ড. তাহমিদ আহমেদকে পরবর্তী নির্বাহী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।

ড. আহমেদ ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাহী পরিচালক পদে নিয়োগ্রপাপ্ত প্রফেসর ক্লেমেন্সের স্থলাভিষিক্ত হবেন। যিনি ২০১৩ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। নিয়োগ প্রাপ্তির ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে ড. আহমেদ কোভিড-১৯ বিষয়ে গবেষণাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, এই চলমান মহামারি জনস্বাস্থ্যকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বিনিয়োগের অপরিসীম গুরুত্বকে বিশেষভাবে মনে করিয়ে দেয়।

ড. আহমেদ তার গবেষণামূলক কাজ এবং শিশু অপুষ্টি রোধ ও এর সহজতর চিকিৎসা ব্যবস্থা সন্ধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় তার অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাম্বুলেটরি পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন, কমনওয়েলথ সোসাইটি ফর পেডিয়াট্রিক গ্যাস্ট্রোএন্টারোলোজি অ্যান্ড নিউট্রিশন এবং ভারতীয় পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন জনস্বাস্থ্য সংস্থার পদক পেয়েছেন। ২০১৮ সালে ড. আহমেদ ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ডেভেলপমেন্ট ট্রান্সফর্মারস পুরস্কার বিজয়ী। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এ পদক গ্রহণ করেন।

ড. তাহমিদ আহমেদ আইসিডিডিআরবি’র ৬০ বছরের গৌরবময় ইতিহাসে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে নির্বাহী পরিচালক পদ অলংকৃত করবেন। এ বিষয়ে ড. আহমেদ বলেন, আইসিডিডিআরবি’র প্রথম বাংলাদেশি নির্বাহী পরিচালক হওয়া নিঃসন্দেহে একটি গৌরবের বিষয়। আইসিডিডিআরবি একটি আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছিল এবং থাকবে। আমি দেশি-বিদেশি ৪ হাজার জনেরও অধিক কর্মীর একটি দলকে নেতৃত্ব দেওয়া এবং প্রতিষ্ঠানটিকে পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে গর্বিত, যা আমাদের গবেষণার ব্যাপ্তিকে আরও বিস্তৃত করবে বলে আশাবাদী।

ড. আহমেদ ১৯৮৫ সালে আইসিডিডিআরবি’তে যোগদান করেন। সময়ের সাথে সাথে তিনি বিভিন্ন দায়িত্বভার পালন করেছেন এবং ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে আইসিডিডিআরবি’র নিউট্রিশন ও ক্লিনিক্যাল সার্ভিসেস বিভাগের সিনিয়র ডিরেক্টর নিযুক্ত হন। কোভিড-১৯ মহামারির শুরু থেকে নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর জন ক্লেমেন্সের নির্দেশনায় ড. আহমেদ আইসিডিডিআরবি’র ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠানকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

সহকর্মীদের মধ্যে ড. আহমেদ তার দৃঢ় নৈতিকতা এবং তরুণ বিজ্ঞানীদের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য সমাদৃত। তিনি একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, যিনি বিশ্ব জনস্বাস্থ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশ সম্মানিত।

আইসিডিডিআরবি’র বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান ন্যান্সি ওয়াই চেং বলেন, আমি নিশ্চিত যে তার নেতৃত্বে আইসিডিডিআরবি বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে এবং মানুষের স্বাস্থ্য সুবিধা উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে।

ড. আহমেদের সংক্ষিপ্ত জীবনী

পুষ্টি বিষয়ক গবেষণায় ড. তাহমিদ আহমেদ একজন শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী। এক্ষেত্রে তার ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তার গবেষণা এবং এর বাস্তবায়ন শিশুদের অপুষ্টি, যক্ষ্মা এবং ডায়রিয়া রোগের চিকিৎসা সহজ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ড. আহমেদ শিশুদের তীব্র অপুষ্টি ও ডায়রিয়া চিকিৎসায় একটি প্রোটোকল তৈরি করেছেন। ফলে হাসপাতালে ভর্তি শিশুদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এছাড়াও তিনি স্থানীয় খাদ্য উপাদান দিয়ে সহজে ব্যবহারযোগ্য (রেডি-টু-ইউস) এক ধরনের খাদ্য তৈরি করেছেন, যা তীব্র অপুষ্টি প্রতিরোধ ও চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হয়। তিনি অপুষ্টি, আন্ত্রিক রোগ এবং মানসিক বিকাশের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে কয়েকটি দেশে পরিচালিত ম্যালনিউট্রিশন-এন্টেরিক ডিজিজ (ম্যাল-এড) প্রকল্পের বাংলাদেশ অংশের প্রধান গবেষক। তিনি বিড (বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল এন্টেরিক ডিসফানক্শন) গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যা শিশুদের বৃদ্ধি রোধ বা স্টান্টিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ কারণ পরিবেশগত নন-ইনভেসিভ বায়োমার্কার আবিষ্কার করার চেষ্টা করছে।

ড. আহমেদ আমেরিকার সেন্ট লুইসের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জেফরি গর্ডনের সাথে মিলে মাইক্রোবায়োটা পরিচালিত সম্পূরক খাবার (মাইক্রোবায়োটা ডিরেক্টেড কমপ্লিমেন্টারি ফুড-এমডিসিএফ) আবিষ্কার করেছেন-শিশুদের অপুষ্টিরোধে যা এক অভিনব আবিষ্কার। এই আবিষ্কারটি সম্মানজনক জার্নাল সায়েন্স, ২০১৯ সালের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির অন্যতম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ড. আহমেদ বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের সহায়তায় এমডিসিএফ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ড. আহমেদ পুষ্টি বিষয়ে গবেষণা এবং প্রশিক্ষণে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এবং আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন। আন্তর্জাতিক জার্নাল এবং বইয়ে তার ৩৬০টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

শিক্ষা

ড. তাহমিদ আহমেদ ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল এবং নটর ডেম কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি শুরুতে বাংলাদেশের গ্রামীণ একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাজ করেছেন এবং পরে ১৯৮৫ সালে আইসিডিডিআরবিতে যোগদান করেন। তিনি ঢাকা শিশু হাসপাতালে আবাসিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীকালে জাপানের সুকুবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। ২০১৫ সাল থেকে তিনি আইসিডিডিআরবি’র নিউট্রিশন ও ক্লিনিক্যাল সার্ভিসেস বিভাগের সিনিয়র ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পুষ্টি ও খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়ে গবেষণার পাশাপাশি আইসিডিডিআরবি পরিচালিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ ডায়রিয়ার হাসপাতাল-ঢাকা হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রসমূহের তত্ত্বাবধান করেন। কোভিড-১৯ মহামারির শুরুতেই তিনি আইসিডিডিআরবি ক্যাম্পাসে কোভিড-১৯ এর পরীক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন। এছাড়া ড. আহমেদ ইউনিসেফের সহযোগিতায় জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের জন্য আইসিডিডিআরবি-র টেকনাফে অবস্থিত ক্যাম্পাসে ২০০ শয্যাবিশিষ্ট একটি কোভিড-১৯ আইসোলেশন ও ট্রিটমেন্ট সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছেন।

কর্মক্ষেত্র

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পুষ্টি বিশেষজ্ঞ পরামর্শদাতা দলের সদস্য হিসেবে ড. আহমেদ শিশুদের তীব্র অপুষ্টি চিকিৎসায় বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত নির্দেশিকা সংশোধন করেছেন। তিনি তীব্র অপুষ্টি সম্পর্কিত কাউন্সিল অব রিসার্চ অ্যান্ড টেকনিক্যাল অ্যাডভাইস (কর্টসাম) আন্তর্জাতিক থিঙ্ক ট্যাঙ্কের একজন সদস্য। তিনি শিশুদের কলেরা রোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে গ্লোবাল টাস্কফোর্স অন কলেরা কেস কন্ট্রোলকে (জিটিএফসিসি) পরামর্শ দেন। সম্প্রতি ড. আহমেদকে দক্ষিণ এশিয়ায় তীব্র অপুষ্টি কমাতে গবেষণা ও কার্যক্রমে পরিচালিত কারিগরি উপদেষ্টা পরিষদের সহ-সভাপতির পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি উগান্ডা, সুদান, দক্ষিণ সুদান, লেবানন, আফগানিস্তান, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার এবং উত্তর কোরিয়ায় শিশুদের অপুষ্টি ও ডায়রিয়া রোগ ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেন।

ড. আহমেদ ৫৪টি কমনওয়েলথভুক্ত দেশের শিশু পরিপাকতন্ত্র বিশেষজ্ঞদের একটি সংগঠন, পেডিয়াট্রিক গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি অ্যান্ড নিউট্রিশনের (ক্যাপগান) সভাপতি ছিলেন। তিনি জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য পুষ্টির প্রফেসর এবং সিয়াটেলের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল অব গ্লোবাল হেলথের একজন এফিলিয়েটেড প্রফেসর।

অর্জন

২০০৩ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি ড. তাহমিদ আহমেদকে মেডিকেল সায়েন্সে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য ড. সুলতান আহমেদ চৌধুরী স্বর্ণপদক প্রদান করেছে। ২০১৮ সালে ড. আহমেদ ইসলামী ব্যাংক ডেভেলপমেন্ট ট্রান্সফর্মারস পুরস্কার পেয়েছেন।

(ওএস/এসপি/সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২০)