আবীর আহাদ


মুক্তিযুদ্ধবিজয়ের পর তৎকালীন রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক দৈন্যতার কারণে বঙ্গবন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন পুনর্বাসন করতে পারেননি । তারপরও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করে প্রায় ত্রিশটি জাতীয়করণকৃত লাভজনক বিশাল বিশাল শিল্পপ্রতিষ্ঠান মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ন্যস্ত করেছিলেন । বীর মুক্তিযোদ্ধারাও বঙ্গবন্ধুর অসহায়ত্ততা অনুধাবন করে কোনো কিছু দাবি না করে, জাতির পিতার উপদেশ অনুযায়ী যে যার অবস্থানে ফিরে যান । তবে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য বীর্য ত্যাগ ও বীরত্বকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় গণ্য করে তাদেরকে আদর করে 'আমার সোনার ছেলে' ও 'আমার লালঘোড়া' অভিধায় আখ্যায়িত করেছিলেন । মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ভবিষ্যতে তাঁর আরো অনেক মহাপরিকল্পনা ছিলো যার কিছু কিছু জানার সৌভাগ্য আমারও হয়েছিলো । কিন্তু পঁচাত্তরের পনেরো আগস্ট তাঁর মর্মান্তিক তিরোধানের মধ্য দিয়ে সবকিছু ভেস্তে যায় । বীর মুক্তিযোদ্ধারাও সে-সাথে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যান ।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পালাবদলে পর্যায়ক্রমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অবস্থান নিয়ে জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ ও খালেদা-নিজামী সরকার প্রায় আড়াই যুগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের কোনোই মূল্যায়ন করেননি । আদর্শ ও চেতনাগত দিক দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারাও সেসব সরকারের নিকট থেকে কিছু আশাও করেননি । তবে এটাও সত্য যে, সেসব সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নানান চক্রান্তের জালবুনে বিভিন্ন সময় মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা ও চাকরিচ্যুত করলেও প্রকাশ্যে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কোনো কটুবাক্য বর্ষণসহ লাঞ্ছিত ও অমর্যাদা করার দু:সাহস দেখাননি ।

বীর মুক্তিযোদ্ধারা আওয়ামী লীগের বাইপ্রডাক্ট বিধায় দলটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও তাদের প্রতি দায়বদ্ধতার নিরিখে ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯ থেকে অদ্যাবধি একটানা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি রাষ্ট্রীয় ভাতা প্রচলন করে আসছেন যা তারা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য । যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছিলো বঙ্গবন্ধুর উপহার----যেটি জিয়া-এরশাদ, খালেদা-নিজামী সরকার বাতিল করার দু:সাহস দেখাননি, সেটি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী দলের সরকার বাতিল করে দিতে দ্বিধা করলেন না----এটা মুক্তিযোদ্ধাদের মনে একটি ক্ষতচিহ্ন হয়ে রয়েছে ! তবে এটাও সত্য যে, এ সরকারই দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে একটু অন্ন তুলে দিয়েছেন । মুক্তিযোদ্ধারাও একটু স্বস্তি পেয়ে আজ নিজেদের গরিমা প্রকাশ করতে পারছেন ।

কিন্তু দু:খটা অন্যখানে । মুক্তিযোদ্ধারা তো কারো করুণা চাননি । আওয়ামী লীগই বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের ওপর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত । মুক্তিযোদ্ধারা চান তাদের ঐতিহাসিক অবদানের স্বীকৃতি । তারা রাষ্ট্র, সরকার ও জনগণের কাছ থেকে ন্যূনতম সম্মান ও মর্যাদা চান । কিন্তু আওয়ামী লীগ আমলে মুক্তিযোদ্ধারা কি সেই সম্মান ও মর্যাদা পাচ্ছেন ? তাদেরকে যৎসামান্য ভাতার মাধ্যমে একটু ভাতের ব্যবস্থা করে দিয়ে তাদেরকে উঠতে বসতে চলতে ফিরতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ তার পরিচালিত রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের অবজ্ঞা ও অপমানের শিকার হতে হবে, এটা কোন ধরনের নৈতিকতা ? এ যেনো, কাউকে ভাত খাইয়ে তার মুখে চড় বসিয়ে দেয়ার মতো অবস্থা ! সারা দেশের বুকে আজ মুক্তিযোদ্ধারা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দ্বারা লাঞ্ছিত, অপমানিত, হত্যা, অত্যাচার অগ্নিসংযোগ ইত্যাদির শিকার হচ্ছেন ! এসবের প্রতিকারে প্রশাসনের তেমন কোনো তৎপরতা নেই । আর ক্ষমতাসীন দল হিশেবে তাতে আওয়ামী লীগের কোনোই প্রতিক্রিয়া নেই । তাদের আচরণে মনে হয় যেনো, মুক্তিযোদ্ধাদের একটু অসম্মান করতে পারলেই তারা আনন্দ অনুভব করেন ! এর কারণও আছে । বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে বিশাল এক একশ্রেণীর লোক যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাইরে থেকে অর্থের বিনিময়ে এ দলে অনুপ্রবেশ করেছে । তারাই সরকারি ছত্রছায়ায় নানান দুর্নীতি ও লুটপাটের সাথে জড়িত । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আপত্তি এখানেই । ফলে তারা তাদের দুর্নীতি ও লুটপাটের বিরুদ্ধে সদা উচ্চকণ্ঠ হওয়ার কারণেই এসব আওয়ামী দুর্বত্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর খড়গহস্ত ।

মুক্তিযোদ্ধারা আওয়ামী লীগকেই তাদের আদর্শিক দল মনে করে । কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীরা আওয়ামী লীগসহ তার সহযোগী সংগঠনের পদপদবী পান না । অথচ রাজাকার, রাজাকার সন্তান, বিএনপি, জামায়াত, শিবির এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যার কামলা ফারুক-রশিদের ফ্রিডম পার্টির লোকজন টাকা-পয়সা দিয়ে আওয়ামী রাজনীতি কিনে আসছে । তাই বলা চলে, বর্তমান আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে না । তারাই এখন দুর্নীতিবাজ লুটেরা মাফিয়া ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা হিশেবে আবির্ভূত হয়েছে ।

একথা বলতে আজ দ্বিধা নেই, আওয়ামী লীগের হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের যৎকিঞ্চিত মূল্যায়ন হওয়ার পাশাপাশি, সেই তাদেরই হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের বেদনাদায়ক অপমান সংঘটিত হচ্ছে অনেক বেশি ! মুক্তিযোদ্ধাদের এ অবমূল্যায়নের বীজ নিহিত রয়েছে আমাদের জাতীয় সংবিধানের মধ্যে, যেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের কোনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই । পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে নানান গোঁজামিলের সংজ্ঞা ও নির্দেশিকার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় আয়োজনে অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা, এমনকি রাজাকারদেরও মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়ার অপরিণামদর্শি কার্যকলাপের দায় থেকে আওয়ামী লীগ সরকারও মুক্ত নয় । মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বমোট সংখ্যা দেড় লক্ষের নিচে । আজ সরকারিভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দু'লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজারের মতো । অর্থাত্ কমবেশি পঁচাশি হাজার অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানানোর অপকৃতিত্ব বিএনপি ও আওয়ামী লীগের !

জাতীয় সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি না থাকার ফলে একদিকে যেমন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে, অন্যদিকে অর্থের বিনিময়ে ও গোঁজামিলের আশ্রয়ে যে কেউ মুক্তিযোদ্ধা বনে যাচ্ছে ! এ বিষয়টি অনুধাবন করে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে আমি একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠন করে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকার দাবিতে একটি আন্দোলন গড়ে তুলি । নানান সভা সমাবেশ, আলোচনা, মতবিনিময় সভা, ধারাবাহিক লেখালেখি ইত্যাদি করার পর ৩রা জুলাই বঙ্গবন্ধু-ভবন প্রাঙ্গণ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে মুক্তিযোদ্ধাদের ঐতিহাসিক পদযাত্রা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করি । আমরা জানতে পেরেছিলাম যে, আমাদের স্মারকলিপির বক্তব্যের ওপর প্রধানমন্ত্রী সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন যার ফলাফল আজো অজ্ঞাত ।

এ-অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকার দাবিতে আমাদেরকে সজাগ ও সোচ্চার থাকতে হবে । এ সজাগ ও সোচ্চারকে প্রবহমান রাখার লক্ষ্যে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ব্যানারে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি । এ-বিষয়ে কোনো ভুঁইফোঁড়, চটকদার ও রাজাকার-ভুয়ানির্ভর তথাকথিত সংগঠনের মতলববাজি কার্যক্রমে নিশ্চয়ই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বিভ্রান্ত হবেন না বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করছি ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।