আবীর আহাদ


মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী-----কিন্তু আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছরের ব্যর্থজীবনে স্বাধীনতার রূপকারদের একটিমাত্র সান্ত্বনা ছিলো, একটিমাত্র গর্ব ছিলো যে তারা বীর মুক্তিযোদ্ধা ! কিন্তু 'সকলি গরল ভেল' ! ২০১৭ সালের পর থেকে অদ্যাবধি তারা বিস্ময়ের সাথে দেখতে পাচ্ছে যে, তাদের সেই সান্ত্বনা, সেই গর্ব ধুলোয় লুন্ঠিত হয়ে গেছে ! মূলত: তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই রঙ্গতামাশায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার চাইতে অমুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাধিক্যে প্রকৃতরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়ে পড়েছে । প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্ব লুন্ঠিত হয়ে গেছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ।

এসব নিয়ে সারা দেশে তুমুল বাদপ্রতিবাদ পরিলক্ষিত হলেও সরকার চোখে ঠুঁসি আর মুখে কুলুপ মেরে বসে আছেন ! মনে হয় সরকার নিজের সৃষ্ট ফাঁদে নিজেই ফেঁসে গেছেন ! নইলে এতো গরমিল ও গোঁজামিলের বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি উঠলেও সরকার নীরবতা পালন করছে কেন ? অথবা সরকার কারো হাতে কোনো কারণে জিম্মি হয়ে পড়ায় তারা কোনো রা-করতে পারছেন না ? তবে কি ধরে নিতে হবে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ নামকাওয়াস্তে আসীন থাকলেও ক্ষমতায় অন্য কেউ বসে যাবতীয় কলকাঠি নাড়ছে ! যাকে আমরা বলতে পারি invisible govt বা অদৃশ্য সরকার ! এই অদৃশ্য সরকারটি কে, কী তার উদ্দেশ্য ? কাদের নেতৃত্বে গঠিত সেই শক্তিশালী অদৃশ্য সরকার ?

উদ্দেশ্য কি এই যে, সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের খাতায় যারা নাম লিখিয়ে কামটি সুন্দরভাবে কৃতিত্বের সাথে সম্পন্ন করেছিলো তাদের সিংহভাগই ছিলো দরিদ্র মানুষ । অতএব, দরিদ্র মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় চরিত্রের সর্বোচ্চ মর্যাদা 'বীর মুক্তিযোদ্ধা'র আসন দেয়া যাবে না ! উদ্দেশ্য কি এই যে, কেন ঐসব মুক্তিযোদ্ধা নামধারী কুলঙ্গাররা সাধের পাকওয়াতান ছারখার করে দিয়েছিলো ? অতএব, তাদের দীনহীন করে ধুকেধুকে নি:শেষ করে দাও ! উদ্দেশ্য কি এই, তাদের শৌর্য-বীর্য ও বীরত্বকে ম্লান করে জাতির সামনে তাদের হেয় করো, অপমান করো ; প্রয়োজনে যেকোনো অছিলায় ধোলাই দিয়ে ভয় দেখিয়ে চুপ মেরে থাকার ব্যবস্থা করো ! অতএব তাদের শৌর্য-বীর্য ও বীরত্বকে চোরাবালিতে ডুবিয়ে দাও ! আরো অনেক উদ্দেশ্য থাকতে পারে যা উল্লেখ করতে গেলে পর্যালোচনাটি অন্যদিকে মোড় নেবে ।

অদৃশ্য সরকারটি এতোটাই শক্তিশালী যে, তারা বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু প্রণীত মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাটি অবজ্ঞাভরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে কোনোই দ্বিধা করেনি ! অতএব আওয়ামী লীগ সরকারের ভেতরের অদৃশ্য সরকারটি নিজের মতো করে একটি তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা, যাচাই বাছাই নির্দেশিকা ও নীতিমালা তৈরি করেছে । এবং সেই নির্দেশিকাকে মোক্ষম হাতিয়ার বানিয়ে হাজার হাজার ভুয়াসহ স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেড় লক্ষের নিচের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে সমান সংখ্যক ভুয়ার মধ্যে গলিয়ে দিয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মান-সম্মান, শৌর্য-বীর্য ও বীরত্ব-মর্যাদাকে চিরতরের জন্য ম্লান করে দিয়ে প্রকারান্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে অপাঙ্ক্তেয় করার ষোলকলা পূর্ণ করে দিতে পারছে ! আর এই প্রক্রিয়ায় শহুরে ও গ্রামীণ প্রভাবশালী ও ধনিকরা ২০১৭ সাল থেকে অদ্যাবধি মুক্তিযোদ্ধা বনে গিয়ে ৭১-এর দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধাদের কোণঠাসা করে ফেললো ! তাই তো কিছুকাল আগে এক গ্রামীণ দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা একরাশ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খেদোক্তি করে বলেছিলেন : শেখের হাতে প্রকৃত 'মুক্তিযোদ্ধা' নামের উত্থান ঘটেছিলো, হায়,:কী নির্মম পরিণতি-----তাঁর বেটির আমলে সেই 'মুক্তিযোদ্ধা' নামের মর্যাদার পতন ঘটলো !

আসলেই একটি অদৃশ্য অশুভ সরকার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওপর আছর করে রয়েছে ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।