রঘুনাথ খাঁ


বঙ্গোপসাগরমুখী খরস্রোতা ইছামতির এপারে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা উপজেলার  টাউন শ্রীপুর গ্রামের জমিদার বাড়ি। ওপারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার বসিরহাট মহকুমার হাসনাবাদ থানার টাকি জমিদার বাড়ি। এই দুই জমিদারের জমিদারিত্বের  মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে দুই দেশের সীমানা বিভাজনকারী নদৗ ইছামতি।

শারদীয় দুর্গাপূজার শেষ দিন বিজয় দশমীতে ইছামতির স্বচ্ছ জলরাশির পরিপূর্ণতায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে দেবী দুর্গার মৃন্ময় মূর্তি।দুই পারে লক্ষ জনতার ভিড়। দুই তীর ঘেঁষে বসে মেলা। লক্ষ জনতার পদচারনায় ইছামতির দুই ধার জুড়ে এমন জনারণ্যের মাঝে চলে দুই দেশের প্রতিমা বিসর্জন। দুপুর থেকে রাত অবধি। সেই সাথে গান বাজনা, আনন্দ উৎসব।

এ দৃশ্য আজ বিরল। শত বছর ধরে এ দৃশ্য দুই দেশের জনতা উপভোগ করলেও এখন তা অদৃশ্য। ২০১৩/২০১৪ সালে ভারত ও বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিতে থাকায় পশ্চিম বাংলা সরকার দুই দেশের এই মিলনমেলা নিরাপত্তার কারণে বন্ধ করে দেয়। এরই মধ্যে ঈছামতিতে বিসর্জনের সময় সলিল সমাধি ঘটে কলকাতার যাদবপুর বিশ^বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক গবেষকের। সাথে যুক্ত হয় আরও কয়েকটি সলিল সমাধির ঘটনা।এরই সাথে বন্ধ হয়ে যায় টাউনশ্রীপুর এলাকার উৎসব,আমেজ,আড়ম্বর এবং সর্বোপরি প্রতিমা বিসর্জনের আড়ং।তবে এখন কোনো প্রকার আড়ং নয় যে যার সীমানায় অবস্থান নিয়ে প্রতিমা বিসর্জন দেয় বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলার ভক্তরা।মাঝখানে অবস্থান নেয় বিজিবি ও বিএসএফ। অতি প্রশস্ত নদী ইছামতির সেই দৃশ্য এখন চোখে আনা খুবই কঠিন।

পেছনে ফেলে এলেও আড়ম্বরপূর্ন সেই দিনগুলির কথা কেউ ভুলতে পারছেন না। দুপুরের আগেই শত শত প্রতিমা ভেসে বেড়াতো ইছামতিতে।বড় বড় জোড়া নৌকায় অথবা ট্রলারে প্রতিমার সাথে সাথে নদীর ঢেউয়ের তালে তালে ঢাক ঢোল ,শংখধ্বনি, ধুনুচি নাচ আর উলুধ্বনির মধ্য দিয়ে নদী ইছামতি যেনো নতুন রূপ লাভ করতো । দুই দেশের শত শত দর্শনার্থী নারী পুরুষ ট্রলার নৌকা নিয়ে ভেসে বেড়াতো নদীতে। নিজ নিজ দেশের সীমানা রক্ষা করে দুই দেশের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সীমান্ত প্রহরী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি ও ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স বিএসএফ এর সতর্ক প্রহরা থাকতো চোখে পড়ার মতো। দর্শনার্থী ও প্রতিমা নিরঞ্জনকারীদের ‘মা তুমি আবার এসো, দুর্গাময় কি জয়’ ধ্বনিতে সৃষ্টি হতো নতুন ব্যঞ্জনার। আর দুই তীরে দন্ডায়মান লক্ষ জনতা তাতে সাড়া দিয়ে ধ্বনিতে মুখরিত করে তুলতেন বিসর্জন এলাকা।সাথে ফুটতো বাজি। মাইকে বাজতো গানের পর গান।

ইছামতির তীরে এসে বিজয়া উপলক্ষে হিন্দু সধবা নারীরা মায়ের কপালে সিঁদুর পরিয়ে দিতেন।হিন্দু নারীরা একে অন্যকে সিঁদুর পরাতে গিয়ে মেতে উঠতেন সিঁদুর খেলায়। মায়ের পদযুগলে সিঁদুর মাখা শাড়ির আঁচল বুলিয়ে পরম যত্ন সহকারে মঙ্গল আশীর্বাদ হিসাবে নিয়ে যেতেন নিজ নিজ পরিবারে। এ সময় করমর্দন এবং কোলাকুলিতে সৃষ্টি হতো নতুন ব্যঞ্জনার।নদীতে বসতো নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা। সে দৃশ্যও আজ বিরল।

দেবহাটার টাউন শ্রীপুরে ইছামতি নদীতে দুই দেশের প্রতিমা নিরঞ্জনকালে মাইকে ভেসে আসতো একই সাথে ঈদ ও পূজার শুভেচ্ছার স্লোগান। দুই পারের মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতেন চকোলেট, মিষ্টি, ফুল । পরমানন্দে তারা তা গ্রহন করতেন। সরকারি পর্যায়ে দ্ইু বাংলার জন্য ইলিশ মাছ ও মিষ্টি বিনিময় করা হতো। বাংলাদেশের পক্ষে দেবহাটা উপজেলা পরিষদ টাকি পৌর মেয়র এবং পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা হিসাবে পাঠাতো ইলিশ ও মিষ্টি। আর পশ্চিমবাংলার পক্ষ থেকে বাংলাদেশে পাঠানো হতো মিষ্টি। দুই বাংলার প্রশাসনিক কর্মকর্তারা পরস্পরের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় ছাড়াও আনন্দ উৎসবে মেতে উঠতেন। বিভিন্ন সময়ে পশ্চিম বাংলা সরকারের মন্ত্রীরাও সীমানা ভেদ করে চলে আসতেন বাংলাদেশ ভূখন্ডে ইছামতি তীরে।

তারা শুভেচ্ছা বিনিময় ও আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আবার ফিরেও যেতেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। এ দিন কিছু সময়ের জন্য দুই দেশের সরকারের ঐকমত্যে সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেওয়া হতো কঠোর নজরদারির মধ্যে। ফলে এপার থেকে ওপারে এবং ওপার থেকে এপারে শত শত মানুষ নির্ধারিত সময়ের জন্য এসে দুই দেশের মাটি ষ্পর্শ করে শুভেচ্ছা বিনিময় করে ফিরে যেতেন। বিশেষ করে যাদের জন্মস্থান অথবা পৈত্রিক ভিটা বাংলাদেশ কিংবা ভারতে তারা এই সামান্য সময়ের সুযোগে আত্মীয় স্বজনদের সাথে সাক্ষাত করে উপহার সামগ্রী বিনিময় করে তৃপ্ত হতেন। ইছামতির এই মিলন মেলায় শামিল হতেন দুর দুরান্তের কয়েক জেলার মানুষ। ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে তারা পরস্পরের প্রতি শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করতেন।

ইছামতির দুই পারে সবুজ বৃক্ষ বেষ্টিত বেড়িবাঁধের ওপর ছায়াশীতল পরিবেশে তারা উপভোগ করতেন প্রতিমা নিরঞ্জন অনুষ্ঠান। এই মিলন মেলা উপভোগের জন্য স্থানীয়দের আত্মীয় স্বজনরাও নিমন্ত্রিত হতেন।
কয়েক ঘন্টা নদীতে আনন্দের আতিশয্যে ভাসমান থেকে সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইছামতিতে সব প্রতিমা এক এক করে জলরাশিতে নিরঞ্জন করা হতো। নদী বক্ষে ঝাপ দিয়ে ভক্তরা আবারও বলে উঠতেন ‘মা তুমি আবার এসো’।এরপরই শুরু হতো আকাশ জুড়ে বাজির মেলা। দুর আকাশ ছুঁয়ে যেতো নানা ধরনের চোখ ধাঁধাঁলো আতশ বাজি। সব দর্শকদের নজর কেড়ে নিতো এই বাজির মেলা।

আনন্দ বিষাদে ভরা ভক্তরা সিক্ত অবস্থায় যে যার বাড়ি ফিরতেন।বিজয় দশমীতে সেই ইছামতি এখন একরকম প্রতিমা শুন্য। তবে কিছু প্রতিমা ঘাটে এসে অনাড়ম্বর ভাবে বিসর্জন দেওয়া হয় । সেখানে কোনো অড়ম্বর থাকবে না, উৎসব নয়, নৌকায় ভেসে ভেসে আড়ং নয়। এমনকি সন্ধ্যায় আতশ বাজিরও দেখা মেলে না। নদীতে ভাসেনা হাজার হাজার দর্শনার্থীর নৌকা ট্রলার।

লক্ষ মানুষের প্রাণোচ্ছাসে ভরা সেই দিনগুলি পেছনে পড়ে গেছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার অসাম্প্রদায়িক মানুষ এই দিনটির অপেক্ষায় এখনও দিন কাটায়। কিন্তু সন্ত্রাস ও জঙ্গি হামলার হুমকি তাদের পিছিয়ে দিয়েছে। তাদের সেই বিনোদন কেড়ে নিয়েছে।

এ কথা সত্য যে বিজয় দশমীতে দেবী দুর্গা বিসর্জনের আনন্দ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দেশের নানা প্রান্তে। বিশেষ করে বাংলাদেশের নদীতে নদীতে এই আড়ং এখনও দৃশ্যমান,উপভোগ্য। কিন্তু দুই দেশের সীমানা বিভাজনকারী নদী ইছামতিতে দুই বাংলার সেই মিলন মেলা আর চোখে পড়ছে না।অতীত দিনগুলির সেই স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বয়োবৃদ্ধরা বলেন তারা পুরুষানুক্রমে এই মিলন মেলা দেখে আসছেন। এমনকি দেশ স্বাধীন হবার আগেও সীমান্তে এই আড়ং উৎসবে এতোটুকু কমতি ছিল না। টাউন শ্রীপুর বেড়ি বাঁধের লক্ষ জনতার উপচে পড়া ভিড়, আর টাকি সোদপুর জমিদার বাড়ির অঙ্গন ঘিরে পশ্চিম বাংলার ওই এলাকার মানুষও আফসোস করেন আড়ং দেখতে না পেরে।
দেবহাটার টাউন শ্রীপুর ছিল বৃটিশ আমলে পূর্ববঙ্গের দ্বিতীয় পৌরসভা।১৮৬৭ সালে স্থাপিত এই পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন ফণীভূষণ সরদার।

১৯৫৫ সালে এই প্রাচীন পৌরসভা বিলুপ্ত ঘোষনা করে পাকিস্তান সরকার।টাউন শ্রীপুরের জমিদার দেবেন্দ্রনাথ গুহবর্মন এবং তার ভ্রাতা তেজেন্দ্র নাথ, রবীন্দ্র নাথ, নরেন্দ্রনাথ ও সুরেন্দ্রনাথ গুহবর্মন এই পৌরসভা স্থাপন করেছিলেন। তারাই প্রচলন করেছিলেন দুই বাংলার মিলন মেলার। ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধ কালে এই টাউন শ্রীপুরের কেদারমাঠে হানাদার পাকি বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় ধরনের যুদ্ধ হয়েছিল । এই যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর অনেক সেনা নিহত হয়। আর শহিদ হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা । তাদের মধ্যে শহিদ নাজমুলের কবর রয়েছে ওপার বাংলার টাকিতে। টাউন শ্রীপুরেও রয়েছে কয়েকজন শহিদ মুক্তিযোদ্ধার কবর। বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগনের পক্ষে এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন টাউন শ্রীপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপটেন শাহজাহান মাস্টার। তিনি আজ প্রয়াত।

টাউন শ্রীপুরের জমিদার বংশের জেনারেল শংকর রায় চৌধুরী ছিলেন ভারতের এক সময়কার সেনা প্রধান। তার পৈতৃকভিটা এখনও রয়েছে। ১৯৯৭ সালে তিনি অবসরে যাবার কিছুদিন আগেও এসেছিলেন টাউন শ্রীপুরে নিজের জন্মভিটায়। টাকির জমিদার রথীন্দ্র নারায়ন রায় চৌধুরী ও তার জমিদারিত্ব আজ আর নেই। তার মৃত্যুর পর জমিদারিত্ব লাভ করেন তার ছেলে পৃথ্বিশ রায় চৌধুরী। নদীর বাংলাদেশ পার থেকে দৃশ্যমান সেই জমিদারের বাড়িতে রয়েছে একটি সুদৃশ্য বাংলো, একটি স্কুল ও একাংশে রয়েছে জমিদারদের বংশধর। দেশ বিদেশের অতিথিরা এখানে এসে বিশ্রাম করেন।

এই টাউন শ্রীপুরের ছবিতে বছর চারেক আগে গৌতম ঘোষের পরিচালনায় নির্মিত হয়েছিল সিনেমা ‘শঙ্খচিল’। এতে নায়কের ভূমিকায় ছিলেন ভারতের প্রসেনজিত ও বাংলাদেশের নায়িকা কুসুম সিকদার।

ঐতিহাসিক নানা স্মৃতি বিজড়িত টাউন শ্রীপুর এখন অনেকটাই মলিন হয়ে পড়েছে। এখানে নেই সেই প্রাচীনতম পৌরসভা। নেই জমিদার ও তাদের বংশধর। ইছামতি নদীতেও এখন আর বসেনা প্রতিমা বিসর্জনের উপভোগ্য মিলন মেলা।

লেখক : গণমাধ্যম কর্মী।