প্রহলাদ মন্ডল সৈকত, রাজারহাট (কুড়িগ্রাম) : সরকারিভাবে ধান, চাল ও গম সংরক্ষণে কুড়িগ্রাম জেলা খাদ্য বিভাগে ছেড়া,ফাঁটা ও নিম্ন মানের প্রায় ৮লাখ বস্তা ক্রয়ের দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় একযোগে ১৪ জন কর্মকর্তা কর্মচারিকে শাস্তিমুলক বদলী করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৩ জন ভারপ্রাপ্ত গুদাম কর্মকর্তা (ওসিএলএসডি) এবং ৬জন পরিদর্শক রয়েছেন। রংপুর আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তর থেকে গত ২১ অক্টোবর থেকে বুধবার পর্যন্ত পৃথক ৬টি অফিস আদেশে এদের বদলী করা হয়। 

বদলী হওয়া কর্মকর্তারা হচ্ছেন, কুড়িগ্রাম সদর খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা কানিজ ফাতেমা, ভুরুঙ্গামারী খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা প্রণব কুমার গোস্বামী, ফুলবাড়ি খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা হামিদুল ইসলাম, চিলমারী উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক মাইদুল ইসলাম মাহি, উলিপুর উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক গোলাম মোস্তফা, নাগেশ্বরী উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক রবিউল আলম কাজল, ফুলবাড়ী উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক মনোয়ারুল ইসলাম, রাজারহাট উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক নুর মোহাম্মদ, কুড়িগ্রাম সদর খাদ্য পরিদর্শক (কারিগরী) মিজানুর রহমান।

এছাড়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের উচ্চমান সহকারী ইউসুফ আলী, কম্পিউটার অপারেটর আলমগীর হোসেন, স্প্রেম্যান নবিউল ইসলাম ও জিয়াউর রহমান, নিরাপত্তা প্রহরী আরিফ মিয়া। তাদেরকে লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ে বদলী করা হয়। রংপুর আঞ্চলিক খাদ্য কর্মকর্তা আব্দুস সালামের দেয়া আদেশে তাদেরকে ১ নভেম্বরের মধ্যে স্ব-স্ব কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশ দেয়া হয়। অন্যথায় পরদিন থেকে তাদেরকে কর্মবিমুক্ত বলে গণ্য করা হবে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত বোরো মৌসুমে কুড়িগ্রামের জন্য প্রায় আট লাখ নতুন বস্তা ক্রয়ের জন্য একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে খাদ্য বিভাগের চুক্তি হয়। ওই প্রতিষ্ঠান বস্তা সরবরাহের সময় চুক্তি ভঙ্গ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশ করে আট লাখ পুরনো নিম্নমানের ও ছেঁড়া-ফাটা বস্তা কুড়িগ্রাম সদর, ফুলবাড়ি ও ভুরুঙ্গামারী খাদ্যগুদামে সরবরাহ করে। ওই সময় রংপুর ও নীলফামারীতে বস্তার সংকট দেখা দিলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কুড়িগ্রাম সদর খাদ্য গুদাম থেকে সদ্য ক্রয়কৃত ২ লাখ বস্তা সেখানে পাঠানো হয়। ওই বস্তা রংপুর ও নীলফামারীতে পাঠানোর পর পুরাতন বস্তা রিসিভ না করে ফেরৎ পাঠানোর পর দুর্নীতির ঘটনা ফাঁস হয়। শুরু হয় খাদ্য বিভাগে তোলপাড়। স্থানীয় ভাবে গঠন করা হয় ২টি তদন্ত কমিটি। এ কমিটি দুর্নীতির সত্যতা পাওয়ার পর ঢাকা থেকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি তদন্ত কমিটি কুড়িগ্রামে আসে।

অভিযোগ উঠেছে, নতুন বস্তার টেন্ডারে দর ছিল (৩০ কেজির বস্তা) ৬০ টাকা এবং (৫০ কেজির বস্তা) ৮০টাকা। কিন্তু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাইরে থেকে ১৫-১৬ সালে ব্যবহৃত পুরাতন বস্তা ১০হতে ১২ টাকা দরে কিনে নেয়। আর এসব বস্তা উল্টে স্টেনসিল ব্যবহার ও ক্যালেন্ডার করে নতুন বস্তা হিসেবে সরবারহ করে। বস্তার গায়ে নতুন করে লেখা হয় ‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশ ক্ষুধা হবে নিরুদ্দেশ’। সংশ্লিষ্ট গুদাম কর্মকর্তারা ওই সব পুরাতন ছেঁড়াফাটা বস্তা গ্রহণের সময় নতুন হিসেবে প্রত্যয়নপত্র দিয়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বস্তা প্রতি ১৬ হতে ২০ টাকা উৎকোচ নেয়। এতে মাঠ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মোট ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার ঘুষ বাণিজ্য করে বলে অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি বিভিন্ন ইলেকট্রিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত হলে গত ৫/৮অক্টোবর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো: মজিবর রহমানের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি সরেজমিন তদন্ত করেন। বস্তা ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগে গণবদলীর আদেশ জারি করা হয়।

এদিকে এই গণবদলীর খবর ফাঁস হবার পর খাদ্য বিভাগে ব্যাপক চাঞ্চল্য ও আতংক সৃষ্টি হয়েছে। দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বস্তা ক্রয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার পরেও অনেকের বিরুদ্ধে এখনো ব্যবস্থা না নেয়া হলেও ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততা না থাকলেও কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারিকেও বদলী করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি জেলা খাদ্য বিভাগ গঠিত দুটি তদন্ত কমিটি প্রাথমিক তদন্তের দুর্নীতি হয়েছে মর্মে প্রতিবেদন দিলেও রহস্যজনক কারণে সেই তদন্ত কমিটির দুই পরিদর্শককেও বদলী করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কারো কারো ঘাড়ে ঘটনা ফাঁস হওয়ার দায় চাপানো হয়েছে বলে খাদ্য বিভাগের একটি সুত্র জানায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,‘উদোর পিন্ডি বুদোর ঘারে চাপানো হচ্ছে।’ কারণ এ দূর্নীতির সাথে খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কাজের সম্পর্ক। এর বাইরে অন্যদের কোন সম্পৃক্ততার সুযোগ নেই। কিন্তু বদলী করা হচ্ছে গণহারে। এতে করে ভুল বার্তা যাচ্ছে সবার কাছে।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মিজানুর রহমান একযোগে ১৪ কর্মকর্তা-কর্মচারিকে বদলীর সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘ঠিক কি কারণে তাদের বদলী করা হয়েছে তা আমার জানা নেই।’ বস্তা ক্রয়ের দুর্নীতির সাথে এই গণবদলীর সম্পর্ক আছে কীনা তা জানাতে রাজী হননি তিনি। তবে তিনি দাবী করেন খাদ্য ভবনের নির্দেশে আরো কিছু বদলী হবে।

রংপুর আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুস সালামের সাথে ফোনে যোগাযোগ করলেও রিসিভি করেননি।

জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি এ কে এম সামিউল হক নান্টু বলেন, প্রকৃত দুর্নীতি বাজদের শুধু বদলী করলে হবে না। তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সরকারের যদি কোন আর্থিক ক্ষতি হয়ে থাকে তাহলে তা তাদের কাছ থেকে আদায় করতে হবে। একই সঙ্গে নিরাপরাধ কোন ব্যক্তি যেন হয়রানির স্বীকার না হয় তাও দেখতে হবে সরকারকে।

(পিএস/এসপি/অক্টোবর ২৯, ২০২০)