ময়মনসিংহ থেকে, সাজ্জাতুল ইসলাম সাজ্জাত : আজ ১৮ আগষ্ট (সোমবার) বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ৫৪তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। ৫৩ বছর পূর্বে ১৯৬১ সালের এই দিনেই প্রকৃতিকন্যা খ্যাত প্রাকৃতিক সৌন্দের্যের লীলাভূমি ব্রক্ষপুত্র নদের পড়ে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।

রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ১২০ কিলোমিটার দূরে এবং ময়মনসিংহ জেলা শহর থেকে চার কিলোমিটার দক্ষিণে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম প্রান্তে চিরসবুজে ঘেরা গ্রামীণ পরিমন্ডলে ১২০০ একর জমির ওপর গড়ে ওঠে ওই খ্যাতিনামা প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশের সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা কৃষিকেন্দ্রিক। এদেশের কৃষির আধুনিকায়ন ও শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামো সৃষ্টির লক্ষ্যে নয়নাভিরাম পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কৃষি শিক্ষার মাতৃসম এই বিশ্ববিদ্যালয়। আন্তর্জাতিক মানের সেশনজটবিহীন শিক্ষা পদ্ধতি, উচ্চতর গবেষণার যাবতীয় সুযোগ সুবিধা সম্বলিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমানে পরিণত হয়েছে ‘দ্য সেন্টার ফর এক্সিলেন্স’-এ।


১৯৬১ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাকার্যক্রম শুরু করেছিল ভেটেরিনারি ও কৃষি অনুষদ দিয়ে। ২৩টি শিক্ষা বিভাগে তখন মাত্র ৩০ জন শিক্ষক ছিলেন। মোট শিক্ষার্থী ছিলেন ৪৪৪ জন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কয়েক মাস পর ১৯৬২ সালে পশুপালন অনুষদ নামে তৃতীয় একটি অনুষদ যুক্ত হয়। এরপর ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, ১৯৬৪-৬৫ শিক্ষাবর্ষে কৃষি প্রকৌশল ও কারিগরি অনুষদ এবং ১৯৬৭-৬৮ শিক্ষাবর্ষে মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষাকার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে ছয়টি অনুষদের আওতায় ৪৩টি বিভাগে মোট ৫৬০ জন শিক্ষক রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে স্নাতক পর্যায়ে তিন হাজার ৯৫৯ জন, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে এক হাজার ৪০ জন এবং পিএইচডি পর্যায়ে ৩৭৩ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পঁচিশ হাজার ৪০০ জন স্নাতক, এক লাখ ৪৮ হাজার ৯৪৪ জন স্নাতকোত্তর এবং ৪৬৪ জন পিএইচডি লাভ করেছেন (১০ ডিসেম্বর ২০১৩ অনুযায়ী)।
উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নোবেল বিজয়ী কৃষিবিজ্ঞানী ড. নরম্যান ই. বোরগলকে সম্মানসূচক ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ৬টি অনুষদ ভবন, প্রশাসনিক ভবন, ছাত্রদের নয়টি এবং ছাত্রীদের তিনটি আবাসিক হল। এ ছাড়াও রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে গবেষণা খামার, সমৃদ্ধ বোটানিক্যাল গার্ডেন, ফলের জাত উন্নয়নের জন্য জার্মপ্লাজম সেন্টার, দেশের একমাত্র কৃষি জাদুঘর, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একমাত্র উদ্ভিদের রোগ নির্ণয়ের কিনিক এবং মাৎস্য জাদুঘর, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত একটি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারণ কেন্দ্র (বাউএক), সিড প্যাথলজি সেন্টার, কেন্দ্রীয় গবেষণাগার, বায়োটেকনোলজি ল্যাব, ভেটেরিনারি কিনিকসহ কৃষি সম্পর্কিত বিভিন্ন সুবিধা সংবলিত স্থাপনা। এছাড়াও দেশের কৃষি সম্পর্কিত দুটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) এর প্রধান কার্যালয় এ সবুজ ক্যাম্পাসেই অবস্থিত।
জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি বাকৃবিতে চলে জ্ঞান বিতরণের কাজ। কৃষি গবেষণায় বাকৃবি দক্ষ গ্রাজুয়েট তৈরির পাশাপাশি উন্নত কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেম (বাউরেস) তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন দেশী ও বিদেশী গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে উদ্ভাবিত হয়েছে ফল-ফসলের জাতসহ নিত্য-নতুন কৃষি প্রযুক্তি। শস্যবিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে- অধিক ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন।
বিভিন্ন ফলের জাত উদ্ভাবন; শস্য ক্ষেতে সহজে রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি; বোরো মৌসুমে কম পানি ব্যবহার করে বোরো ধান উৎপাদনের কলাকৌশল, বীজ শোধন যন্ত্র। পশুসম্পদ বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির মধ্যে মোরগ-মুরগির রানীতে রোগ, হাঁসের প্লেগ ভ্যাকসিন, কৃত্রিম পশু প্রজনন প্রযুক্তি, কোয়েলের উচ্চ উৎপাদনশীল জাত, সয়াদুধ ইত্যাদি। নতুন নতুন কৃষি প্রকৌশল সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে স্বল্প ব্যয়ে সেচ নালা তৈরি, বাকৃবি জিয়া সার-বীজ ছিটানো যন্ত্র, গুটি ইউরিয়া ব্যবহারের যন্ত্র, সোলার ড্রায়ার, স্বল্প ব্যয়ে হস্তচালিত ধান কাটার মেশিন, পাতা দেখে উদ্ভিদের রোগ নির্ণয়ের কম্পিউটার প্রোগ্রামিং। মাছের কৃত্রিম প্রজননসহ ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ পদ্ধতি, মাছ ও সবজির সমন্বিত চাষ পদ্ধতি, ইলিশ মাছ আহরণের পর মানসম্মত উপায়ে বরফজাতকরণ, স্বল্প খরচে মাছ সংরক্ষণে বরফ বাক্স, মাছের প্রাকৃতিক খাবার পেরিফাইটন পদ্ধতিতে মাছ চাষ, এলোজাইম মার্কার ব্যবহার করে পিতামাতার সাথে ক্রস কৈ মাছের কৌলিতাত্ত্বিক পার্থক্য নিরূপণ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
দেশের কৃষিশিক্ষা ও গবেষণার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কৃষিবিজ্ঞানের সব শাখা স্থলজ ও জলজ সবকিছুই এর আওতাভূক্ত মানসম্পন্ন উচ্চতর কৃষিশিক্ষা ব্যবস্থার নিশ্চয়তা বিধানের মাধ্যমে দেশে কৃষি উন্নয়নের গুরুদায়িত্ব বহনে সক্ষম তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ কৃষিবিদ, কৃষিবিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ ও কৃষি প্রকৌশলী তৈরি করাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ৷ আর এ লক্ষ্য অর্জনে ও দেশের আপামর জনসাধারণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সুবর্ণ জয়ন্তী পেরিয়ে আসা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটরা নিরন্তর কাজ করে যাবেন এটাই সবার প্রত্যাশা। শুভ হোক এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ চলা।
শিক্ষার্থীদের মননশীলতা বিকাশ ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের আওতায় বিনোদন সংঘ, সাহিত্য সংঘ, নাট্য সংঘ, সংগীত সংঘ, বিজ্ঞান সংঘ, ডিবেটিং কাব নিয়মিতভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়াও শিক্ষার্থীরা স্কাউটিং, বিএনসিসি ও বাঁধনের সাথে যুক্ত থেকে ভবিষ্যত জাতি গঠনে নেতৃত্ব দিতে নিজেকে তৈরি করছেন। ১৯৭১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুলসংখ্যক ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এ বিশ্ববিদ্যালয় হারায় ১৯ সাহসী বীর সন্তানকে, যারা দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য মুক্তিযুদ্ধে অকাতরে তাদের জীবন উৎসর্গ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল হক এ বানীতে বলেন, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশর অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি কৃষি। দেশের ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা দিতে এ বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করে যাচ্ছে। শোকের এ মাসে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে জাতির প্রত্যাশা ও বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নপূরণে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাইকে সাথে নিয়ে শিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারণের কাজকে আরো বেগবান করে একটি ক্ষুধা, অপুষ্টি ও দরিদ্রমুক্ত দেশ প্রতিষ্ঠায় এ বিশ্ববিদ্যায় বর্তমানে যে অবদান রাখছে আগামীতে তা আর জোরদার হবে এটাই আমার প্রত্যাশা।
(এএস/আগস্ট ১৮, ২০১৪)