শিতাংশু গুহ, নিউইয়র্ক : আগামীকাল মঙ্গলবার ৩রা নভেম্বর ২০২০ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই নির্বাচনের ফলাফল এতটাই অনিশ্চিত যে আধুনিক ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া দুস্কর। উভয় পক্ষ বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। বিভিন্ন জরিপে বাইডেন এগিয়ে আছেন দেখানো হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, ব্যাটেলগ্রাউন্ড ষ্টেটগুলো নির্ধারণ করবে বিজয়ের মুকুট কার মাথায় শোভা পাবে? 

রবিবার ১লা নভেম্বর সশরীরে আগাম ভোট শেষ হয়েছে। রেকর্ড ৯০ মিলিয়ন মানুষ আগাম ভোট দিয়েছেন। ২০১৬-তে যত ভোট পড়েছে, এবার এর ৬৫% মানুষ আগেই ভোট দিয়েছেন? তাই নির্বাচনের দিন ভিড় কম হবার সম্ভবনা বেশি। তবে এবার ফলাফল নির্বাচনী রাতে নাও পাওয়া যেতে পারে, এবং ফলাফল সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ানোর সম্ভবনা উড়িয়ে দেয়া যায়না!

ন্যাশনাল পর্যায় জরিপে দেখানো হচ্ছে, বাইডেন ৮% পয়েন্টে এগিয়ে আছেন (৫২-৪৪), যদিও এঁরাই আবার বলছেন, এরপরও ট্রাম্প জিততে পারেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হ’ন ইলেকটোরাল ভোটে, অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন জাতীয় পর্যায়ে হলেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হ’ন রাজ্য পর্যায়ে। ৫৩৮টি ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে যিনি ২৭০টি পান, তিনিই লটারী হিট করেন।

শনিবার, রবিবার ট্রাম্প ও জো বাইডেন আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত চষে বেড়িয়েছেন। ট্রাম্পের জনসভায় করোনা উপেক্ষা করে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ যোগদান করছে। বাইডেন তেমন বড় জনসভায় যোগ দিচ্ছেন না? এবারকার নির্বাচন হচ্ছে, ট্রাম্প ভার্সেস এন্টি ট্রাম্প সমর্থকদের মধ্যে, বাইডেন বড় কোন ফ্যাক্টর নন?

নির্বাচনে উভয় পক্ষ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি’র আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। ডেমোক্রেটরা বলছেন, ট্রাম্প পরাজিত হলে ক্ষমতা ছাড়বেন না, তাই সংঘাত অনিবার্য। রিপাবলিকানরা বলছেন, বাইডেন জিতলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক হবে। অনেকের অভিযোগ, রাশিয়া ও ইরান এবার মার্কিন নির্বাচনে নানান ভাবে প্রভাব বিস্তারে চেষ্টা করছে?

ফ্লোরিডা ও টেক্সাস এবার নির্বাচনে কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। ফ্লোরিডা কে জিতবে তা কেউ নিশ্চিত নন, টেক্সাসও তাই? তবে ‘কুক পলিটিক্যাল রিপোর্ট এবং ‘ইনসাইড ইলেকশন’ বলেছে, টেক্সাস নীল বা বাইডেন’র পক্ষে যাচ্ছে। ভার্জিনিয়া ইনভার্সিটির ল্যারি সাবাটা উল্টো বলছেন, টেক্সাস লাল হচ্ছে। টেক্সাসের ইলেকটোরাল ভোট ৩৮টি, বাইডেন টেক্সাস জিতলে হোয়াইট হাউস জিতবেন।

ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউস থাকতে হলে টেক্সাস ও ফ্লোরিডা জিততে হবে? আমার ধারণা তিনি জিতবেন। ২০১৬-তে যারা ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন, তাঁরা এখনো ট্রাম্পের পেছনে এককাট্টা। কালোদের ভোট এবার তিনি বেশি পাবেন। কোভিড ব্যাতিত তাঁর বিরুদ্ধে বলার কিছু নেই? কোভিড’র আগে বেকারত্ব ছিলো সর্বনিন্ম ৩.৬%, অর্থনীতি ছিলো তেজিঘোড়া। বহির্বিশ্বে ট্রাম্প জনপ্রিয় নন, কিন্তু তিনি সঠিক।

পেনসিলভানিয়ায় এক বিশাল সমাবেশে ট্রাম্প বলেছেন, বাইডেন শুধু কোভিড, কোভিড করছেন, এ ছাড়া তাঁর আর কিছু বলার নেই! তিনি বলেন, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ভ্যাকসিন আসছে। তিনি আরো বলেন, আমরা পেনসিলভানিয়া জিতলে রেস্ ওভার, আমরা হোয়াইট হাউস জিতবো। বাইডেন বলেছেন, ট্রাম্প যাই বলুক না কেন, জনগণকে আর ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছেনা, মানুষ পরিবর্তন চায়।

বর্তমানে হাউস বা কংগ্রেস ডেমক্রেটদের দখলে, সিনেট রিপাবলিকানদের। দুই প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর বয়স ৭০’র কোটায়, ট্রাম্প ৭৪, বাইডেন ৭৮। ১৮ বছরের মার্কিন নাগরিক ভোটার হতে পারেন। ভোট দিতে হলে বৈধ পরিচয়পত্র দেখাতে হয়। এবার কংগ্রেসের পুরো ৪৩৫টি আসনে নির্বাচন হচ্ছে, কিছু সিনেট, গভর্নর পদে লড়াই হচ্ছে। ট্রাম্প ও রিপাবলিকানরা আশা করছেন, তাঁরা এবার হাউসে জিতবেন। বাইডেন বা ডেমোক্রেটরা আশা করছেন, হাউস, সিনেট, হোয়াইট-হাউস তাঁরা জিতবেন।

ব্যাটেলগ্রাউন্ড ষ্টেট

১২ থেকে ১৫টি ষ্টেট ব্যাতিত প্রায় সকল ষ্টেট মূলত: ডেমক্রেট (নীল) বা রিপাবলিকান (লাল) শিবিরভুক্ত। ঐ ষ্টেটগুলোকে ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড ষ্টেট’ বলা হয়ে থাকে এবং প্রার্থীরা ঐসব ষ্টেটে প্রচার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বলা হচ্ছে, এবার ১৩টি ব্যাটেলগ্রাউন্ড ষ্টেট? এগুলো হচ্ছে, ফ্লোরিডা, টেক্সাস, আরিজোনা, ওহাইও, আইওয়া, মিনেসোটা, মিশিগান, পেনসিলভানিয়া, উইসকনসিন, নেভাদা, নিউ হ্যাম্পশায়ার, জর্জিয়া ও নর্থ ক্যারোলিনা। ২০১৬-তে ট্রাম্প অন্তত: ১০টি ষ্টেটে জিতেছেন যেখানে ভোটের ব্যবধান ছিলো মাত্র ২%শতাংশ। এইসব ষ্টেটে ১২৫টি ইলেক্ট্রোরাল ভোট আছে। ট্রাম্প আগেরবার জেতা ৬টি টেস্ট যেমন আরিজোনা, ফ্লোরিডা, মিশিগান, পেনসিলভানিয়া, উইসকনসিন, ও নর্থ ক্যারোলিনা পুনরায় জয়ের জন্যে সর্বস্ব পন করে মাঠে নেমেছেন। এসব ষ্টেটে ১০১টি ভোট আছে। একইভাবে বাইডেন ২০১৬-তে হিলারি ক্লিনটন জেতা ৪টি ষ্টেট, মেইন, মিনেসোটা, নিউ হ্যাম্পশায়ার ও নেভাদা ধরে রাখতে সচেষ্ট, যেখানে ২৪টি ইলেকটোরাল ভোট আছে।

ওহাইও, না জিতে রিপাবলিকানরা কখনো প্রেসিডেন্ট হননি। টেক্সাস নীল ষ্টেট নয়, বাইডেন টেক্সাস জিতলে তা হবে ট্রাম্পের জন্যে ব্লো-আউট। নর্থ ক্যারোলিনার ১৫টি ভোট ট্রাম্পকে জিততেই হবে? নেভাদা লাল থেকে নীল হয়েছে, বারাক ওবামা-বাইডেন জুটি এ কাজটি করেছেন। এবারো কি নীল থাকবে? পেনসিলভানিয়ায় জিতে ট্রাম্প ২০১৬-তে হোয়াইট হাউসে যাবার সৌভাগ্য অর্জন করেন। ১৯৮৮-তে জর্জ এইচ, ডবলু বুশ জয়ী হবার পর ট্রাম্প প্রথম রিপাবলিকান যিনি পেনসিলভানিয়া জেতেন। উইসকনসিনে হিলারি হেরেছেন এবং ১৯৮৪’র পর ট্রাম্প একমাত্র রিপাবলিকান যিনি সেখানে জয় পেয়েছেন। মিশিগান ডেমক্রেট ফেভারিটি, ২০১৬-তে ট্রাম্প জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন। মিনেসোটা ২০১৬-তে ১.৫% ভোটে হিলারিকে সমর্থন দিয়েছিলো। ব্যবধান সামান্য, ভোট ১০টি? নিউ হ্যাম্পশায়ারের ৪টি ইলেকটোরাল ভোট আছে, ডেমক্রেটরা গত চারটি নির্বাচনে জিতেছেন, এবার কি ট্রাম্প জিতবেন?

ইলেকটোরাল ভোট

জনগণের সরাসরি ভোটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হ’ন না? তিনি নির্বাচিত হ’ন, ইলেকটোরাল ভোটে। ৫৩৮টি ইলেকটোরাল ভোট আছে, এরমধ্যে যিনি ২৭০টি ভোট পান, তিনি নির্বাচিত হন। এজন্যে ২৭০-কে ম্যাজিক নাম্বার বলা হয়! জনসংখ্যা অনুযায়ী প্রতিটি ষ্টেটের কিছু ইলেকটোরাল ভোট থাকে। যেই প্রার্থী যেই ষ্টেটে জয়ী হ’ন তিনি সেই ষ্টেটের সবগুলো ইলেকটোরাল পান। তবে মেইন ও নেব্রাস্কায় ইলেকটোরাল ভোট ভাগাভাগি হয়ে থাকে। মেইনে ৪টি এবং নেব্রাস্কায় ৫টি ইলেকটোরাল ভোট রয়েছে। ইলেকটোরাল ভোট-ব্যবস্থার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে আল গোর এবং হিলারী ক্লিন্টন পপুলার ভোটে জিতেও প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। ছোট-বড় সকল ষ্টেটের সমান গুরুত্ব বহাল রাখতে মার্কিন রাষ্টের প্রতিষ্ঠাতারা এ ব্যবস্থাটি করে গেছেন। একই ভাবে এবং একই কারণে প্রতি ষ্টেট থেকে দুইজন সিনেটর নির্বাচিত হয়ে থাকেন।

আমেরিকান-ইন্ডিয়ান ও বাংলাদেশিদের অবস্থান

আমেরিকান-ইন্ডিয়ান ভোট এবার মিশিগান, পেনসিলভানিয়া এবং উইসকনসিন-এ ফ্যাক্টর হতে পারে। শুধুমাত্র মিশিগানে ১লক্ষ ২৫হাজার ইন্ডিয়ান ভোট আছে। পেসিলভানিয়াতে ইন্ডিয়ান আমেরিকান ভোট ১লক্ষ ৫৬হাজার। ২০১৬-তে ট্রাম্প প্রায় ৪৩হাজার ভোটে জিতেছেন। উইসকনসিনে ভারতীয় ভোট ৩৭হাজার, ট্রাম্প জিতেছিলেন ২১হাজার ভোটে। ২০১৬-তে ভারতীয় এবং সামগ্রিকভাবে হিন্দুদের ভোট ট্রাম্প পেয়েছেন। জো বাইডেন হয়তো কালো এবং ভারতীয় ভোট ধরে রাখতে কমলা হ্যারিসকে তাঁর রানিং-মেট করেছেন। ভারতীয়দের জন্যে সুবিধা হচ্ছে, ট্রাম্প জিতলে ভালো, কমলা হ্যারিস মর্থক, ২০১৬-র তুলনায় এবার বাংলাদেশিদের মধ্যে ট্রাম্পের সমর্থন অনেক বেড়েছে। বেশিরভাগ বাংলাদেশী সংখ্যালঘু ট্রাম্পের সমর্থক।

ট্রাম্পের সাফল্য

পেনডেমিকের আগে মার্কিন অর্থনীতি ছিলো যথেষ্ট চাঙ্গা, বেকারত্ব ছিলো সর্বনিন্ম ৩.৬%, তিনি ৬৭ লক্ষ নুতন চাকুরী সৃষ্টি করেছিলেন, জ্বালানি তেলে পরনির্ভরতা কমিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছেন, ডেমক্রেট রাজ্যে ক্রাইম বাড়লেও সামগ্রিকভাবে তিনি অপরাধ ১৫% নামিয়ে এনেছেন। সীমান্ত রক্ষায় সফল ও অবৈধ অনুপ্রবেশ একরকম বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন, আরব-ইসরাইল চুক্তি, তালেবান-আফগান চুক্তি স্বাক্ষরে তাঁর অবদান অসীম। সবচেয়ে বড় কথা তিনি কোন যুদ্ধে জড়াননি। শান্তির পক্ষে তাঁর এই অবদানের জন্যে তিনি দু’বার নোবেল শান্তি পুরুস্কারের জন্যে মনোনীত হয়েছেন, যদিও পা’ননি। তার আমলে জিডিপি বছরে প্রায় ৫% বৃদ্ধি পেয়েছে, জাতীয় রাজস্ব ১৭.৭৩ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২১.৪৩ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিলো, যদিও করোনা’র কারণে এখন সেটি দেখা যাচ্ছেনা।

(এস/এসপি/নভেম্বর ০২, ২০২০)