বরিশাল থেকে তপন বসু : জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাত হ্রাস ও বিভিন্ন নদ নদীতে বাঁধের পর দেশে পানি প্রবাহের প্রধান উৎস পদ্মা ও মেঘনায় স্রোত কমে শাখা নদীগুলোতে পলি জমায় স্রোতহীন হয়ে প্রতিবছর অসংখ্য ছোট-বড় চর জেগে নাব্যতা হারাচ্ছে নদীগুলো। ফলে পানিশূন্য হয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের তিন হাজার কিলোমিটার নৌ-পথ এখন মরণফাঁদে রূপ নিয়েছে। এরমধ্যে ১৪’শ কিলোমিটার নৌ-পথ ইতোমধ্যে নাব্যতা হারিয়ে নৌ-যান চলাচলের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। নাব্যতা সংকটের ফলে বন্ধ হয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২৮টি নৌ-রুট। বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে আরো তিনটি রুট।

দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্নস্থানে যাতায়াত ও পন্য আমদানি-রপ্তানীর সহজ যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌ-পথ। বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলা ও ৪০টি উপজেলার কয়েক কোটি মানুষকে ৮৮টি নৌ-রুটের ওপর ভরসা করেই যাতায়াত করতে হয়। এরমধ্যে শীত ও শুস্ক মৌসুমে নাব্যতা হারিয়ে ইতোমধ্যে ২৮টি রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ৩৮টি রুটে ডাবল ডেকার লঞ্চ চলাচল করলেও বাকি অভ্যন্তরীণ রুটগুলোতে চলাচল করে এমএল টাইপের লঞ্চ।

বিআইডব্লিউটিএ’র হিসেবে প্রতিদিন গড়ে লক্ষাধিক লোক এসব রুটে যাতায়াত করে থাকে। প্রতিবছর শুস্ক মৌসুমে ১৪’শ কিলোমিটার নৌ-পথই থাকে চলাচলের অনুপযোগী। নাব্যতা সংকটের কারণে ৫টি নদীর প্রায় ৩৫ কিলোমিটার এলাকায় নৌ-চলাচল বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি এসব অঞ্চলের ব্যবসায়ী নৌ বন্দরগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাব্যতা সংকটে নদীর বিভিন্ন অংশে অসংখ্য চর ও ডুরোচর জেগে উঠেছে। জেগে ওঠা চরে স্থানীয়রা ধানসহ অন্যান্য ফসলের চাষাবাদ করছেন। এছাড়াও নাব্যতা সংকটে কবি জীবনানন্দের ধানসিঁড়ি নদীটিও এখন মরা খালে রূপ নিয়েছে। নাব্যতা সংকটের কারনে অনেকেই ফারাক্কার বাঁধকে দায়ী করলেও যৌথ নদী কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ভারতের ফারাক্কা ও বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ সেতু পয়েন্টে এ বছর বাংলাদেশ যে পরিমাণ পানি পেয়েছে তা গঙ্গা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রাপ্য হিস্যার চেয়ে অনেক বেশি। তার পরেও নদীর করুন অবস্থা নিয়ে বিশেষ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য তথ্য। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআইডব্লিউটিএ’র এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, শুধু দক্ষিণাঞ্চলের ১৪’শ কিলোমিটার নয়; সারাদেশে ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌ-পথ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান-এমপি জানান, দেশের সরকারি ও বেসরকারি সব ড্রেজার মেশিনগুলো বছরের বারো মাসই নদী ড্রেজিংয়ের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। তার পরেও নদীর যে অবস্থা তাতে নাব্যতা ধরে রাখার জন্য আরও দ্বিগুণ ড্রেজারের প্রয়োজন। সরকারের আরো নতুন ড্রেজার ক্রয়ের পরিকল্পনা রয়েছে বলেও তিনি জানান।

বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, নদীতে এমএল টাইপের লঞ্চ চলাচলের জন্য কমপক্ষে ৮ থেকে ৯ফুট পানি প্রয়োজন, ডাবল ডেকার লঞ্চের জন্য প্রয়োজন ১৪ থেকে ১৫ফুট পানি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গত ডিসেম্বর মাস থেকে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বৃষ্টিপাত হ্রাস পাওয়ায় অব্যাহতভাবে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে পানি কমতে থাকে। একইসাথে শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে এসব অঞ্চলের শাখা নদীগুলো। সূত্রমতে, কীর্তনখোলা, লোহালিয়া, বিষখালী, পায়রা, নিশিন্দা, ইলিশা, কালাবদর, তেঁতুলিয়া, গণেষপুরা, সন্ধ্যা, সুগন্ধা, আড়িয়াল খাঁ, ঝুনাহার, ধানসিঁড়ি, পয়সারহাট ও পালরদী নদীর পানি কমে নদীতে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। বরিশাল থেকে ঢাকাগামী ভাষানচর ও চরনাইন্দা, পয়সারহাট থেকে ঢাকাগামী মীরেরহাট, বিষারকান্দি-হারতাসহ মেহেন্দিগঞ্জের কয়েকটি চ্যানেলের অবস্থা খুবই নাজুক। বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে বরিশাল-ভোলা নৌ-রুট। ওই রুটের সাহেবেরহাট ও লাহারহাট পয়েন্টে নাব্যতা কমে যাওয়ায় দুধল, দাঁড়িয়াল, বাকেরগঞ্জ, চরামদ্দি, বলাইকাঠী, চন্দ্র মোহন, বুখাইনগর, মেহেন্দিগঞ্জ রুটের লঞ্চ চলাচলও বন্ধ হতে চলেছে। বরিশাল-ভোলা রুটের লঞ্চগুলোকে বিকল্প পথে লাহারহাট অথবা চরমোনাই হয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে পালরদী নদীর টরকী থেকে এখন আর সরাসরি ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাচ্ছেনা কোন যাত্রীবাহী লঞ্চ। এককালের ভয়ংকর পালরদী নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে গত ছয়মাস ধরে লঞ্চগুলোকে টরকী থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরত্বে কয়ারিয়া নামক এলাকায় নোঙ্গর করতে বাধ্য হচ্ছে। ঢাকা-বরিশাল রুট কিংবা বরিশাল-চট্টগ্রাম রুটের জন্য নেই কোন বিকল্প চ্যানেল। ফলে এসব রুটের বড় নৌ-যানকে জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভর করেই যাতায়াত করতে হয়।
বরিশাল নৌ-বন্দরে ডুবোচর ঃ বরিশাল নগরীর আধুনিক নৌ-বন্দর সংলগ্ন কীর্তনখোলা নদীর প্রায় অর্ধ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ডুবোচরের সৃষ্টি হয়েছে। আধুনিক নৌ-বন্দর টার্মিনাল ঘেঁষে এ ডুবোচর জেগে ওঠার কারণে যাত্রীবাহী নৌ-যানগুলো ঘাটে নোঙ্গর করা ও ছেড়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। ২০০৮ সাল থেকে ওই এলাকা নৌ-যান চলাচলের উপযোগী করার জন্য প্রতিবছরই ড্রেজিং করতে হয়। শীতকালে ড্রেজিং করার পর বর্ষাকালে পলি পড়ে জমাট হয়ে আবার দেখা দেয় নাব্যতা সংকট। ড্রেজিং করতে বিআইডব্লিউটিএ’র কোটি কোটি টাকা খরচ হলেও কীর্তনখোলার নাব্যতা ধরে রাখা যাচ্ছে না। নৌ-যান চালকেরা অভিযোগ করেন, প্রতিবছর শীত মৌসুমে নামেমাত্র ড্রেজিং করা হয়। এ কারণেই সমস্যার সমাধান হয় না। ড্রেজার দ্বারা নদীর বালু কেটে আবার পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। খনন করা বালি স্থলভাগে তুলে ফেলা হলে সংকট কিছুটা হলেও নিরসন করা সম্ভব বলেও তারা জানান। ডুবোচরের কারনে নৌ-বন্দর থেকে জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভর করেই যাত্রীবাহী লঞ্চগুলোকে ঘাটে নোঙ্গর করতে হয়। আবার সেভাবেই যাত্রী নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে রওয়ানা দিতে হয়।
বন্ধ হয়ে গেছে নদী নির্ভর জীবিকা: এক সময় দক্ষিণাঞ্চলের ভাটি এলাকার মানুষের আয়ের একমাত্র অবলম্বন ছিল যে নদী তা এখন ছোট খাল বা নালায় পরিনত হয়েছে। কিছুকাল আগেও বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলা ও ৪০টি উপজেলার কয়েক কোটি মানুষের প্রধান যাতায়াতের মাধ্যম ছিল নৌ-পথ। বিআইডব্লিউটি’র সূত্র মতে, তখন ৮৮টি নৌ-রুটে একতলা লঞ্চ চলাচল করতো। এর বাইরেও সাধারণ নৌকা ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা ছিল যাতায়াতের মাধ্যম। খেয়ামাঝিরা যাত্রী পারাপার করে জীবন যাপন করতেন। এ অঞ্চলের মানুষ আগে গয়না নৌকায় চড়ে দূর-দূরান্তে যাতায়াত করতো। বিশাল বিশাল নৌকায় মালামাল পরিবহন করা হতো। গয়না নৌকাযোগে মানুষ শহর-বন্দরে যাতায়াত করতো ও জিনিসপত্র আনা-নেয়া করতো। ভোররাতে বিভিন্ন গ্রাম থেকে গয়না নৌকা যাত্রী নিয়ে শহরের উদ্দেশে রওয়ানা হতো। গয়না নৌকা চলাচলে আবার সময়সূচীও ছিলো। কোনটা সকালে, কোনটা বা বিকেলে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতো। ছুঁইওয়ালা নৌকায় চড়ে গ্রামের বধূরা বাবার বাড়ি-শ্বশুর বাড়ি যাতায়াত করতো। এ ধরনের নৌকাকে বলা হতো নাইয়রি নৌকা। সেই নদী, নৌকা, মাঝি, পানি ও নাইয়র নিয়ে অসংখ্য গানও রয়েছে গ্রাম বাংলার জনপ্রিয়তায়। কয়েক যুগ আগেও মাঝিদের গাওয়া ভাটিয়ালী সুর মায়াজাল বুনতো নদী তীরের বাসিন্দাদের। তবে সেসব এখন কেবলই বেদনা জাগানো সুখস্মৃতির মত নাড়া দেয় এ অঞ্চলের প্রবীণ ব্যক্তিদের মনকে। বৈঠার শব্দে কোষা নৌকা বা মাঝিমাল্লার গুন টেনে নৌকা যাওয়ার দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় নৌকার যাত্রী আর মাঝিমাল্লারা যেন উল্টো সুরে বলছেন, মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে আমি আর বাইতে পারলাম না। গয়নার নৌকার পর বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর ও ঝালকাঠীর অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচল করতো এমএল টাইপের লঞ্চ। এখন তাও অধিকাংশ গুটিয়ে গেছে। সূত্র মতে, হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মেঘনা নদী দিয়ে একসময় শরীয়তপুরের পট্টি পর্যন্ত যাতায়াত করতো একতলা লঞ্চ। ভাষাণচর, হিজলা, শৌলা, লালখারাবাদ, লতা, আন্ধারমানিক ও খুন্না বাজারের মতই বরিশাল-ভোলা রুটে অসংখ্য যাত্রীবাহী লঞ্চ কালাবদর, আড়িয়াল খাঁ নদী অতিক্রম করে যাতায়াত করতো। কালাবদর ও বিষখালী নদী পাড়ি দেয়ার সময় যাত্রীদের সাথে লঞ্চ স্টাফরাও প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে সৃষ্টিকর্তার নাম জপতো। এখন এসব রুটে এমএল টাইপের লঞ্চ চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় ৮-৯ ফুট পানি পর্যন্ত নেই। তাই অধিকাংশ লঞ্চ মালিকেরা এখন অন্য পেশায় ঝুঁকে পরেছেন। যারা লঞ্চ কিংবা নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারা নতুন পেশায় গিয়ে সুবিধা করতে পারছেননা। একাধিক নৌ-যান চালকেরা জানান, লোহালিয়া, বিষখালী, পায়রা, নিশিন্দা, আগুনমুখা, আন্ধারমানিক, লাউকাঠী, ইলিশা, গণেষপুরা, সন্ধ্যা, সুগন্ধা ও পালরদী নদীর নাব্যতা হারিয়ে গেছে। নদীর বুক চিড়ে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। সাহেবেরহাট ও লাহারহাট পয়েন্টে নাব্যতা কমে যাওয়ায় দুধল, দাঁড়িয়াল, বাকেরগঞ্জ, চরামদ্দি, বলাইকাঠী, চন্দ্রমোহন, বুখাইনগর ও মেহেন্দিগঞ্জ রুটের লঞ্চ চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশের ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌ-পথ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে নৌকা, ইঞ্জিনচালিত ট্রলার, লঞ্চ মালিক ও চালকেরা বেকার হওয়ার পাশাপাশি দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে হচ্ছে জেলেদের। মেঘনা, তেঁতুলিয়া, বুড়া গৌরগঙ্গা, বিষখালী, রামনাবাদ, আড়িয়াল খাঁ ও আগুনমুখা নদীর তীরবর্তী জেলেপল্লীর বাসিন্দাদের। দক্ষিণ উপকূলভাগের প্রায় ৩ লাখ পরিবার নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মৎস্য আড়ত, পাইকার ও শ্রমিক মিলিয়ে মৎস্য সম্পদকে কেন্দ্র করে বেঁচে আছে ৬ লাখেরও বেশি পরিবার। আমন ধান পাকলেই মাটির হাঁড়ি, পাতিল, কলসসহ অন্যান্য তৈজসপত্র নৌকায় তুলে বিভিন্ন গ্রামে বিক্রির জন্য ছুটে চলতেন ব্যবসায়ীরা। গত দুই যুগে নদীতে এসব পাল তোলা নৌকা চোখে পড়েনি বলে জানালেন, চরহোগলা গ্রামের এনছান মাঝি (৮০)। বেঁদে সম্প্রদায়ের লোকজন বংশ পরম্পরায় নদীতে বাস করতো। বেঁদে সম্প্রদায়ের নারীরা নদীতে জাল পেতে মাছ ধরতো। পুরুষরা সে মাছ হাট-বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাতো। তাদের নদীতেই জন্ম, নদীতেই বিয়ে, ঘর-সংসার ও মৃত্যু। এখন নদী শুকিয়ে যাওয়ায় বেঁদেরা নৌকা ছেড়ে ডাঙ্গায় উঠেছে। তারা এখন ডাঙ্গাতেই নতুন করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন।
দেশের ৭’শ টি নদীর মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর মধ্যে ৩০টি নদ-নদী পলি পড়ে ও চর জেগে নাব্যতা হারিয়েছে। এককালের খরাস্রোত নদ-নদীর বুক জুড়ে এখন শুধুই ধু-ধু বালুচর। প্রমত্তা মেঘনার বুকেও এখন অসংখ্য চর। আগে ভোলা ও লক্ষ্মীপুরের মধ্যবর্তী প্রমত্তা মেঘনার এক তীর থেকে অন্য তীর দেখা যেত না। এখন নদীর মাঝে জেগে উঠেছে একাধিক চর। যে রাক্ষুসে শাহবাজপুর নদী পাড়ি দিতে মাঝিমাল্লাদের বুক দুরু দুরু করতো, তা এখন মরা নদীতে রূপ নিয়েছে। মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার উলানিয়ার মেঘনায় জেগে উঠছে অসংখ্য চর। একইভাবে অসংখ্য চর জেগেছে হিজলা, চাঁদপুরসহ ঢাকা-বরিশাল রুটের বিভিন্ন স্থানে। বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে ঢাকা-বরিশাল-চট্টগ্রাম নৌ-রুট। একসময় বঙ্গোপসাগরের লোনা পানি ছেড়ে ইলিশ ডিম ছাড়তে শাহবাজপুর, মেঘনা ও কালাবদরের গভীর মিঠা পানির এলাকায় ছুটে আসতো। এখন নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় ইলিশ তার গতিপথ পরিবর্তন করে ছুটছে মিয়ানমার সীমান্তের নদীগুলোতে। একসময় রূপালী ইলিশের মৌসুমকে কেন্দ্র করে শত কোটি টাকার লেনদেন হতো দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে। এখন নদী মানেই লাখো পরিবারের দীর্ঘশ্বাস। নদীর পানির সাথে পলি জমে মাটি উর্বর হতো। তাতে সোনার ফসল ফলতো। এ কারণে বাংলার শস্য ভান্ডারের খেতাব পেয়েছিল বরিশাল। সেই বালাম চালের দিন আর নেই। নদীতে পানি নেই তাই আর তেমন ফসলও হয় না। কীর্তনখোলা নদীর কালীবাবুর খেয়াঘাট ইতোমধ্যে ভরাট হয়ে গেছে। বেঁদে বহরে থাকা দুলাল সরদার ও মকবুল সরদারসহ তাদের গোত্রের লোকজন জল ছেড়ে এখন ডাঙ্গায় আবাস গড়েছেন। নদীর তীরবর্তী রাজারচর গ্রামে এখন প্রায় অর্ধশত বেঁদে পরিবারের বসবাস। সরকারি ভিজিএফ এবং ভিজিডিসহ নানান সাহায্য নিয়ে তাদের জীবন চলে। প্রতিবেশীরা তাদের ওই এলাকাটিকে বেবাইজ্যা বাড়ি বলে সম্বোধন করে। এখন পালরদী নদীর টরকীরচর এলাকায়ও শতাধিক বেঁদে পরিবার স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন।
ঝালকাঠী শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গাবখান চ্যানেলকে বলা হয় বাংলার সুয়েজ খাল। এ চ্যানেলকে ঘিরেই এক সময়ে বরিশাল-ঝালকাঠী ও মংলা বন্দরের মাঝে অনেকস্থানে ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র গড়ে ওঠে। তখন ভারতের হলদিয়া বন্দর থেকে পণ্যবাহী জাহাজ মংলা বন্দর হয়ে গাবখান চ্যানেল দিয়ে ঝালকাঠী ও চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাত। যাত্রীবাহী জাহাজগুলো হলদিয়া বন্দর থেকে বরিশাল হয়ে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত যাতায়াত করতো। সেসব এখন রূপকথার মত শোনায়। গাবখান চ্যানেল ড্রেজিং করেও সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। চ্যানেলে দু’প্রান্ত থেকে দু’টি জাহাজ একত্রে ঢুকলে দুর্ঘটনা অনিবার্য। ঝালকাঠীর যে নদী নিয়ে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ বিখ্যাত কবিতা লিখেছিলেন সেই ধানসিঁড়ি এখন মরা খালে রূপ নিয়েছে। নগরীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বিশাল ঝুনাহার নদীটি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনী প্রথম বরিশাল আক্রমণ করেছিল। ওই নদীতে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানীদের একটি বড় জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিল। এখন বড় জাহাজ তো দূরের কথা ওই নদীটি দিয়ে ছোট নৌকাও ঢুকতে পারে না। সূত্রমতে, এক সময়ে সারাদেশের নৌ-যানসমূহ বরিশাল থেকে ঝালকাঠী হয়ে গাবখান চ্যানেল অতিক্রম করে পিরোজপুরের কাউখালী থেকে বলেশ্বর নদী পাড়ি দিয়ে পানগুছি নদীর পথ ধরে মংলা-খুলনা ও নওয়াপাড়ায় যাতায়াত করতো। কিন্তু বছর তিনেক পূর্বে মংলার ঘাশিয়াখালী চ্যানেলটির নাব্যতা হারানোর ফলে রায়েন্দাবগি হয়ে সুন্দরবনের অভ্যন্তর দিয়ে অতিরিক্ত ৫০ কিলোমিটার নদী পাড়ি দিয়ে জয়মনিগোল হয়ে মংলায় পৌঁছতে হচ্ছে সব ধরনের পণ্য ও জ্বালানিবাহী নৌ-যানসমূহকে। ফলে সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীব বৈচিত্রের ওপর ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সূত্রমতে, বিষয়টি নিয়ে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে গত কয়েক বছর ধরে ঠান্ডা লড়াই চললেও কোন দৃশ্যমান উন্নতি হয়নি।
নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে ঝালকাঠীসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাণিজ্যকেন্দ্রগুলোও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়কপথে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদিত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শিল্প কারখানাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শ্রমিকেরা হয়ে পড়ছেন বেকার। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে নদীর ওপর ভিত্তি করে এ অঞ্চলে নির্মিত গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্প (জিকে প্রজেক্ট), সঞ্জুরী প্রজেক্ট, মধুমতি-মাদারীপুর বিল রুট ক্যানেল সেচ প্রকল্প (এমবিআর প্রজেক্ট), বরিশালের উজিরপুর ও আগৈলঝাড়ার সাতলা-বাগধা সেচ প্রকল্প, বরিশাল-ঝালকাঠী ও পিরোজপুরের ইরিগেশন প্রকল্পসহ অসংখ্য সেচ প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। বছরের পর বছর প্রকল্পভুক্ত বিস্তীর্ণ ফসলী জমি অনাবাদী থাকায় উৎপাদন কমে গেছে। এছাড়াও পালরদী নদীতে নব্যতা সংকট দেখা দেয়ায় এখন আর ঢাকা থেকে সরাসরি টরকীতে লঞ্চ আসা যাওয়া করতে পারছেনা। অথচ এক সময় পালরদী নদীতে সরাসরি কোলকাতা থেকে জাহাজ ও স্টীমার আসা যাওয়া করতো, সেসব এখন স্রেফ গল্পের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নদীটির কারনেই টরকী, গৌরনদী ও পিঙ্গলাকাঠীতে গড়ে ওঠে ব্যবসায়ীক বন্দর। নদীর নাব্যতা সংকটে নৌ-যান চলাচল করতে না পারায় বন্দরের ব্যবসায়ীরা সহজে মালামাল পরিবহন ও পাইকাররা নৌ-পথে বন্দরে আসতে না পারার কারনেই ঝিমিয়ে পরেছে ওইসব বন্দরের ব্যবসায়ীরা। একই অবস্থা সুগন্ধা নদীর মীরেরহাট ভায়া হারতা-পয়সারহাট নদীর। ওই নদীর অধিকাংশ এলাকায় অসংখ্য চর জেগে ওঠায় নৌ-যান চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে নদীর তীরবর্তী পয়সারহাট ও হারতা বন্দর দুটির ব্যবসায়ীরাও ঝিমিয়ে পরেছে।
সরকারি হিসেবে সারাদেশে নদীর সংখ্যা ৭’শ বলা হলেও বিআইডব্লিউটিএ’র সূত্রমতে, এটি ১৯৫৫ সালের তথ্য। অর্ধশত বছরে বেশ কয়েকটি নদী একেবারেই ভরাট হয়ে গেছে। কোনটি সরু খালেও পরিণত হয়েছে। বর্তমানে সার্বক্ষণিক নৌ-যান চলাচলের জন্য মাত্র ২১২টি নদীতে প্রয়োজনীয় নাব্যতা রয়েছে। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসেব মতে, ৩১০টি নদীর নাব্যতা রয়েছে। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী এক সময় উল্লেখযোগ্য নদ-নদীর মধ্যে ছিলো আগরপুর, পালরদী, সন্ধ্যা, সুগন্ধা, আড়িয়াল খাঁ, কালা বদর, আগুন মুখা, বলেশ্বর, বিষখালী, খাতাপোড়া, খাতা ছেড়া, ঝুনাহার, ইলিশা, পয়সারহাট ও বুড়া গৌরগঙ্গ নদীতে বর্তমানে স্রোত নেই। বাংলাদেশ নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, ঋতু পরিবর্তন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ফারাক্কা বাঁধের পর পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় ছোট নদীগুলোতে আগাছা, কচুরিপানা ও পলি জমে ভরাট হতে থাকে। নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩০টি নদীর পানি প্রবাহের প্রধান উৎস পদ্মা ও মেঘনায় স্রোত কমে যাওয়ায় এসব শাখা নদীতে এর প্রভাব পড়েছে। এ শাখা নদীগুলো স্রোতহীন হয়ে পড়ায় বর্ষায় নদীবক্ষে জমা হওয়া পলি অপসারিত হচ্ছে না। ফলে প্রতিবছর জেগে উঠছে অসংখ্য ছোট-বড় চর। নদীগুলো হারাচ্ছে নাব্যতা। পলি জমে নদ-নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ায় এ অঞ্চলে মৎস্য সম্পদও উজাড় হতে চলেছে। মিঠা পানির কমপক্ষে ৫০ প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে। কৃষি, মৎস্য, শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষেত্রেও ক্রমাবনতির কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ধ্বস নেমেছে। বেড়েছে এ অঞ্চলে দারিদ্র্যের হার। পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীর নাব্যতা হারিয়ে যাওয়ায় কৃষি, মৎস্য, পশু সম্পদ, নদীর সাথে সম্পৃক্ত শিল্প কারখানা, পরিবেশ সম্পূর্ণ বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। নদী বেষ্টিত এলাকাগুলোর পরিবেশের জন্য মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া বয়ে আনবে। হুমকির মুখে পড়বে জীববৈচিত্য।
এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ’র ড্রেজিং পরিদফতরের সাথে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সিনিয়র অফিসার বলেন, আমাদের নৌ-পথের তুলনায় ড্রেজারের সংখ্যা এখনও অনেক কম। ফলে একদিকে পলি অপসারণ করে অন্যদিকের পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এরপরেও গাবখান চ্যানেল উন্নয়নের বিষয়টি অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে। খুব শীঘ্রই যাতে গাবখান চ্যানেলটির রক্ষণাবেক্ষণ ও ড্রেজিং শুরু করা যায় সেলক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও ওই অফিসার উল্লেখ করেন। অন্যদিকে একই দফতরের নৌ-পথ সংরক্ষণ বিভাগের বরিশাল আঞ্চলের এক কর্মকর্তা দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীর নাব্যতা সংকটের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, বিশেষ করে গাবখান চ্যানেলটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। কারণ এর সঙ্গে দেশের দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর ছাড়াও খুলনা ও নওয়াপাড়া নদী বন্দরসহ পিরোজপুর এবং বাগেরহাট এলাকার নৌ-যোগাযোগ নির্ভরশীল। জনগুরুতপূর্ণ এ চ্যানেলটিসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীর সার্বিক পরিস্থিতি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
(এএস/এপ্রিল ১৯, ২০১৪)