নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার


মানুষের মৌলিক অধিকার গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শিক্ষা । আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে মানুষকে খেয়ে বাঁচার জন্য চেষ্টা করতে হয় প্রতিনিয়ত সেখানে দেশের পক্ষে শিক্ষায় গৃহীত কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা আরো জটিল। তারপরও সরকার চেষ্টা করছে না একথা বলা যাবে না তবে যেটুকু হচ্ছে সেটকুকে সীমিত আকারই হচ্ছে তা বলা চলে। জাতীয় বাজেটে যে বরাদ্ধ রাখা হয় তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। গত বাজেটে মোট ব্যয়ের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ এবং জিডিপির ২ দশমিক ০৯ শতাংশ বরাদ্ধ রাখা হয়। ইউস্কোর দাবী অনুযায়ী শিক্ষায় জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্ধ রাখা জরুরি। তারপরও যে বরাদ্ধ থাকে তার বেশির ভাগই চলে যায় অবকাঠামো নির্মাণ খাতে।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার একেক ধাপে একেক রকম সমস্যা বিদ্যমান। স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা দেশে একটি যুগোপযুগী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। যার ফলে গ্রাম এবং শহরের শিক্ষা ব্যবস্থায় দিন দিন ব্যাপক ফারাক তৈরি হচ্ছে এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বেকারত্বের বোঝা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক ধাপে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে ঠিক তেমনি মাধ্যমিক পর্যায়েও বিভিন্ন পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থা বিদ্যমান। সরকার প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান বৃদ্ধি এবং ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে আনার জন্য ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করছে এবং এর ফলও পেয়েছে।

প্রাথমিক পর্যায়ে শতভাগ বৃত্তি, খাবারের ব্যবস্থা, ড্রেসের জন্য অর্থ প্রদান, একাডেমিক ভবন নির্মাণ, পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, সর্বোপরি ২৬ হাজার রেজিস্ট্রার্ড বিদ্যালয়কে সরকারী করণ করে সরকার একটি বড় কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করেছে। এক কথায় বলা যায় যে এক্ষেত্রে সরকার ব্যাপক এক্ষেত্রে সফলতার পরিচয় দিয়েছে। এখন এ সফলতাকে ধরে রেখে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিক্ষার মান উন্নয়ন ঘটাতে হবে। আর এ ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে স্কুল পর্যায়ের যাবতীয় কাজ মনিটরিং বৃদ্ধি। মনিটরিং বৃদ্ধির মাধ্যমে মান বৃদ্ধি করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ । সঠিক মান নিশ্চিত করা না হলে বাকী সব অর্জন ম্লান হয়ে যাবে।

কেবলমাত্র প্রতিষ্ঠান সরকারি করেই শিক্ষার সুফল পাওয়া যাবে না। এতে হয়তো শিক্ষকদের জীবন যাত্রার মান নিশ্চিত হবে এবং ভালো সার্টিফিকেটধারী শিক্ষার্থীরা শিক্ষক হিসেবে আসবে কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার সংশোধন না হলে মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে জাতি। প্রতি উপজেলায় একটি কলেজ ও স্কুল সরকারিকরণের ফলে শিক্ষা ব্যবস্থায় জেলা এবং উপজেলার শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে গ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থায় আরো বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত হচ্ছে মাধ্যমিক স্তর। যে স্তরের ৯৬ ভাগই এমপিওভূক্ত। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত ব্যবস্থাপনা এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে সুযোগ সুবিধার অভাবে চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষার মান। একথা স্বীকার করার কোন সুযোগ নেই যে মানহীন সব ব্যবস্থা দিয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা অর্জিত হবে।

স্বাধীনতা পূর্ববর্তী এবং স্বাধীনতা পরিবর্তি কিছুটা সময় মানুষ নেশা হিসেবেই শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছিল। সময়ের পরিক্রমায় এটা এখন পেশা হয়ে উঠেছে। দেখা গেছে নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু হবার পূর্বে অনেকেই যখন কোন চাকুরির সুযোগ পায়নি তারা সর্বশেষ চাকুরি হিসেবে ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে এমপিওভূক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করেছে অর্থের মাধ্যমে। অথবা এমনও দেখা গেছে স্কুল স্থাপন করে নিজেরাই স্কুলে নিয়োগ নিয়েছেন। নিবন্ধন প্রক্রিয়ার পরও চলেছে টাকার খেলায় জয়ী হয়ে শিক্ষক হিসেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করা। প্রবেশ করার ধরনটা সঠিক না হলেও পরবর্তিতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পূর্বের সক্ষমতাকে পরিবর্তন করার সুযোগও পাচ্ছে না শিক্ষকরা। সামান্য যেটুকু পাচ্ছে সেটাও সঠিকভাবে প্রযোগ সম্ভব হচ্ছে না। এসব কারনে অনেক এমপিওভূক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ভালো কিছু পাওয়ার আশায় অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের দ্বারস্থ হচ্ছে। এমনকি মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়ছে। এই বিষয়টি গ্রামের চেয়ে শহরে আরো বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু কেন ?

শিক্ষার্থীরা যখন প্রাথমিক পর্যায় শেষ করে মাধ্যমিক স্তরে প্রবেশ করছে ঠিক সে সময় সঠিক সুযোগ সুবিধার অভাবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে যার ফলে শিক্ষা ব্যবস্থায় তৈরি হচ্ছে আরো বিশৃংখলা। এটা বেশির ভাগই লক্ষ্য করা যায় গ্রামীণ শিক্ষা ব্যবস্থায়। দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি করে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি করা হলেও শতকরা ৯৬ ভাগ প্রতিষ্ঠানই রয়েছে এমপিওভূক্ত হিসেবে। যার ফলে মাধ্যমিক স্তরে দেশের শিক্ষার্থীর প্রায় ৪ অংশ বাদে বাকি সবাই এমপিওভূক্ত ও প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করছে। শিক্ষা ব্যবস্থা এখন এত বেশি বাণিজ্যিক হয়েছে যে বিশেষ করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখি করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানের।

দেশের নাগরিক হিসেবে সকলেই সমান সুযোগ ভোগ করার কথা থাকলেও শহর এবং সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সম পরিমান সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে না এমপিওভূক্ত এবং গ্রামের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। গ্রামের অভিভাবকদের আর্থিক ক্ষমতা যেমন কম তেমনি শিক্ষায় বিনিয়োগের আগ্রহটাও শহরের মত নয় তাই প্রতিনিয়তই পিছিয়ে পড়েছে গ্রামের শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে করোনা কালে শহরের শিক্ষার্থীরা যেসব সুবিধা ভোগ করছে তার ধারে কাছেও নেই গ্রামের শিক্ষার্থীরা। এমপিওভূক্ত প্রতিষ্ঠানে আধুনিক শিক্ষায় কতটুকু চাপ নিতে সক্ষম তা কিন্তু করেনাকালে চোখে পড়েছে। এমপিওভূক্ত মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসম্পন্ন শিক্ষকের চলছে চরম সংকট। এনটিআরসিএ এর মাধ্যমে শিক্ষক ক্যাটাগরিতে নিয়োগের পরও ভালো মানের শিক্ষার্থীরা এমপিওভূক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসতে চাচ্ছে না।

বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় একজন মানুষকে মধ্যবিত্ত পর্যায়ে টিকে থাকার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন সে অর্থ বেতনের মাধ্যমে আশা করা যায় না। জীবনের বেশির ভাগ সময় একই প্রতিষ্ঠানে একই পদে চাকুরি শিক্ষাব্যবস্থায় ভালো শিক্ষার্থীদের শিক্ষক হতে অনাগ্রহী করে তুলছে। এছাড়াও এলাকায় চাকুরি , স্থানীয় প্রভাব প্রতিপত্তি এবং রাজনীতিতে বাঁধা নিষেধ না থাকায় অনেক শিক্ষকই প্রতিষ্ঠানের প্রতি মনোযোগি হচ্ছে না। বেশির ভাগ ভালোমানের শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা পেশা পছন্দের নিচের সারিতে অবস্থান করে। অনেক ক্ষেত্রেই এমপিওভূক্ত শিক্ষকতা পেশার চেয়ে সরকারি অফিসের তৃতীয় শ্রেণির পদের প্রতি আকর্ষণ থাকে চাকুরি প্রার্থীদের। তবে যেসব বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের প্রাইভেট পড়ানো যায় সেসব বিষয়ে ভালো মানের ছাত্রদেরও শিক্ষকতা পেশায় আসতে দেখা যায়। এক নম্বর পছন্দের তালিকায় নিষ্কন্টক ভাবে শিক্ষকতাকে রেখেছে তা অবশ্য বিরল। সারা বছর মাধ্যমিকের একটি প্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষককে প্রতিদিন প্রায় ৫ থেকে ৬ টি করে ক্লাস নিতে হচ্ছে।

প্রতিদিন এতগুলি ক্লাস নেয়ার পর কোন শিক্ষকের পক্ষেই ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাস নেয়া সম্ভব নয়। এমনকি শারীরিকভাবে অক্ষমতা ঘটতে থাকে শিক্ষকদের মাঝে। এছাড়াও মাধ্যমিক পর্যায়ে বিষয় ভিত্তিক শিক্ষকের অভাবে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে সঠিক শিক্ষা থেকে। প্রতি ক্লাসে এত পরিমাণ শিক্ষার্থী থাকে যে যা আদর্শ শিক্ষক শিক্ষার্থীর যে অনুপাত তার ধারে কাছেও নেই। এমপিওভূক্ত প্রতিষ্ঠানে নিচের ক্লাসে সেকশন অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগ হলেও এসব শিক্ষার্থীরা যখন উপরের ক্লাসে প্রবেশ করে তাদের জন্য আর শিক্ষক নিয়োগ হয় না। যার ফলে উপরের ক্লাসগুলোতে ১ থেকে ১শ ৫০জন শিক্ষার্থী নিয়ে ক্লাস করাতে হচ্ছে শিক্ষকদেরদের। এত শিক্ষার্থীদের নিয়ে একসাথে ক্লাস করালে শিক্ষার মান বজায় রাখা আদৌ সম্ভব নয়। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রটা এনটিআরসিএ এর হাতে থাকলেও যার দ্বারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হবে সেই প্রতিষ্ঠান প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রটা এখনও সঠিক প্রক্রিয়ায় আসে নি। চলছে টাকার খেলা নিয়োগে পাচ্ছে না যোগ্যরা। যদিও ক্ষেত্র বিশেষে ব্যতিক্রম হতে পারে তবে সার্বিক চিত্রটা ভয়াবহ। এছাড়া এমপিওভূক্ত মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় আরো বেশি বিশৃংখলা বিরাজ করছে। দিনের পর দিন এ শিক্ষা ব্যবস্থায় অবহেলার ফলে সঠিক শিক্ষার পথটাই যেন হারিয়ে ফেলেছে মাদ্রাসা ।

অনেক প্রতিষ্ঠানে দেখা যায় শিক্ষক থাকলেও শিক্ষার্থী সংকট চরমে। সাধারণ বিষয়ের শিক্ষকের এতটাই সংকট যে অনেক শিক্ষার্থীরাই মাদ্রাসা ছেড়ে স্কুলের শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়ছে। দিনের পর দিন একই পদে চাকুরি করার ফলে অনীহা জন্ম নিচ্ছে চাকুরির প্রতি। এরপর বেশিরভাগ এমপিওভূক্ত প্রতিষ্ঠানে রয়েছে মানহীন ব্যবস্থাপনা কমিটি যারা শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত নয়। এমনি কি অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যারা সদস্য হিসেবে কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে তারা স্কুলের গন্ডিও পেরোতে পারে নাই। তাদের কর্তৃক অযাচিত শাসন শিক্ষকদের মনের দিক দিয়ে দূর্বল করে তুলে। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় স্কুল কমিটির সভাপতির ক্ষেত্রে স্নাতক করা হলেও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারিত হয়নি আজও।

মাধ্যমিক পর্যায়ে উপবৃত্তি প্রদানের যে ব্যবস্থা রয়েছে তা নিয়ে বিশেষ করে গ্রামের প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানেই তৈরি হয় জটিলতা। মেধাবী এবং দরিদ্রদের উপবৃত্তি প্রদান করার কথা থাকলে স্থানীয় বিভিন্ন চাপে সব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এটাও আজ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। সর্বোপরি সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া এমপিওভূক্ত প্রতিষ্ঠানের বিশৃংখলা দূর করা সম্ভব না। সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এমপিওভূক্ত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান ফিরিয়ে আনতে সরকার ভূমিকা গ্রহণ করবে এটা শিক্ষক অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা বিশ্বাস করে। ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের এমপিওভূক্ত প্রতিষ্ঠান সমূহের ব্যবস্থাপনা আধুনিক না হলে বিশ্ব মানের শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব নয়।

লেখক :শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।