শরীয়তপুরে ২৫ হাজার জেলে পরিবারে হাহাকার
ইলিশের ভরা মৌসুমেও মাছ নেই পদ্মা-মেঘনায়
শরীয়তপুর প্রতিনিধি : ইলিশ ধরার ভরা মৌসুমেও মাছ নেই পদ্মা-মেঘনায়। ফলে জেলার ৬ টি উপজেলার মধ্যে ৪টি উপজেলার প্রায় ২৫ হাজার জেলে পরিবারে চলছে চরম অভাব। মহাজনের দাদনের টাকা পরিশোধ আর এনজিওর কিস্তি দিতে না পারায় জেলে পরিবারগুলোতে চলছে হাহাকার। আড়ৎদাররাও বিপাকে পরেছে কোটি টাকা দাদন খাটিয়ে।
শরীয়তপুরের জাজিরা, ভেদরগঞ্জ, গোসাইরহাট ও নড়িয়া উপজেলার বিস্তীর্ন এলাকা দখল করে আছে পদ্মা ও মেঘনা নদী। এই এলাকার অন্তত ৮০ কিলোমিটার নৌ সীমানা থেকে ব্যাপকভাবে আহরণ করা হয় ইলিশ মাছ। জৈষ্ঠ্য মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই জেলেদের জালে আটকা পরতে থাকে ইলিশ, পাঙ্গাস, আইর, বোয়ালসহ বিভিন্ন প্রকারের ছোট মাছ। পদ্মা, মেঘনা, আড়িয়ালখাঁ, কীর্তিনাশা, জয়ন্তিকা ও নীলাঞ্জনা নদীসহ অসংখ্য খাল-বিল থেকেও জেলেরা বিভিন্ন উপায়ে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে। আষাঢ় থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত জেলে পরিবারগুলো প্রাকৃতিক উৎস থেকে পর্যাপ্ত মাছ আহরণ করে। এতে নিজেরা যেমন অর্থ উপার্জন করে তেমনী ভোক্তা চাহিদা পুরনসহ জাতীয় রাজস্ব আয়েও সহায়তা করে থাকে ।
বড় নদীতে জেলেরা নৌকা বা মাছ ধরার ট্রলার ব্যবহার করে ইলিশ ও অন্য সব বড় মাছ শিকার করার পাশা পাশি ক্ষুদ্র মৎস্য আহরনকারীগন ছোট ছোট নদী, খাল ও বিল থেকে চাঁই, বইচনা, দোয়াইর ও ভেসাল পেতে বা বাধ দিয়ে এ মৌসুমে মাছ ধরে। কিন্তু এ বছর কোন উৎস থেকেই কোন প্রকার মাছ ধরা যাচ্ছে না। ফলে দরিদ্র মৎস্যজীবী জেলেরা পরেছে চরম অর্থ সংকটে। কারন বেশীর ভাগ জেলে জাল ও নৌকা ক্রয়ের জন্য আড়ৎদার, মহাজন ও এনজিও থেকে ১০-৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাদন ও ঋণ তুলে বসে আছে। মৌসুমের দুইমাস পার হয়ে গেলেও জেলেরা মহাজনের একটি টাকাও পরিশোধ করতে পারছেন না। এদিকে জেলার বিভিন্ন বাজারে চাষ করা পুকুর বা দীঘির মাছ ছাড়া অন্য কোন মাছ চোখে পরে না।
জেলার জাজিরা উপজেলার নাওডোবা, পূর্ব নাওডোবা, পালেরচর, কুন্ডেরচর, বড়কান্দি, নড়িয়া উপজেলার ঘড়িসার, চরআত্রা, নওপাড়া, ভেদরগঞ্জ উপজেলার কাচিকাটা, তারাবুনিয়া, আর্শিনগর, চরসেন্সাস, চরভাগা, সখিপুর, গোসাইরহাট উপজেলার আলাওলপুর, কুচাইপট্টি, কোদালপুর ও নলমুড়ি ইউনিয়নের পদ্মা ও মেঘনা নদীর বাকে বাকে প্রায় ৪০টি মাছের আড়ৎ রয়েছে। আড়ৎ মালিকেরা এবছর অন্তত ৫ কোটি টাকা জেলেদের দাদন দিয়েছে। কিন্তু মাছ ধরা না পরায় আড়ৎ গুলো প্রায় বন্ধ রয়েছে।
জেলা মৎস অধিদপ্তরের হিসেব মতে, জেলায় ১৬ হাজার মৎস্যজীবী দরিদ্র জেলে রয়েছে। এর বাইরেও আরো প্রায় ৯ হাজার জেলে আছে। এর মধ্যে আনুপাতিক হারে গোসাইরহাট উপজেলার চরজালালপুর, মাঝেরচর, চরজানপুর, বিশকাটালি, চরমাইজারা, মুলগাঁও, ফুসকাঠি, কুলচরিপাতারচর, কুলারগাঁও, মাইজারা, সাইখ্যা, বর্ষকাঠি ও মুশুরাগাঁও গ্রামের শতকরা ৭০টি পরিবার মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। গত ফেব্রুয়ারী থেকে মে মাস পর্যন্ত সরকার শরীয়তপুরের প্রায় ৫০ কিলোমিটার পদ্মা ও মেঘনা নদীর মূল সীমানায় মা ইলিশ ও জাটকা ধরা নিষিদ্ধ করেছিল। এ সময় ১২ হাজার জেলে পরিবারকে মাসে ৪০ কেজি করে চাউল ত্রান সহায়তা করেছে। এতে তাদের সাময়িক উপকার হলেও ভরা মৌসুমে নদীতে মাছ না থাকায় জেলেরা ঋন ও দাদনের চাপে দিশেহারা হয়ে পরেছে।
গোসাইরহাট উপজেলার কুলচরি পাতারচর গ্রামের জেলে দুদু মিয়া গাজী বলেন, গোসাইরহাট থেকে চাঁদপুর, চাদপুর থেকে চরতজুমদ্দিন পদ্মা মেঘনায় শত শত মাইল এলাকা ঘুরেও এই ভরা মৌসুমে জালে ইলিশ মাছ ধরতে পারছিনা। আমার ৪০ বছরের জেলে জীবনে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি।
কোদালপুরের নৌকা ও জালের মালিক মজিবুল হক মোল্যা বলেন, আমার দুইটি নৌকা ও জাল ভারা দিয়েছি। অন্যান্য বছর আষার-ভাদ্র মাসে জাল ও নৌকা ভারা দিয়ে সপ্তাহে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা আয় করতাম। এবছর কোন আয়তো হচ্ছেই না উপরন্ত জেলেদের খরচের টাকা দিতে হচ্ছে।
ভেদরগঞ্জ উপজেলার উত্তর তারাবুনিয়া এরাকার মাছ ধরার নৌকার মাঝি তোফাজ্জেল হোসেন রাড়ি বলেন, আমার নৌকায় ১৪ জন জেলে রয়েছে। এই একটা নৌকার উপর ১৪টি পরিবারের জীবন-জীবীকা নির্ভর করে। আড়ৎ মালিকের কাছ থেকে এক মাসের জন্য ৮০ হাজার টাকা দাদন এনেছি। ইলিশের মৌসুমে এবার নদীতে কোন মাছ ধরা পরছে না। প্রতিদিন নৌকায় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ আছে। মাঝে মধ্যে দুই চারটা ইলিশ ধরা পরলেও তাতে ডিজেলের খরচ মিটছে না।
কাঁচিকাটা এলাকার জেলে হারুন মিজি, তারাবুনিয়ার রশিদ পাইক, বিষকাটালির তাহেরালী মিয়া, বলেন, নদীর এপার থেইকা ওপারে যাই, বার বার পদ্মা মেঘনায় জাল ফ্যালাইছি। আবার জাল উডাইছি। কোন বার ২টা কোন বার ৫টা ইলিশ আটকাইতাছে। আড়ৎদার ও এনজিও’র কাছ থেকে হাজার হাজার টিয়া (টাকা) দাদন নিয়ে মহা বিপদে আছি। শাওন মাসেও যদি এই গাঙ্গে ইলিশ না পাই হেইলে কি খাইয়া বাঁচুম, দেনার চাপে বউ পোলা মাইয়া লইয়া পলাইয়া যাওয়া লাগবো।
কুচাইপট্টির আড়ৎ মালিক খোকা মিয়া বেপারী জানান, এলাকার শকরা ৮০ জন জেলে দাদন নিয়ে মাছ শিকার করে। এবছর প্রায় ৪’শ জেলে ও মাঝিকে ৭০ লাখ টাকা দাদন দিয়েছি। আষাঢ শ্রাবন পার হইয়া ভাদ্র মাস চলে এসেছে। এরপরেও পদ্মা, মেঘনায় ইলিশ ধরা পরেনা, এটা কখনো দেখিনি। মাছ ধরা না পরলে জেলেদের সাথে সাথে আমার মত আড়ৎদারদেরকেও বিপাকে পরতে হবে।
শরীয়তপুরের সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ সিরাজুল হক জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কু-প্রভাবে পদ্মা মেঘনার অনেক স্থানে ডুবোচর সৃষ্টি হয়েছে। এছারাও অধিক তাপমাত্রা, নদীর পানি গড়ম থাকা, নদীতে পানি প্রবাহ কম থাকায় এবছর দেরীতে বর্ষা এবং নদীর পানি অতিরিক্ত ঘোলা থাকায় মাছ কম বলে মনে হচ্ছে। নদীতে স্রোত কম থাকায় সাগর থেকে নদীতে ইলিশ আসতে পারছে না। তবে নদীতে পানি বৃদ্ধি ও অধিক বৃষ্টিপাত হলে প্রচুর মাছ পরার সম্ভাবনা রয়েছে।
(কেএনআই/এইচআর/আগস্ট ১৯, ২০১৪)