মাঈনুল ইসলাম নাসিম : কন্ট্রোল টাওয়ারের ভুলে ‘জি-টু-জি’ নামক বিধ্বংসী আত্মঘাতী ক্ষেপনাস্ত্রের আঘাতে মালয় সাগরে বিধ্বস্ত হয়েছে ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে চলাচলকারী বাংলাদেশ ম্যানপাওয়ার ফ্লাইট। ‘ব্ল্যাকবক্স’ পাওয়া দূরের কথা, উদ্ধার অভিযানের নামে চলমান তামাশা দেখছে বাংলাদেশের ১৪ লাখ মানুষ। না পাঠক, আতংকিত হবার কিছু নেই, কোন বিমান দুর্ঘটনার সংবাদ নয়।

উল্লেখিত ঐ ১৪ লাখ হতভাগা বাংলাদেশি হচ্ছেন তাঁরা, যাঁদের সামনে ঝুলানো হয় প্রলোভনের মূলা, প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় মাত্র ৩৩ হাজার টাকায় মালয়েশিয়া যাবার সুযোগ করে দেবার। এই প্রক্রিয়ায় গত বছর জানুয়ারিতে গোটা বাংলাদেশে ১৪ লাখ ৪২ হাজার ৭৭৬ জন নাম নিবন্ধন করেন দেশ ছাড়ার স্বপ্নে। ৭ দিনের ঐ নিবন্ধন ধুমধামে তখন রাষ্ট্রের প্রায় ৭ কোটি টাকা জলে গেলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বারবার জাতিকে বেহুদাই সুসংবাদ দিয়েছেন। নিবন্ধনকৃত ১৪ লাখের মাঝে গত দেড় বছরে মাত্র সাড়ে ৪ হাজার কর্মী পাড়ি জমিয়েছেন মালয়েশিয়াতে। ‘মোটা’ দাগে প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও বাস্তবায়নের ‘চিকন’ দাগে আজ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর মুখেই প্রকাশ্যে হতাশার সুর। ১৮ আগস্ট ২০১৪ প্রথম আলো পত্রিকায় ‘‘মালয়েশিয়ায় ধীরগতি, হতাশ বাংলাদেশ’’ শিরোনামে প্রকাশিত শরিফুল হাসানের প্রতিবেদনে খন্দকার মোশাররফের হতাশা জাতিকে জানান দেয়া হয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে।
হতাশার কথা শোনানো হলেও সরকারের ‘জি-টু-জি’ তথা ‘গভর্নমেন্ট-টু-গভর্নমেন্ট’ পলিসির নেক্কারজনক ব্যর্থতার কথা কিন্তু এখনো স্বীকার করছেন না সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী। বাস্তবতা বিবর্জিত ভুল পলিসির জন্য খন্দকার মোশাররফ তাঁর ব্যক্তিগত হতাশার কথা বলতেই পারেন, কিন্তু ‘আমরা হতাশ’ বলে তিনি আসলে দায় এড়াতে চেয়েছেন দারুনভাবে। গুটিকয়েক প্রতারককে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার ব্যর্থতা ঢাকতেই বেছে নেয়া হয়েছিল আত্মঘাতী ‘জি-টু-জি’ পলিসি, এমনটা মন্ত্রী স্বীকার করুক বা নাই করুক, তা কিন্তু ইদানিং বলাবলি হয়ে থাকে সরকারের অভ্যন্তরেও।
অতি সাম্প্রতিকালে দৈনিক জনকন্ঠে প্রকাশিত ‘২০১৩ সালের তুলনায় জনশক্তি রফতানি কমেছে, কূটনীতি ও মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার ফল’ শিরোনামে ফিরোজ মান্নার প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা হয়, ‘বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যান মন্ত্রণালয়ের তৎপরতার অভাবে বিদেশে বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়োগ কম হচ্ছে। বিদেশে কূটনীতিকরা ঠিকমতো কাজ করছেন না। দেশে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো কাজ করে না। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। জনশক্তির প্রধান বাজার মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে লোক পাঠানো যায়নি প্রত্যাশিত হারে।’
প্রথম আলো ও জনকন্ঠের উক্ত দু’টি বিশেষ প্রতিবেদন বিশ্লেষন করলে সরকারের ‘জি-টু-জি’ পলিসির চরম খেসারতের চিত্রই পরিষ্কার হয় দিনের আলোর মতো। প্রশ্ন হচ্ছে এখন সেই আলোতে সরকারের নীতি নির্ধারক মহল আলোকিত হবেন কি-না ? মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের একগুয়েমির কারণে ধ্বংস হয়েছে বাংলাদেশের শ্রমবাজার, মালয় সাগরে বিধ্বস্ত হয়েছে আমাদের ‘ম্যানপাওয়ার ফ্লাইট’, তাতে মন্ত্রীর চাইতেও বেশি হতাশ আজ দেশ-বিদেশের বিশ্লেষক মহল।
অবস্থা অনেকটাই এমন যে, নিজের ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতাসম্পন্ন দুই যুবক-যুবতী তাঁদের বহুদিনের প্রেমের পরিণতিতে বিয়ের পিড়িতে বসার সিদ্ধান্ত নিলেও জোর করে অন্যত্র বিয়ে দিয়েছেন তাঁদের বাবা-মা। চাপিয়ে দেবার একগুয়েমির পরিণতিতে যা হবার তাই হলো উভয় সংসারে। ‘জি-টু-জি’ ইস্যুতে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর একগুয়েমি যেন ঐ কান্ডজ্ঞানহীন বাবা-মা’র উদাসীনতাকেও হার মানিয়েছে। বাস্তবতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো ভুল পলিসি ‘জি-টু-জি’র ধ্বংসাত্মক সত্যতা স্বীকার করে নেয়া সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর জন্য অবশ্য ‘প্রেস্টিজ কনসার্ন’ বৈকি !
(এএস/আগস্ট ১৯, ২০১৪)