প্রবীর সিকদার : আজ ২০ এপ্রিল ২০১৪। আজকের দিনটি হতে পারতো আমার ১৩ তম মৃত্যু বার্ষিকী। কেউ আমাকে ফুল দিয়ে স্মরণ করতো কিনা জানি না। তবে এটুকু হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, আমার স্ত্রী-সন্তানরা বিপর্যস্ত জীবন যুদ্ধের মধ্য থেকেও চোখের জলে আমাকে স্মরণ করতে কোনই ভুল করতো না।

১৯৭১-এ বাবা, কাকা, দাদুসহ হারিয়েছি অনেক স্বজন। বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে রাজাকাররা। তাঁর লাশও পাইনি। একাত্তরের উদ্বাস্তু জীবন নিয়ে আমি আজও বাবার লাশ খুঁজে বেড়াই। বাবার লাশ খুঁজতে খুঁজতে আজ আমার কাছে পুরো বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে আমারই বাবার কবরস্থানে। সেই কবরস্থানের মর্যাদা রক্ষার লড়াই করি নিরন্তর। আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল থাকা সেই নৃশংস 'একাত্তর' আমি ভুলি কি করে !

২০০১ সাল। আমি তখন কাজ করি দৈনিক জনকণ্ঠে। দৈনিক জনকণ্ঠে তখন বহুল আলোচিত সিরিজ রিপোর্ট 'সেই রাজাকার' প্রকাশ পাচ্ছিলো। সেই সিরিজে ঠাই পেয়েছিলো হাল আমলে দেশের প্রথম ফাঁসির দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত দুর্ধর্ষ যুদ্ধাপরাধী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারসহ কয়েক দুর্ধর্ষ রাজাকারের একাত্তরের নৃশংস ইতিবৃত্ত নিয়ে আমার অনুসন্ধানি রিপোর্ট। আর ওই রিপোর্ট লেখার অপরাধে ২০০১ সালের ২০ এপ্রিল ফরিদপুরের বদরপুরে আমার ওপর হয়েছিল নৃশংস হামলা। বোমা মেরে, গুলি করে, চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আমার মৃত্যু নিশ্চিত করেই রাজাকারের ভাড়াটে দুর্বৃত্তরা সেদিন পালিয়েছিল। বদরপুর থেকে প্রথমে আমার রক্তাক্ত দেহ নেওয়া হয় ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে; সেখান থেকে ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইন্সিটিউট, পঙ্গু হাসপাতালে। পরে ঢাকা থেকে আমাকে পাঠানো হয় সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতাল ও মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা, দৈনিক জনকণ্ঠ সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ, সারাদেশের সাংবাদিক সমাজ ও সাধারণ মানুষের সহযোগিতা, সহমর্মিতায় দীর্ঘ চিকিৎসায় আমি জীবন ফিরে পেলেও আমাকে হারাতে হয়েছে একটি পা। স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারায় আমার একটি হাত। শরীরে চিরদিনের মতো ঠাই করে নেয় বোমার অনেক স্প্লিনটার। কৃত্রিম পায়ে ভর করে চলে আমার নতুন জীবনযুদ্ধ। আর এই নতুন যুদ্ধ করতে পারছি বলেই আজকের দিনটি ১৩ তম মৃত্যু বার্ষিকী না হয়ে হয়ে উঠেছে আমার ১৩ তম পুনর্জন্ম বার্ষিকী।

১৩ তম পুনর্জন্ম বার্ষিকীতে সকলের প্রতি রইলো আমার কৃতজ্ঞতা ও স্যালুট।

লেখক : সম্পাদক, দৈনিক বাংলা ৭১ ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ।