আবীর আহাদ


দেশের অর্থনীতি আজ মুখ থুবড়ে পড়ছে । দ্রুত গতিতে একদিকে কিছু লোক কোটিপতি বনে যাচ্ছে, অন্যদিকে একই গতিতে বিপুল লোকজন দরিদ্র হচ্ছে । মূলত: লুটপাটীয় আর্থসামাজিক ব্যবস্থার ফলশ্রুতিতে অর্থনীতিতে এসব অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে । আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিভিন্ন ব্যাংক, লিজিং কোম্পানি, পুঁজিবাজার, সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পসহ কেনাকাটা খাত থেকে শতসহস্র কোটি টাকা লুটপাট হয়ে গেলেও, এর সাথে জড়িত রাঘব বোয়ালদের বিচার বা শাস্তি না-হওয়ার পশ্চাতে কী রহস্য লুকিয়ে আছে, সেগুলো দেখার কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা যেনো বাংলাদেশে নেই ! সেই লুটপাটের সিংহভাগ টাকা কীভাবে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, সেসব বিষয়েও কেউ খতিয়ে দেখছে কিনা তাও জানা যাচ্ছে না । এসব লুটপাট বন্ধ ও এর সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কিছুই করণীয় আছে বলেও মনে হয় না । এর অর্থ কি এই যে, এসব অপরাধকর্মের সাথে রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরের ক্ষমতাসীনরাও জড়িত ? তারাও কি ঘুষ বা একটা পারসেন্টেজ কমিশন খেয়ে ঐসব অপকর্মের হোতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না ?

সতেরো কোটি মানুষের ছোট্ট একটি দেশ থেকে গুটিকতক দুর্নীতিবাজ-লুটেরা এভাবে লুটপাটের হোলিখেলায় দেশ-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে সীমাহীন সুখসাগরে জীবনযাপন করছে, অপরদিকে সাধারণ মানুষ দিনকে দিন আর্থিকভাবে চরম টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছে । কয়েক কোটি শিক্ষিত বেকারসহ দেশের স্বাধীনতার অধিকাংশ সূর্যসৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধারা চরম অনিশ্চয়তার আবর্তে পড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে । বীর মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় হাজার হাজার অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকারদের অবস্থান, সমাজে মানবিক মর্যাদা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়, সভ্যতা ও ভব্যতায় পচন, ভিন্নমতের প্রতি আক্রোশ, নৈতিকতার নিম্নগামিতা, শিক্ষা ব্যবস্থায় ধস, মাদক অনাচার ও অন্যান্য অসামাজিক কর্মকাণ্ডের হলাহল ইত্যাদি চরমভাবে জেঁকে বসেছে ।

দেশের এমনসব আর্থসামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দেউলিয়াপনাকে পুঁজি করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারের বিপক্ষ শক্তি হিশেবে ধর্মীয় জঙ্গিবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির চরম উত্থান ঘটেছে । গ্রামেগঞ্জে হাটেমাঠে শহরেনগরে মাদ্রাসা-মসজিদে প্রচারমাধ্যমে ওয়াজ নসিহতের নামে চলছে অশিক্ষিত মূর্খ গোঁয়ার মোল্লাদের লাগামহীন সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা ও উস্কানির বন্যা । এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি চরম বিষোদ্গার করে এগুলোকে কুফরি মতবাদ বলেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, ইসলামী ধর্মের মধ্যে থাকা আহমদীয়া সম্প্রদায়কে কাফের ঘোষণাসহ যাকে-তাকে অমুসলমান মুরতাদ নাস্তিক ও বিধর্মী বলে ফতোয়া দিচ্ছে । আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পরম বন্ধু ভারতকে বাংলাদেশের শত্রু হিশেবে চিহ্নিত করে এদেশের মানুষকে ভারতবিরোধী করার লক্ষ্যে তারা আদাজল খেয়ে নেমেছে । ভারত বিরোধিতার নামে তারা ইসলাম ধর্মের আবরণে পাকিস্তানি প্রেমকে জাগ্রত করছে । মোট কথা বাংলাদেশকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে ঐ গুটিকতক দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়াদের সাথে গাটছড় বেঁধে দেশের রাজাকার মোল্লা সমাজ হেন কোনো কাজ নেই যা তারা সুচারু করে যাচ্ছে । সবকিছু পর্যালোচনা করে মনে হয় যেনো তাদের এসব অপকর্মের পশ্চাতে সরকারের মধ্যকার আরেকটি সরকারের ইন্দন কাজ করছে !

দেশের এহেন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, দুর্নীতি লুটপাট ও মাফিয়াতন্ত্রসহ সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে যে নৈতিক আদর্শিক ও দেশপ্রেমমূলক ব্যবস্থা নিয়ে সরকার অগ্রসর হবে, তারও তেমন ন্যূনতম পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না । সরকার যেনো যখন যেমন তখন তেমন ধরনের অবস্থার মধ্যে হাবুডুবু খেয়ে শুধু দিন পার করার নীতিতে চলছে । আদর্শ, চেতনা ও সুদূরপ্রসারী হিসেব না রেখে শুধুমাত্র ক্ষমতা ভোগ ও লুটপাটের সহযোগী বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অকারণ নীরব ভাগিদারের অপবাদ নিয়ে আর যা-ই হোক দেশের মানুষের কল্যাণ করা যায় না ।

মুক্তিযুদ্ধের সাগরসম রক্ত ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সীমাহীন শৌর্য বীর্য ত্যাগ ও বীরত্বের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ কি একটি দুর্নীতিবাজ লুটেরা মাফিয়া ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়ে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হতেই থাকবে ?

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।