মাগুরা প্রতিনিধি : ভরা বর্ষা মৌসুমেও দেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের ২৫ নদী ও খাল-বিলে পর্যাপ্ত পরিমানে পানি না হওয়ায় হাজার-হাজার পাট চাষীদের চরম দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। অন্যদিকে এ সকল নদ-নদী, খাল-বিলের সামান্য পানিতে পাট জাগ দেওয়ায় পানি পচে সকল প্রকার দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্তী হতে চলেছে। সেই সাথে গোবাদি পশুসহ পশ্চিমাঞ্চলের লাখ-লাখ মানুষের নদী, খাল-বিলের পানি নিত্য-নৈমিত্তি ব্যবর্হায্যে অসহনীয় দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

অপর দিকে ২৫ নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় এবং নদীগুলি খনন না করায় প্রায় বছরই বর্ষা মৌসুমে অল্প বৃষ্টিতেই এ সকল নদীর উপচে পড়া পানিতে তলিয়ে যায় তীরবর্তী শত শত গ্রাম। বিনষ্ট হয় লক্ষ লক্ষ একর জমির ফসল। কোথাও কোথাও সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। এ এলাকার লাখ লাখ মানুষকে প্রতি বছরই মোকাবেলা করতে হয় বন্যার মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগকে। অথচ এ বছর অনাবৃষ্টির ফলে নদ-নদী, খাল-বিলে পানি না জমায় এবং অল্প পানিতে পাট জাগ ও জমাটবদ্ধ কুচুরি পানা পচে পানি নষ্ট হওয়ায় লাখ লাখ মানুষের অসহনীয় দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। যেখানে নদীগুলি ভরাট হয়ে যাওয়াই বন্যার প্রধান কারন। আবার শুস্ক মৌসূমে জোয়ারের পানি প্রবেশ করতে না পারাও ভরাটের প্রধান কারন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর ওপর দিয়ে প্রবাহিত ২৫টি নদ-নদী নাব্যতা হারিয়ে মৃত অবস্থায় পৌঁছেছে। এ অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত একমাত্র জীবিত নদী গড়াইও শুস্ক মৌসুমে শুকিয়ে যাচ্ছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই পদ্মার অন্যতম প্রধান এই শাখা নদীটি শুস্ক মৌসুমে বালু রাশিতে পরিনত হয়। গড়াই এ অঞ্চল থেকে দক্ষিনের খুলনা পর্যন্তু মিঠা পানি সরবরাহের প্রধান আধার। এ অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত সব নদ-নদীর পানির উৎস্য ছিল পদ্মা। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর ভারত সরকার কর্তৃক এক তরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে শুস্ক মৌসুমে পদ্মার পানি ব্যাপক হারে হ্রাস পায়। ফলে এর প্রভাব পড়ে শাখা নদী গুলোর উপর। পদ্মার প্রধান শাখা নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতের নদীয়ার জলঙ্গীর মধ্যবর্তী স্থানে। এ নদীটি মেহেরপুর জেলার কাথুলী সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে আবার চুয়াডাঙ্গা থেকে দর্শনা হয়ে ভারতে ঢুকে সেখানকার চুন্নী নদীতে মিশেছে। মাথাভাঙ্গার বাংলাদেশে প্রবেশ মুখে ভারত সরকার গত শতকের আশির দশকে নদীয়া জেলার গঙ্গারাজপুরে জলঙ্গী নদীর উপর একটি রেগুলেটর এবং মাইল পাঁচেক ভাটিতে ভৈরবের উৎসস্থলে ক্রসবাঁধ নির্মান করে পানি প্রবাহে বাঁধা সৃষ্টি করে। ফলে পানি না পেয়ে মাথাভাঙ্গার শাখা ভৈরব নদটি সীমান্ত জেলার দর্শনা-যশোর জেলার বসুন্দিয়ার পাশ দিয়ে নওয়াপাড়া ভিতর দিয়ে খুলনায় গিয়ে রূপসা নদীতে মিশেছে। এ নদটি বর্ষা মৌসুমে কুচুরিপানায় ভরে থাকে এবং শুস্ক মৌসুমে এ নদের ভেতরে আঁড় বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছে স্থানীয় লোকজন।

এ অঞ্চলের কপোতাক্ষ নদটি সৃষ্টি হয়েছে ভৈরব নদ থেকে উৎপত্তি হয়ে যশোরের সাগরদাঁড়ি হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। এ নদের উজান অংশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় মৌসুমী পানি উপচে প্লাবনের সৃষ্টি করে। ইতোপূর্বে কপোতাক্ষ অববাহিকার মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এ নদের কিছু অংশ পুনঃখনন করেছে। এ অঞ্চলের অন্যতম খর স্রোতা চিত্রা নদী মাথাভাঙ্গা থেকে উৎপত্তি হয়ে ঝিনাইদহ, মাগুরা জেলা হয়ে নড়াইলের উপর দিয়ে মধুমতি নদীতে মিশেছে। এ নদীর প্রায় দেড়শ কি:মি: এলাকা ভরাট হয়ে গেছে। গড়াই থেকে উৎপত্তি হওয়া কুমার ও কালীগঙ্গা নদী ডাকুয়া নদীর মাধ্যমে পানি সরবরাহ পায়। গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন কালে কালীগঙ্গা ও ডাকুয়ার উৎসমুখে ক্রস বাঁধ দেওয়ার কারনে এ নদী দুটি শুস্ক মৌসুমে শুকিয়ে যায় এবং বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশন হতে পারে না। মাথাভাঙ্গা ও সাগরখালী নদী আগেই ভরাট হয়ে যাওয়ায় মাগুরার শ্রীপুরের উপর দিয়ে প্রবাহমান কুমার নদটির প্রায় দেড়শ কি:মি: এলাকা বদ্ধ জলাশয়ে রূপ নিয়ে জিকে প্রকল্পের নিস্কাশন খালে পরিনত হয়েছে।

মাগুরা জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত এক সময়ের অন্যতম খর স্রোতা নদী বেগবতী, ফটকী ও নবগঙ্গা ভরাট হয়ে যাওয়ায় প্রায় ৬০ কিলোমিটার এলাকা সমতল ভ’মিতে পরিনত হয়েছে। যার ফলে বর্ষা মৌসুমে অল্প একটু বৃষ্টি হলেই এ নদী তিনটির দু’কুলের আশপাশের হাজার-হাজার একর জমির ফসল তলিয়ে বিনষ্ট হয়। এ ছাড়া পশ্চিমাঞ্চলের কাজলা,হিসনা,টেকা প্রভৃতি নদ-নদীর অস্তিত্ব মানচিত্রে আছে কিন্তু বাস্তবে নেই।

সংস্কার না করায় এ অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীগুলো নাব্যতা হারিয়ে বিলীন হতে চলেছে। অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে উপচে পড়া পানিতে দু’কুল প্লাবিত হয়ে বন্যা দেখা দেয়। কিন্তু চলতি বছর বর্ষা মৌসুমেও বৃষ্টি না হওয়ায় এ সকল নদ-নদী, খাল-বিলে পর্যাপ্ত পরিমানে পানি না জমায় পশ্চিমাঞ্চলের হাজার-হাজার পাট চাষীর দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। অন্যদিকে সামান্য পানিতে পাট জাগ দেওয়ায় নদী, খাল-বিলের পানি পচে দেশীয় প্রজাতির সকল মাছ ধ্বংস হচ্ছে। পরিবেশের বিরূপ প্রভাব পড়ছে গাছপালা ও জীববৈচিত্রের ওপরও। ফলে এ অঞ্চলের দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্তি হতে চলায় নদী ঘিরে গড়ে ওঠা মৎস্য জীবি পেশার বিলুপ্তী ঘটতে চলেছে। এ ছাড়া নদী ভিত্তিক ব্যবসা বানিজ্যে সৃষ্টি হয়েছে চরম সংকট।

সম্প্রতি পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো ঘুরে দেখা গেছে নদ-নদী, খাল-বিলে পর্যাপ্ত পানি নাই। যা আছে তা ব্যবহারের অনুপযোগী। ফলে পাট চাষীদের অর্বণীয় দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। দূর-দুরান্ত থেকে পাট এনে নদী বা খালে জাগ দিতে হচ্ছে। সরকার ইতিপূর্বে বেশকিছু খাল খনন করলেও তা একটু উপকারে আসেনি। কথা হয় শালিখা উপজেলার শতখালী গ্রামের আনিচ মোল্যার সাথে। কৃষক আনিচ মোল্যা জানান তিনি এ বছর ২ একর জমিতে পাট চাষ করেছেন। ডোবা, খাল-বিলে পানি না জমায় প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে ফটকী নদীতে নিয়ে জাগ দিতে হচ্ছে। যার ফলে পাটের যে বাজার মূল্য তার চেয়ে খরচ বেশী হচ্ছে। পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের আক্ষেপ সরকার যদি নদী, খাল-বিলগুলি ঠিক মতো খনন করতো তাহলে এ পানি পাট চাষীসহ এ অঞ্চলের লাখ-লাখ মানুষ নিত্যনৈমিত্তিক কাজে ব্যবহার করে উপকার পেতো। এতে সকল প্রকার দেশীয় প্রজাতি মাছের বংশ বিস্তারের সহায়ক হতো। তাছাড়া এক শ্রেনীর পেশাদার মৎস্যজীবিরাও মৎস্য শিকার করেও জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে পারতো।

(ডিসি/এইচআর/আগস্ট ২০, ২০১৪)