স্বাস্থ্য ডেস্ক : ১৮৯৪ সালের মার্চ মাস। ব্রিটিশ শাসিত ভারতের রাজধানী কলকাতার এক বস্তিতে চোখে পড়ে মানুষের দীর্ঘ সারি। এক বিদেশি ভদ্রলোক তাদের টিকা দিচ্ছিলেন। তাকে দেখে ব্রিটিশ মনে হলেও তিনি ছিলেন আসলে রাশিয়ান ইহুদি।

৩৩ বছর বয়সী এই ব্যক্তি এর আগের বছরের মার্চেও কলেরার মৌসুমে ভারতে এসেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল নিজের আবিষ্কৃত কলেরার ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা যাচাই করা। কিন্তু মানুষের অনাস্থা ও ব্রিটিশ সরকারের বাঁধার মুখে অকৃতকার্য হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। এই মানুষটি ছিলেন একজন জীববিজ্ঞানী। তিনি চিকিৎসক নন তার ওপর রাশিয়ান ইহুদি তাই ব্রিটিশ ভারতে তাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছিল।

কিন্তু পরের বছরই রাশিয়ার জীববিজ্ঞানী ওয়াল্ডিমার হাফকিন অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে কলকাতা থেকে আমন্ত্রণ পান। কলকাতার বস্তিগুলোর একটি জলাশয়ে কলেরার জীবাণু শনাক্ত করার কাজে সাহায্য করার জন্য কলকাতার মেডিক্যাল অফিসার তাকে আমন্ত্রণ জানান।

হাফকিনের জন্য কলকাতার বস্তিগুলো ছিল তার ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা যাচাই করার আদর্শ জায়গা। মার্চের শেষ দিকে কলকাতার কাঁঠালবাগান বস্তিতে দুই ব্যক্তি কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। হাফকিন ওই বস্তিতে ছুটে যান এবং সেখানকার দুই শতাধিক অধিবাসীর মধ্য থেকে ১১৬ জনকে টিকা দেন। এরপর ওই বস্তিতে দশ জন আক্রান্ত হন এবং সাতজন মারা যান। তারা সবাই ছিলেন টিকা না নেওয়া মানুষ।

ফলাফল দেখে কলকাতার মেডিক্যাল অফিসার আরও বড় পরিসরে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে উৎসাহী হন। কিন্তু ভারতের সাধারণ মানুষ ব্রিটিশ সরকারের চিকিৎসা কার্যক্রমকে সন্দেহের চোখে দেখতো। অনেকেই ভাবতো ব্রিটিশরাই মহামারির জীবাণু ছড়িয়েছে। তাই সহজে কেউ টিকা নিতে রাজি হচ্ছিল না।

এই অবস্থা দেখে হাফকিন কিছু ভারতীয় চিকিৎসককে সাহায্যকারী হিসেবে নেন। জনসমক্ষে নিজের শরীরে ভ্যাকসিন গ্রহণ করে দেখান যে, এটা ঝুঁকিমুক্ত। ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান ও মেডিসিনের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক প্রতীক চক্রবর্তী বলেন, কিছুদিনের মধ্যেই হাফকিনের কলেরা ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য মানুষ ভিড় করতে শুরু করে। তিনি তখন প্রায় সারাদিন কলকাতার বস্তিগুলোতেই অবস্থান করতেন। ভোরে মানুষ কাজে বের হওয়ার আগেই তিনি টিকা দেওয়া শুরু করতেন। সন্ধ্যায় কর্মস্থল থেকে ফিরে তারা দেখতো ওই ভিনদেশি মানুষটি কুপিবাতির আলোয় বসে তখনও টিকা দিয়ে যাচ্ছেন।

১৮৬০ সালে রাশিয়ার ওদেসায় জন্ম নেওয়া এই বিজ্ঞানী ওদেসার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিওলজিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন ১৮৮০ সালে। ইহুদি হওয়ায় তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হতে পারেননি। ছাত্র অবস্থায় এক ইহুদির বাড়ি ভাঙতে রুশ সৈন্যদের বাঁধা দেওয়ায় তিনি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন কিছুদিন জেলও খেটেছিলেন।

১৯৮৮ সালে ওয়াল্ডিমার হাফকিন রাশিয়া ছাড়েন। জেনেভায় কিছুদিন শিক্ষকতা করেন তিনি। সেখান থেকে চলে যান প্যারিসে। সেখানে লুই পাস্তুর ইনস্টিটিউটে সহকারি লাইব্রেরিয়ানের দায়িত্ব পান। লুই পাস্তুর ছিল তখন বিশ্বের শীর্ষ ব্যাকটেরিওলজি ইনস্টিটিউট। অবসর সময়ে হাফকিন কখনও বেহালা বাজাতেন, কখনও ইনস্টিটিউটের ল্যাবে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন।

১৮৯০ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কলেরা মহামারি ছড়িয়ে পড়ে। এর কোনো প্রতিষেধক তখনও আবিষ্কৃত হয়নি। হাফকিন কলেরার জীবাণু নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে লাগলেন। তিনি কলেরার জীবাণু খরগোশের দেহে সংক্রমিত করলেন। এক দেহ থেকে অন্য দেহে সংক্রমণের প্রক্রিয়া চালিয়ে গেলেন। এক পর্যায়ে কৌতূহলী হয়ে তিনি দেখলেন, চল্লিশতম সংক্রমণের পর কলেরার জীবাণু ভয়ানক হয়ে ওঠে।

এরপর সংক্রমিত করলে খরগোশ সাথে সাথেই মারা যায়। কিন্তু পেশির গভীরে সংক্রমিত না করে চামড়ার নিচে করলে জীবাণুর কার্যকারিতা কমে যায়। দীর্ঘ গবেষণার পর হাফকিন কলেরার জীবাণু থেকেই এর প্রতিষেধক তৈরি করলেন। খরগোশ ও গিনিপিগের ওপর পরীক্ষা করে ভালো ফলও পেলেন।

কিন্তু মানুষের দেহে ভ্যাকসিনটির ক্রিয়াও তো দেখতে হবে। কোনো স্বেচ্ছাসেবক না খুঁজে ১৮৯২ সালের ১৮ জুলাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাফকিন কলেরার জীবাণুর সাথে নিজের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন নিজের শরীরেই গ্রহণ করলেন। সে সময় সামান্য জ্বরে ভুগতে হয়েছে তাকে। কিন্তু দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠলেন।

তারপর এই ভ্যাকসিন তিনি দিলেন তার তিন রাশিয়ান বন্ধুসহ আরও কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবককে। যখন কারও শরীরেই খুব বিরূপ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না তখন হাফকিন আরও বড় পরিসরে তার ভ্যাকসিনের পরীক্ষা করতে চাইলেন। তার প্রয়োজন ছিল এমন কোনো অঞ্চল যেখানে কলেরার ব্যাপক সংক্রমণ ঘটেছে। ১৮৯৩ সালে ফ্রান্সের তৎকালীন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত এবং ভারতের প্রাক্তন ভাইসরয় লর্ড ফ্রেডারিক হাফকিনকে বাংলায় যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

কলকাতায় কলেরা ভ্যাকসিনের সফলতা দেখে পরের বছর আসামের চা বাগানের মালিকরা তাদের শ্রমিকদের টিকা দেওয়ার জন্য ওয়াল্ডিমার হাফকিনকে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে হাজার হাজার শ্রমিককে টিকা দেন তিনি। ১৮৯৫ সালে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে বাধ্য হন। তার রেকর্ড অনুসারে ভারতে তিনি প্রায় বেয়াল্লিশ হাজার মানুষকে কলেরার টিকা দিয়েছিলেন।

কিছুদিন বিরতি দেওয়ার পর ১৮৯৬ সালে তিনি আবার ভারতে আসেন। কলেরার ভ্যাকসিনকে আরও উন্নত করতে চাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু মুম্বাইয়ে প্লেগের সংক্রমণ দেখা দিলে ব্রিটিশ সরকারের অনুরোধে তিনি প্লেগের প্রতিষেধক উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা শুরু করেন। প্লেগের প্রতিষেধক উদ্ভাবনে সফলতা পাওয়ার পর পুরো বিশ্বে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৩০ সালের ২৬ অক্টোবর এই মহান বিজ্ঞানী সুইজারল্যান্ডে মৃত্যুবরণ করেন। ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পথিকৃৎ এই মহান ব্যক্তিকে অনেকটা ভুলেই গেছে বিশ্ব। অথচ ভ্যাকসিনের সঙ্গে তার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকার কথা ছিল।

(ওএস/এসপি/ডিসেম্বর ১৩, ২০২০)