নিউজ ডেস্ক : আজ বিভীষিকাময় ২১শে আগস্ট। ২০০৪ সালের এদিনে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউএর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত হন। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ প্রায় ৩ শতাধিক লোক আহত হন।

এই হামলায় নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা আইভী রহমান রয়েছেন। কিন্তু ইতিহাসের এ ভয়াবহতম নৃশংস গ্রেনেড হামলার বিচার শেষ হয়নি ১০ বছরেও। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় শহীদ স্মরণ দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

সেদিন যা ঘটেছিল
সেদিনটি ছিল শনিবার। সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। বিকাল ৪টার দিকে সমাবেশ শুরু হয়। সমাবেশের পর সারাদেশে বোমা হামলায় নিহতদের স্মরণে শোক মিছিলের কর্মসূচি ছিল। বিকাল সাড়ে ৪টা নাগাদ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এলাকা পরিণত হয় জনসমুদ্রে। শেখ হাসিনা বিকাল ৫টার দিকে সমাবেশস্থলে পৌঁছান। বুলেটপ্রুফ মার্সিডিজ বেঞ্জ জিপ থেকে নেমে নিরাপত্তা কর্মী বেষ্টিত অবস্থায় তিনি দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি ট্রাকের ওপর তৈরি অস্থায়ী মঞ্চে উঠে বক্তৃতা শুরু করেন।

বক্তৃতায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী দেশব্যাপী অব্যাহত বোমা হামলার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। ২০ মিনিটের বক্তৃতা শেষে 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তার হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করতে করতে এগোচ্ছিলের মঞ্চ ট্রাক থেকে নামার সিঁড়ির কাছে। সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ দিক থেকে মঞ্চকে লক্ষ্য করে একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। ঘড়ির কাঁটায় তখন ৫টা ২২ মিনিট। গ্রেনেডটি মঞ্চের পাশে রাস্তার ওপর পড়ে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এরপর একে একে আরো ১২টি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। মুহূর্তের মধ্যে পুরো এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। আতঙ্কে মানুষ দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করে। গ্রেনেডের আঘাতে মঞ্চের নিচে রাস্তার ওপরে বসা বেগম আইভী রহমানসহ অসংখ্য মানুষ লুটিয়ে পড়েন। ঘাতকদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল শেখ হাসিনা।

পরিস্থিতির তাত্পর্য বুঝতে পেরে মঞ্চে উপস্থিত ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ এবং শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী তাত্ক্ষণিকভাবে এক মানবঢাল তৈরি করে শেখ হাসিনাকে গ্রেনেডের হাত থেকে রক্ষা করেন। মঞ্চে উপস্থিত নেতা ও দেহরক্ষীদের আত্মত্যাগ এবং পরম করুণাময় আল্লাহ'র অশেষ রহমতে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান শেখ হাসিনা। মানবঢাল তৈরি করে শেখ হাসিনাকে সেখান থেকে সুধা সদনে নিয়ে যাওয়া হয়। শেখ হাসিনাকে বহনকারী গাড়ির ওপরও গুলিবর্ষণ করা হয়। তবে নিক্ষিপ্ত তিনটি গ্রেনেড অবিস্ফোরিত থেকে যায়। মেয়র হানিফের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়ায় অস্ত্রোপচার করার কথা থাকলেও গ্রেনেডের স্প্লিন্টার শরীরে থাকার কারণে তার অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হয়নি। পরে তিনি ব্যাংককের একটি হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান।

উপর্যুপরি বোমা হামলায় হতাহতদের রক্তে রক্তাক্ত হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন দলের নেতা-কর্মীরা। তারা গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদ জানাতে থাকলে পুলিশ তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পুলিশ বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর প্রথমে বেপরোয়া লাঠিচার্জ ও পরে কাঁদানে গ্যাসের সেল নিক্ষেপ করে। এতে পুলিশের সাথে বিক্ষুব্ধ জনতার দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। পুলিশ নিরীহ পথচারীদেরও লাঠিপেটা করে। গ্রেনেড বিস্ফোরণের সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, স্টেডিয়াম মার্কেট, বায়তুল মোকাররম মার্কেট, নবাবপুর রোড, নর্থ সাউথ রোড, পুরানা পল্টনসহ আশপাশের এলাকার দোকানপাট ও যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। লোকজন আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে পালাতে থাকে। হতাহতের মধ্যে তিন শতাধিক আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে, আরো শতাধিক নেতা-কর্মীকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, বারডেম, বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, শমরিতা হাসপাতালসহ রাজধানীর অন্যান্য হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিত্সা দেয়া হয়। সেদিন যদি ঘাতকদের নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড সমাবেশের জন্য ব্যবহূত ট্রাকে বিস্ফোরিত হতো তবে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কোন সিনিয়র নেতাই প্রাণে রক্ষা পেতেন না। আর এটাই ছিল ঘাতকচক্রের মূল পরিকল্পনা।

এই বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় যারা নিহত হন তারা হলেন আইভি রহমান, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, আবুল কালাম আজাদ, রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারি, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, বেলাল হোসেন, মামুন মৃধা, রতন শিকদার, লিটন মুনশী, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), মোশতাক আহমেদ সেন্টু, মোহাম্মদ হানিফ, আবুল কাশেম, জাহেদ আলী, মোমেন আলী, এম শামসুদ্দিন এবং ইসাহাক মিয়া প্রমুখ। এদের মধ্যে ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। নারী নেত্রী আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ২৪ আগস্ট মারা যান। আহত হওয়ার পর প্রায় দেড় বছর মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হেরে যান আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা ও প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। গুরুতর আহত হয়েছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আমির হোসেন আমু, প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, সাহারা খাতুন, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, নজরুল ইসলাম বাবু, আওলাদ হোসেন, সাঈদ খোকন, মাহবুবা আখতার, উম্মে রাজিয়া কাজল, নাসিমা ফেরদৌস, শাহিদা তারেক দীপ্তি, রাশেদা আখতার রুমা, হামিদা খানম মনি, ইঞ্জিনিয়ার সেলিম, রুমা ইসলাম, কাজী মোয়াজ্জেম হোসেইন ও মামুন মল্লিক।

কর্মসূচি
রাত ১২টা ১ মিনিটে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এলাকায় যুবলীগের মোমবাতি প্রজ্বলনের মাধ্যমে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা দিবসের কর্মসূচি সূচিত হয়। আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, আজ বিকাল ৪টায় ২৩, বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ বেদীতে শেখ হাসিনা দলীয় নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করবেন। পরে সেখানে আয়োজিত দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে অংশ নিবেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দও অনুরূপ কর্মসূচিতে যোগদান করবেন। পরে একই স্থানে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত শহীদ পরিবারের সদস্যবৃন্দ ও আহতদের সাথে সাক্ষাত্ করবেন এবং আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখবেন।

(ওএস/অ/আগস্ট ২১, ২০১৪)