ফজলুল হক খান


আমন মৌসুমের ধান কাটা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। বাজারে ধানের মূল্য ভালো থাকায় কৃষক এবারে তার সুফল পাচ্ছে। গত বোরো মৌসুমেও ধানের বাজার ভালো ছিল। এ মৌসুমে সরকার ধান কেনার জন্য ধানের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু বাজারে দাম বেশি থাকায় চাউল কল মালিক গন ধান কেনা থেকে বিরত রয়েছে। গত বোরো মৌসুমে মিলাররা ধান ক্রয় করেনি। চুক্তি অনুযায়ী ধান ক্রয় না করায় অনেক মিলারের চুক্তিপত্রের অর্থ সমন্বয় হয়েছে।

বাংলাদেশ বাজার ব্যবস্থাপনায় এমন চিত্র আর কখনো দেখা যায়নি। প্রতিবছর ধান কাটা প্রায় শেষ হয়ে গেলে সরকার ধান কেনা শুরু করে। কৃষক ধার দেনা পরিশোধ ও সংসারের খরচ মিটানোর জন্য এর আগেই বাজারে ধান বিক্রি করে ফেলে। বাজারে প্রচুর আমদানি থাকায় উৎপাদন খরচের অনেক কম দামে কৃষককে ধান বিক্রি করতে হয়। হতাশায় কৃষক ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সমালোচনার ঝড় বইতে থাকে পুরো দেশে। কৃষকের মনে ক্ষোভ বাড়তে থাকে।

কিন্তু গত দুটি মৌসুমে কৃষক মোটামুটি ভাল দাম পাওয়ায় কৃষকের মুখ হাসিতে ভরে গেছে। কৃষকের মুখে হাসি থাকলে যেন বাংলা হাসে। কৃষক বাঁচাতে সরকারের এমন পদক্ষেপ সত্যিই প্রশংসনীয়। বিশ্লেষকগণ একে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশে কৃষক নিয়ে এমন ভাবনাই ভাবা উচিত। আগামী দিনগুলোতে কৃষক নিয়ে এমন পদক্ষেপ চলমান থাকবে প্রত্যাশা বিশেষজ্ঞদের।

সব সরকারের সময়ে সরকার কাবিখা, টাবিখা, টি,আর ,ফেয়ার প্রাইস মূল্যে চাল বিক্রি ও আপৎকালীন খাদ্য চাহিদা মেটাতে জাতীয়ভাবে ধান কিনে থাকে। এ ধান কেনা নীতিমালায় সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা হয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবে প্রায় সময়ই কৃষকের ধান সরকারি গুদামে যায় না ।

বিশ্লেষকগণ এর দুটি কারণ দেখেন। প্রথমত: যে সময়ে ধান কেনা শুরু হয় তখন কৃষকের গোলায় ধান থাকেনা। শ্রমিকের পাওনা পরিশোধ, সার বীজ কীটনাশক'র দাম পরিষদ, ঋণ পরিশোধ ও সংসারের প্রয়োজনে কৃষক ধান কাটার সাথে সাথেই বাজারে বিক্রি করে এ প্রয়োজন মিটিয়ে থাকে। ফলে ব্যবসায়ীরা কম দামে ধান কিনে গুদাম ভর্তি করে। সরকার ধান কেনা শুরু করলে চড়া দামে তারা তা বিক্রি করে।

দ্বিতীয়তঃ কৃষক সরকারি গুদামে দান বিক্রি করতে গেলেও অসাধু কর্মকর্তাদের কারণে ধান দিতে হিমশিম খায়। তারা আদ্রতার প্রশ্ন তুলে কৃষকের ধান নেয়া থেকে বিরত থাকে। কিন্তু এক শ্রেণীর দালাল ও ফরিয়াদের সাথে গুদাম সংশ্লিষ্টদের সম্পর্ক থাকায় তারা রফাদফা করে দেদারসে ধান গুদামে ঢুকিয়ে দেয়।

সরকারি খাদ্য গুদামের অসৎ কর্তাব্যক্তিদের ভাষা অনেক সময় কৃষক বুঝতে পারেন না। সরকারি লোক হিসাবে কৃষকের কাছ থেকে তারা ধান কেনে। তাদের কাছে এটা কৃষকের বড় ভাগ্যের ব্যাপার। কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে মূলত বোধহয় কৃষকের উপকার করে। তার জন্যই তারা কিছু উৎকোচ /উপরি পাওয়ার যেন দাবি রাখে। কৃষক সমাজ তা বুঝতে চায় না। অনেক সময় ঘাম ঝরিয়ে কামানো অর্থ উপরি হিসেবে খাদ্য গুদামের কর্মকর্তাদের তারা দিতেও চান না। অনেক কৃষক দরকষাকষিও করে।

গুদাম সংশ্লিষ্টদের ভাষায় কৃষক ধান ভাল করে শুকিয়ে বিক্রি করতে আনেন না। এমন অভিযোগ অসৎ গুদাম সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। ফলে আদ্রতার প্রশ্ন দেখা দেয়। এতে সরকারি ধান নষ্ট হওয়ার শঙ্কা থাকে। সরকারি দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে সরকারের সম্পদ তো তিনি নষ্ট হতে দিতে পারেন না? তাই ঐ কৃষকের ধান নেয়া সম্ভব হয় না।

যদিও যুগ যুগ ধরে কৃষক - কৃষাণিরা এভাবেই শুকিয়ে ধান গোলায় রাখে। অক্ষত থাকে পুরো বছর। ধান পঁচেও না। নষ্টও হয় না। তারা নাকি ধান শুকাতে পারে না? তাই ধান বিক্রি না করলে প্রয়োজন মিটবে কিসে? ফলে ধান বাড়ীতে ফেরৎ না নিয়ে বাজারেই এক শ্রেনির দালালদের কাছে বিক্রি করে তার প্রয়োজন মিটিয়ে থাকে। এ দালালরাই ঐ কৃষকের ধান খাদ্য গুদামে দেয় তখন আদ্রতার সমস্যাটি মিটে যায়।

কারণ এ দালাল ও মুনাফাখোরদের সাথে ঐ সমস্ত দেশপ্রমিক খাদ্য গুদাম কর্মকর্তাদের ভাবের সম্পর্ক রয়েছে। তাদের সম্পর্ক ভাই বন্ধু এবং দেনা পাওনার । চা সিঙ্গারা এক টেবিলে প্রতিনিয়ত খাওয়ার সম্পর্ক তাদের। খাদ্য গুদাম অফিসের অসৎ লোকজনের চোখের ভাষা তারা সহজেই বোঝেন। তাই তাদের ধান গুদামে ঢুকাতে কোন সমস্যা হয় না।

বাস্তবতা হলো দু'একটি ব্যতিক্রম বাদে সারা দেশের চিত্র এমনি। আবার অসহায়ের সাথে লক্ষ্য করা যায় সরকার এমনভাবে এ ধান কেনা কর্মসুচিটি চালু করে যার আগেই কৃষককে তার অতিপ্রয়োজনে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হতে হয়। তখন কর্মসূচিটি চালু করা হয়ে ওঠে না।ধান ভেজা তাই আদ্রতা ইস্যুতে ও মিটারে গ্রহন না করার দোহাই দিয়ে বাজরেই তারা বিক্রি করতে বাধ্য হয়।

কৃষকের গোলা যখন প্রায় খালি হয়ে যায় তখন যার পর নাই ধান কেনার ধুম পড়ে যায়। সুবিধাবাদি দালাল ও মুনাফাখোর একশ্রেনির ব্যবসায়ির অসৎ কার্যসাধনের মাহেন্দ্রক্ষণ এসে যায়। ফলে কৃষক হয়ে যায় বোবা। আকাশের দিকে অপলক দাড়িয়ে থাকে- আর বিড় বিড় করে মনের অজান্তেই বলতে থাকে সরকারের ধান কেনার এমন চিত্র দেখার জন্যই কি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবন যৌবন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়ে দেশটি শোষকদের হাত থেকে মুক্ত করেছিলেন ? এমন ফটকাবাজদের রুখতে গিয়েই তো তিনি নিজেকে উৎসর্গ করলেন। তারই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়বার প্রত্যয়ে জাতির হাল ধরেন।
গত বোরো থেকে এবারের আমন মৌসুমে সরকারের সিদ্ধান্ত এবং কৃষকের স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্যোগ সকল মুনাফাখোর আর ফটকাবাজদের দৌরাত্ম্য বন্ধে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। সরকারের দূরদর্শী চিন্তারই প্রতিফলন। কৃষককে নিয়ে ভাবনার কেন্দ্র মূলে শেখ হাসিনা জাতিকে খুবই আশ্বস্ত করে।

তিনি কৃষকের নেতা হবেন তাই তো প্রতাশিত। তাই যথেষ্ট কারন ও উপাদান আছে যে, বর্তমান সরকার একটি কৃষি বান্ধব সরকার। কৃষকের ও কৃষির উন্নয়নে বিশাল ভুর্তুকি বলতে গেলে পৃথিবীতে বিরল। যেখানে সারের দাবিতে কৃষককে হত্যা করার মত জঘন্য ঘটনা ঘটতো - সেখানে পর্যাপ্ত সারের মজুদ ও সরবরাহ এবং শৃঙ্খলাপুর্ন বিতরন ব্যবস্থায় একটি স্লোগান কার্যকর যে, "সারের কাছে কৃষক যাবে না "- বরং "কৃষকের কাছেই সার যাবে।" এটা শতভাগ দৃশ্যমান। শুধু তাই নয়- সেচকাজে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক গভীর, অগভীর নলকুপ এবং কেরোসিন ও ডিজেলচালিত নলকুপের উপর সরাসরি কৃষককে ভুর্তুকির অর্থ পৌছে দেয়ার যে নীতি এ সরকার গ্রহন করেছে তাতে সরকার কৃষকবান্ধব কি না তা প্রমান করার জন্য কোন গবেষনার দরকার হয় না। এগুলো কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের জন্য যুগান্তকারি একেকটি পদক্ষেপ।

কিন্তু কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার কাগুজে যে নীতি নিকট অতীতে দেখা যেত তা বাস্তবে জাতিকে ধারাবাহিক অবাক করে। তাই কৃষকবান্ধব সরকারের প্রানের কৃষককে বাঁচাতে এবং সরকারের কাছে কৃষকের ধান বিক্রিতে কতগুলো বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেয়া যায়।

প্রতি উপজেলায় সমস্ত চাউলকল/চাতাল এক মাসের বা তারও বেশী সময়ের জন্য সরকার অধিগ্রহন করতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের একটা প্রনোদনার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে।

একটি উপজেলাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে সপ্তাহের নির্দিষ্ট একেক দিন একেকটি এলাকা চিহ্নিত করা যায়। এ সকল এলাকায় সরকারি গুদাম কর্মকর্তা ও কর্মচারি এবং খাদ্য কর্মকর্তা ও কর্মচারি গন ঐ সকল চাউক কল/চাতালে সশরীরে গিয়ে কৃষকের কাছ থেকে ভেজা ধান নগদে ক্রয় করতে পারেন।

কৃষকের কাছ থেকে কেনা ভেজা ধান প্রয়োজনে মৌসুমের জন্য প্রয়োজন মাফিক দৈনিক ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ করা যেতে পারে। ঐ শ্রমিকরা চাতালে ধান শুকাবে এবং গুদামজাত করবে।

কোন চাতালে কোন্ দিন কোন্ কোন্ ওয়ার্ড বা চিহ্নিত এলাকার কৃষকের ধান কেনা হবে তা আগেই প্রচার করে জানিয়ে দেয়া যায়।

এতে করে দালাল ও মধ্যস্বত্য ভোগীদের একদিকে যেমন নিয়ন্ত্রন করা যেতে পারে -তেমনি আদ্রতার ধুয়া তুলে কৃষকের কাছ থেকে ধান না কেনার প্রবনতার মুখটি বন্ধ করা যাবে। এছাড়াও স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায়।

কৃষিবান্ধব সরকার সত্যিকার অর্থেই কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার জন্য নিম্নরুপ স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। ।

বর্তমান ব্যবস্থায় একটি উপজেলায় প্রকৃত কত হেক্টর জমিতে ধান চাষ করা হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরিসংখ্যান হয় যেন গদবাধা । সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বিশেষত: উপজেলা কৃষি অফিস গতানুগতিক হালনাগাদ তথ্য দিয়ে থাকেন। তারা ফাকিবিদ্যার আশ্রয় নিয়ে গত বছরের রেকর্ড দেখে তথ্য হালনাগাদ করে থাকেন। তাতে গড়হারে হয় ১০হেক্টর বেশী বা না হয় ১৫ হেক্টর কম এ নীতিতে তত্ব আপডেট করেন। সেভাবেই উৎপাদের লক্ষ্যমাত্রা দেখিয়ে থাকেন।

কৃষকওয়ারী ধান রোপনের তথ্য আধুনিকায়ন করা জরুরি। এখানে জমির মালিক ও বর্গাচাষীদের তথ্য হালনাগাদ করা থাকবে । বর্তমান ব্যবস্থায় বিজ্ঞানভিত্তিক কোন পদ্ধতি ও পরিসংখ্যান একটি উপজেলা কৃষি অফিসে পাওয়া সম্ভব কিনা বলা কঠিন। আবার এবছর জমি নিজেই চাষ করেছে। পরের বছর এ জমিটি বর্গা দেয়া হয়েছে তারও পরিসংখ্যান তাদের কাছে থাকে কিনা এবং কোন ব্যক্তি কার কতটুকু জমি বর্গা চাষ করে তার হিসাবও বোধহয় সঠিকভাবে পাওয়া কঠিন। কৃষির আধুনিকায়নে এ বিষয়গুলি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা যায়।

আবার দেশের প্রতিটি উপজেলায় উপজেলা কৃষি অফিস উপজেলা পরিষদের গ্রাউন্ডের মধ্যে অবস্থিত। এ অফিসটি কৃষকের দোরগোড়ায় স্থাপন করা যায়। যে জায়গায় কৃষক থাকে অর্থাৎ গ্রামে কৃষি অফিসগুলো নিয়ে যাওয়া যায় কিনা ভাবতে হবে । যদিও কাগজে-কলমে এক একটি ব্লক তৈরি করে একজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা ওই ব্লক গুলিতে ঠিকমতো কৃষকের সাথে সাথে যোগাযোগ রাখেন না ।

গ্রামের প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ওয়ার্ডে, ইউনিয়নে স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। গ্রামে এগুলো গড়ে উঠলে কৃষি অফিস প্রতিটি ওয়ার্ডে নিশ্চয়ই গড়া যায়। দীর্মেয়াদে বিষয়টি এভাবে ভাবা যায়।

তাছাড়া দীর্ঘমেয়াদে ধান চাষযোগ্য এলাকাগুলো চিহৃিত করে প্রতি উপজেলায় কয়েক লাখ টনের ধারণ ক্ষমতা সম্পর্ন এক বা একাধিক আধুনিক খাদ্যগুদাম নির্মাণ করা যায়। এ খাদ্যগুদামের পার্শ্বে ৫/১০/২০ একর জমি অধিগ্রহন করে ধান শুকানোর চাতাল নির্মান করা যায়। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ভেজা ধান কিনে সরকারি ব্যবস্থাপনায় শুকানো এবং গুদামজাতের এ প্রকল্পটি হাতে নেয়া যায়। এ সব গুদামে সরকার ভেজা ধান কিনে যেমন শুকাবে তেমনি ধান শুকনো হলে এবং স্বাভাবিক আদ্রতা থাকলে তা গুদামজাত করবে। এতে সত্যিকারের কৃষকের কাছ থেকে সরকারের ধান কেনা নীতিটি বাস্তবেই রুপ নেবে। সরকারের সচ্ছতা ও জবাবদিহিতার এক অনন্য উদাহরণও তৈরী হবে। কার্যকরি হবে কাগুজে নয়- কর্যতই কৃষক তার ধান সরকারের কাছে বিক্রি করবে- দালালের মাধ্যমে নয়। আবার ভুয়া মাষ্টাররোল নয়- কুষক নিজেই ধান দেবে এবং মুল্য বুঝে নেবে। এভাবেই হতে পারে কৃষি ও কৃষকের স্বপ্ন পূরণ। হতে পারে সততা চর্চার এক নতুন অনুশীলন।