খুরশিদ আলম শাওন, রাণীশংকৈল : ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বর্তমান ঠাকুরগাঁও জেলার সীমান্তবর্তী হরিপুর উপজেলা, বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা, রানীশংকৈল উপজেলা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণে দিশেহারা হয়ে, পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী রানীশংকৈলে ক্যাম্প স্থাপন করে। প্রতিদিন শত শত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের লোকদের ধরে আনা হতো  ক্যাম্পে। সেখানে বর্বর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করার পরে, লাশ গুলোকে খুনিয়া দীঘিতে ফেলে দেওয়া হতো । মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সহায়তা করার জন্য রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ডা. আব্দুর রহমান ও তার সহোদরকে খুনিয়া দীঘির পাড়ে নিয়ে গিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয় । দীঘি পাড়ের শিমুল গাছে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতের তালুতে লোহার পেরেক মেরে ঝুলিয়ে রেখে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বর্বর র্নিযাতন চালিয়ে পরিশেষে গুলি করে হত্যা করা হয়। কখনো কখনো হত্যার পূর্বে লোকজনকে নিজেদের কবর খুঁড়তে বাধ্য করা হত। হত্যার পরে দীঘির পাড়ের উঁচু জমিতে মাটি চাপাও দেওয়া হয়েছে । 

স্থানীয় মুক্তিযোদ্বা হবিবর, আবু সুফিয়ান ও মোতালেব বলেন,১৯৭১ সালে পাকিস্তানি আর্মি ,রাজাকার, আলবদর আর আলশামসেদের সহায়তায় ২ হাজার থেকে ৩ হাজার জন মানুষকে খুনিয়া দীঘিতে হত্যা করে পানিতে লাশ ভাসিয়ে দিয়েছে। এর ফলে মানুষের রক্তে দীঘির পানির রং হয়ে যায় ঘন খয়েরি। রক্ত, লাশ, কঙ্কালে ভরপুর খুনিয়া দীঘি নামটি আরো সার্থক হয়ে খুনিয়াদিঘীতে পরিণত হয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দীঘি থেকে উদ্ধার করা মানুষের হাড়গোড় দীঘির পাড়ে একটি গর্ত করে মাটি দিয়ে তা ঢেকে দেওয়া হয়। শহীদদের স্মরণে দীঘি পাড়ের ওই জায়গাটিতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। ১৯৭৩ সালে জাতীয় চার নেতার মধ্যে অন্যতম আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান এটিকে উপজেলার স্মৃতিসৌধ হিসেবে ঘোষনা দিয়ে এর শুভ উদ্বোধন করেন।

অথচ সেই ঠাকুরগাঁওয়ে রাণীশংকৈল উপজেলার মুক্তিযুদ্বের ইতিহাস সমৃদ্ব খুনিয়াদিঘী স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও বেদখল হয়ে ব্যক্তি-মালিকানায় রয়েছে। উদ্বারে প্রশাসনের তেমন তৎপরতা না থাকার অভিযোগও উঠেছে। বেদখলের পর মুক্তিযুদ্বে শহীদদের রক্তে রঞ্জিত খুনিয়াদিঘী বধ্যভুমিটি পুণরায় ২০১৬ সালের মে মাসে বিনা বাধায় উপজেলা সাব-রেজিষ্টার অফিসের মাধ্যমে দলিল দস্তখতে বিক্রি হয়ে যায়। তবে বিক্রি হওয়ার খবর প্রশাসন না রাখলেও স্থানীয় সংবাদকর্মিরা ঠিকই রাখে। স্থানীয় সাংবাদিক খুরশিদ আলম শাওন সবার প্রথম ২০১৭ সালে এপ্রিল মাসে খুনিয়াদিঘী বিক্রির তথ্যাটি সংগ্রহ করে স্থানীয় একটি সাপ্তাহিক পেপারে লিড নিউজ করে। পরে খুনিয়াদিঘী বিক্রির সংবাদটি ব্যাপকভাবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার হয়। তবে এত প্রচার প্রচারণাও মধ্যে আজও খুনিয়াদিঘীটি বেদখল।

উপজেলার হোসেনগাঁও ইউনিয়নের ভাণ্ডারা গ্রামের খুনিয়া দীঘি বধ্যভূমিটি ২০১৬ সালের মে মাসে বিক্রি করে দেন মালিক দাবি করা এক ব্যক্তি। যার বাবা তৎকালীন দিনাজপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের কাছ বন্দোবস্ত নিয়ে ছেলেদের নামে দলিল করে দেন।গণমাধ্যম কর্মিদের তৎপরতায় ২০১৭ সালে ওই বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে রিভিশন মামলা আজও লাল ফিতায় ফাইল বন্দি হয়ে রয়েছে।

হোসেনগাঁও ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা জাহেরুল ইসলাম জানান, ব্রিটিশ ১ নম্বর খতিয়ানে খুনিয়া দিঘী টি মোট ৫ একর ৬৮ শতক জমির উপর। যার মালিক ছিলেন রাজা টঙ্কনাথ। রাজা টঙ্কনাথ স্থানীয় কুসুম উদ্দীনের কাছে খুনিয়া দিঘী, বানিয়া দিঘী ও মোর দিঘীর জলকর মাছ চাষ করা শর্তে ৪২৯ নম্বর খতিয়ান করে দেন। কুসুম উদ্দীন ১৯৮২ সালের ২১ জুলাই ঐ খতিয়ানের কপি দিয়ে তৎকালীন দিনাজপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে দিঘী তিনটির খাজনা খারিজ দেওয়ার জন্য আদেশ নেন। একই বছরের ১২নং দলিল মূলে ছেলে হামিদুর রহমানের নিকট খুনিয়া দিঘীর জলকর ২ একর ১৮ শতক জমি বিক্রি করেন তিনি। হামিদুর রহমান আবার ২০১৬ সালের মে মাসে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেন খুনিয়াদিঘী। সে হিসাবে খুনিয়া দিঘীটি বিক্রি হয়েছে দুবার।

এ ইউনিয়ন ভুমি কর্মকর্তা আরো জানান, আমরা ইতিমধ্যে আবারো নথি যাচাই বাছাই করে এবং সমস্ত আইনি জটিলতা নিরসনের নিমিত্তে একটি প্রতিবেদন জেলা প্রশাসনের বরাবরে পাঠানো হয়েছে। আশা রাখছি খুব শিগগির খুনিয়াদিঘীর মালিকানার জটিলতা নিরসন হবে।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খুনিয়াদিঘীর জলকরটিতে ব্যক্তিমালিকানায় মাছ চাষ চলছে। পাশে পাহাড়ের পূর্ব প্রান্তে স্মৃতি স্তম্ভটি অরক্ষিত অবস্থায় নাজেহাল হয়ে রয়েছে। পাহাড়ের উত্তর প্রান্তে সদ্য নতুন আরেকটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। সেটিও অরক্ষিত এবং নাজেহাল হয়ে পড়েছে।

উপজেলা এলজিইডি অফিস সুত্রে জানা যায়,স্থানীয় সরকার অধিদপ্তরের বরাদ্দে প্রায় ৩২ লাখ টাকা ব্যয়ে চলতি বছরের জুনে এটির নির্মাণ কাজ শেষ করে উন্মুক্ত করা হয়েছে। তবে এটি রক্ষণাবেক্ষণের কোন জনবল না থাকায় স্মৃতিস্তম্ভর অনেক কিছু ইতিমধ্যে খোয়া গেছে। এবং কি অনেক জিনিস পত্র ভেঙে তছনছ করে ফেলা হয়েছে। তবে স্থানীয় অনেকে অভিযোগ করে বলেন, ইতিমধ্যে দিঘীটির চারপাশের পাড়ের অনেক মাটি কেটে পুকুরটি সম্প্রসারিত করা হয়েছে। প্রশাসন যদি পাড় কাটার দিকে নজর না দেয় তাহলে এক সময় দিঘীর পাড় আরো কেটে ফেলা হতে পারে আশংকা তাদের। অন্যদিকে পাড় কাটার ফলে সদ্য নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভটির উত্তর- দক্ষিণ সাইড ধসে যাওয়ার প্রবল সম্ভবনা রয়েছে।

দিঘীর বিক্রেতা হামিদুর রহমান বলেন, খুনিয়া দিঘীর জলকরের মালিক আমি আর পাহাড়ের মালিক সরকার ।অর্থনৈতিক সংকটের কারণে গত ২০১৬ সালের মে মাসে স্থানীয় আবুল কাশেমের স্ত্রী ফাতেমার কাছে ২৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় খুনিয়া দিঘীর জলকরটি বিক্রি করে দিয়েছি।

মুক্তিযোদ্বা হবিবর রহমান বলেন, অব্যশই খুনিয়াদিঘী ইতিমধ্যে সরকারের তত্বাবধানে থাকা উচিত ছিলো। খুনিয়া দিঘী মানেই রাণীশংকৈলের স্বাধীনতা রাণীশংকৈলের বিজয়ের নির্দশন,মুক্তিযুদ্বের ইতিহাস। আমি আশা রাখছি সমস্ত জটিলতা শেষ করে খুব শিগগির স্থানীয় প্রশাসন সরকারের দখলে খুনিয়াদিঘীটি নেবে।

উপজেলা সহকারী সেটলমেন্ট অফিসার আফসার আলী বলেন, ২০০৬ সালের ভূমি জরিপে খুনিয়া দিঘীর জমিটি এখনও খাস খতিয়ান হিসেবেই আমাদের দপ্তরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এ জমি বিক্রির কোনো সুযোগ নেই বলে দাবি করেন তিনি।
উপজেলা সহকারী কমিশনার(ভুমি) প্রীতম সাহা বলেন, আমরা ইতোমধ্যে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বরাবরে লিখিতভাবে বিষয়টি জানিয়েছি। অব্যশই দ্রুত এর মালিকানার সমস্যাটি সমাধান হবে।

ঠাকুরগাঁও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(রাজস্ব) আমিনুল ইসলাম গতকাল বৃহস্পতিবার মুঠোফোনে বলেন, ইতিমধ্যে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন জেলা প্রশাসনে একটি লিখিত পত্র দিয়েছিল। সেই পত্রটিতে তথ্য ঘাটতি এবং আবেদন প্রক্রিয়া সঠিক না হওয়ায়। সঠিক নির্দেশনা দিয়ে খুনিয়াদিঘী উদ্বারে একটি রিভিউ মামলা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রিভিউ করা হলে খুব শিগগির মালিকানার জটিলতা নিরসন হবে।

(কেএস/এসপি/ডিসেম্বর ২৪, ২০২০)