আবীর আহাদ


মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মুক্তিযোদ্ধা সংক্রান্ত Management Information Systems (MIS) একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প তাতে কোনো সন্দেহ নেই । কিন্তু মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যের মধ্যে যে ভুলের ছড়াছড়ি পরিলক্ষিত হয়েছে তাতে মুক্তিযোদ্ধারা সীমাহীন হয়রানির শিকার হচ্ছেন । অনেকের নিজের ছবির স্থলে অন্যের ছবি সংযোজন করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া নাম ও ঠিকানার ক্ষেত্রেও বানানের হেরফের হওয়ায় পুরো বিষয়টি একটা জগাখিচুড়িতে পরিণত হয়েছে । বিশেষ করে নাম ও ঠিকানার ভুলের কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের নানান বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয় । অপরদিকে নামের বানান ও ঠিকানা সঠিক করতে এসেও তাদের অবর্ণনীয় কষ্ট শিকার করতে হয় । পকেটের অর্থ খরচ করতে হয় ।

একটা কথা আমরা বুঝতে পারি না, এসব ভুলের সমাহার থেকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কোনোই শিক্ষা গ্রহণ করছে না । নাম ও ঠিকানার ভুলের বিষয়টি বেশ পুরোনো । কোনো ব্যক্তি/মুক্তিযোদ্ধা নিশ্চয়ই তার নাম ও ঠিকানা ভুল দেন না । অন্য কেউ যখন সেই নাম ও ঠিকানা অন্যত্র লিপিবদ্ধ করে তখনই তার মাধ্যমে ভুল হতে থাকে । এ ভুল হওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না যদি লিপিবদ্ধকারী সঠিকভাবে বানান জানেন ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করেন । কিন্তু দু:খের বিষয়, সঠিক বানানের লোকের অভাবসহ সর্বত্রই ধান্দাবাজি লোকের সমাগম । অর্থকড়ি হাতিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে ধান্দাবাজরা ইচ্ছেকৃতভাবে এসব ক্ষেত্রে ভুল সৃষ্টি করে । আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, কর্তৃপক্ষ যেন ইচ্ছে করেই মুক্তিযোদ্ধাদের হয়রানি করার লক্ষ্যে এসব করে থাকেন । কারণ যাদেরকে আমরা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জামুকার কার্যালয়ে দেখছি, তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ও অসৎ কর্মকর্তা/কর্মচারী তাতে কোনো সন্দেহ নেই । এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মহোদয় তড়িৎ কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আশা করি ।

এখন আসি মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই প্রসঙ্গে । দেশের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে অবশেষে সরকার শুধুমাত্র এক তালিকার বেসামরিক গেজেটধারী ৪২ হাজার মুক্তিযোদ্ধার পুনরায় যাচাই বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে । বিষয়টির প্রতি আমরাও দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জানিয়েছি । আগামী ৯ জানুয়ারি একযোগে সব উপজেলা ও জেলা হেডকোয়ার্টারে তাদেরকে যাচাই বাছাইয়ের সম্মুখীন হতে হচ্ছে । প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সিদ্ধান্তটি স্বস্তিদায়ক হলেও মন্ত্রণালয়ের ভুলের কারণে ভারতীয় তালিকা (কল্যাণ) ও লাল মুক্তিবার্তার বহু বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম নতুন যাচাই বাছাইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে সারা দেশ থেকে এখনো এন্তার অভিযোগ আসছে ।

এ বিষয়ে এর আগেও আমি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিবৃতি দিয়েছি । আমার পরামর্শের আলোকে জামুকা সিদ্ধান্ত দিলেন শুধুমাত্র বেসামরিক গেজেটধারীদের যাচাই বাছাইয়ের, কিন্তু সেসব তালিকায় এখনো কী কারণে কিসের ভিত্তিতে ভারতীয় ও লাল তালিকার মুক্তিযোদ্ধাদের নাম পাঠানো হলো তা একেবারেই বোধগম্য নয় । তবে কি ধরে নেয়া হবে যে, প্রেরিত ভারতীয় ও লাল তালিকার মুক্তিযোদ্ধাদেরও যাচাই বাছাই করা হবে ? এ বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরিষ্কার করা উচিত । যদিও কর্তৃপক্ষ পরবর্তীতে বলেছেন যে, ভারতীয় ও লাল তালিকার মুক্তিযোদ্ধাদের আসন্ন যাচাই বাছাইয়ের সম্মুখীন হতে হবে না । কিন্তু উপজেলা/জেলায় প্রেরিত তালিকায় অনেক ভারতীয় ও লাল তালিকার মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে যা অদ্যাবধি সংশোধন করে দেয়া হয়নি ! যাদের ডাকার প্রয়োজন নেই, তাদের ডেকে যে মানসিক কষ্ট ও হয়রানির মধ্যে ফেলা হলো---এর জবাব কে দেবে ? আসলে বেআক্কেলদের হাতে কোনো দায়িত্ব অর্পণ করা হলে তারা সেটিকে তালগোল পাকিয়ে ফেলে । এখানেও তেমন কিছু হয়েছে বলে মনে হয় । আর এর মধ্য দিয়ে কোনো বাণিজ্যিক ধান্দার ফাঁদ পাতা হয়েছে বলেও সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে ।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে অমুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদের জন্যে আজ কয়েক বছর যাবত আমি যে সংগ্রামের মশাল জ্বালিয়ে দিয়ে আসছি, সেই সংগ্রামের মশাল হাতে নিয়ে বিপুলসংখ্যক বীর মুক্তিযোদ্ধা আমার সহযোগী হিশেবে নানান আন্দোলন-সংগ্রামে বিরামহীন অবতীর্ণ হয়েছেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে অমুক্তিযোদ্ধাদের ঝেটিয়ে বিদায় দেয়ার লক্ষ্যে সরকার আপাতত: এক তালিকার বেসামরিক গেজেটধারীদের পুনর্যাচাই বাছাইয়ের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা প্রশংসনীয় । কিন্তু যাচাই যাচাইয়ের নামে তালগোল পাকানো তালিকা প্রকাশ করে পুরো বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাশাপাশি নতুন করে ২০১৭ সালের আদলে যাচাই বাছাই কমিটির মাধ্যমে যে যাচাই বাছাই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় । কারণ ২০১৭ সালের তথাকথিত যাচাই বাছাই কমিটি যে সর্বগ্রাসী বাণিজ্যিক ধান্দায় মুক্তিযোদ্ধা তালিকার ভুয়াদের বহাল রেখে নতুন করে হাজার হাজার অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা বলে সুপারিশ করেছিলো, সেই একই বাণিজ্যিক ধান্দায় বর্তমানেও যাচাই বাছাই কমিটি ভুয়াদের নিকট থেকে বিপুল অর্থ নিয়ে তাদের পক্ষে অবস্থান নেবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই । ইতোমধ্যে সারা দেশের প্রতিটি প্রান্তে ভুয়ারা টিকে থাকার লক্ষ্যে মন্ত্রী-এমপি-নেতাসহ তথাকথিত যাচাই বাছাই কমিটির সদস্য ও সাক্ষীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরঘুর করছে বলে খবর পাওয়া গেছে । যে প্রক্রিয়ায় যাচাই বাছাই হতে যাচ্ছে এবং অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক সংযোগের কারণে পুরো বিষয়টি ভেস্তে গিয়ে ভুয়ারা যে আবার সমহিমায় বহাল হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই ।

ভারতীয় ও লাল তালিকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার সনির্বন্ধ আবেদন, কোনো অবস্থাতেই তারা যেনো তাদের নিজেদের মহানামের মর্যাদার স্বার্থে ভুয়াদের পক্ষে সাক্ষ্য না দেন । মনে রাখতে হবে, যারা অর্থ ও আত্মীয়তার মোহে ভুয়াদের পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন, তারা নিজেদের মর্যাদার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন এবং ভবিষ্যতে ভুয়া সাক্ষ্য দেয়ার কারণে একদিন তাদেরকেও কঠিন শাস্তি পেতে হতে পারে । অপরদিকে নবগঠিত যাচাই বাছাই কমিটির সদস্যদের প্রতিও একই আবেদন জানাচ্ছি, আপনারাও বীর মুক্তিযোদ্ধা । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বকে অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক শক্তির চাপের কাছে নতি স্বীকার করে মুক্তিযোদ্ধাদের কলঙ্ক ভুয়াদের রক্ষা করতে যাবেন না । আপনাদের সততা ও দেশপ্রেমের ওপর মুক্তিযোদ্ধাদের মানসম্মান নির্ভর করছে । আপনারা নিশ্চয়ই পরম দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা সমুন্নত রাখবেন । আর মনে রাখবেন, গত ২০১৭ সালের যাচাই যাচাই কমিটির অধিকাংশ সদস্য অনৈতিক কার্যকলাপের কারণে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হয়ে মানসম্মান হারিয়ে এখনো পালিয়ে বেড়াচ্ছেন । চলতি যাচাই বাছাই কমিটির সদস্যরা নিশ্চয়ই এ বিষয়টি মনে রেখে সততা নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন ।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সঠিক তালিকা প্রণয়নের জন্য আমি বার বার বলে আসছি, বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তর সালের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে উচ্চ পর্যায়ের বিচার বিভাগ ও সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে শুধুমাত্র বেসামরিক গেজেট নয়----পর্যায়ক্রমে কল্যাণ, লাল, সেনা, বিজিবি, পুলিশ, আনসার, যুদ্ধাহত, মুজিবনগর, স্বাধীন বাংলা বেতারসহ অন্যান্য সব তালিকার অমুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদের একটি বৈপ্লবিক কার্যক্রম গ্রহণ ব্যতিরেকে অন্য কোনো প্রক্রিয়া কোনোভাবেই সফল হবে না । সরকার তথা জামুকাকে বুঝতে হবে যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মান, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় মর্যাদা ক্ষুন্নকারী অমুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদ ইতিহাসের দাবি ।

বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে গোঁজামিল সংজ্ঞায় অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় হাজার হাজার অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধা সেজে অকারণে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বে ভাগ বসানোর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদি ভোগ করতেই থাকবে তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না । বঙ্গবন্ধু কন্যা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত ও আর্থিকভাবে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে চান----অথচ বর্তমান মুবিম মন্ত্রী বাহাদুর ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের অযোগ্যতা ও অদক্ষতার এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্নীতির কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছাকে জলাঞ্জলি দিয়ে এসবের দায়দায়িত্ব তাঁর ওপর চাপিয়ে দিয়ে তাঁর মর্যাদাহানি করছেন । এটা আমরা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা কোনোক্রমেই মেনে নিতে পারি না।

আমি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বাহাদুরকে স্মরণ করিয়ে এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলতে চাই, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পবিত্র তালিকায় অমুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের অবস্থান কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না । এর ব্যত্যয় ঘটলে বীর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের নামের মর্যাদা রক্ষার জন্য যেকোনো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হবে, যার পরিণতি কারো জন্য শুভ হবে না ।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।