শিতাংশু গুহ


পহেলা জানুয়ারি ২০২১ নিউইয়র্ক কুইন্সের জ্যামাইকা হাসপাতালের আইসিইউ’র ডাক্তার সমীর সরকারের সাথে কথা হলো, তিনি একটি ঘটনার কথা বলেন। এক বাঙ্গালী মহিলা, ৫৭, কোভিড-১৯ লক্ষণ নিয়ে ভর্তি হ’ন ডিসেম্বরের শেষদিকে। ৭দিন চিকিৎসা চলে, কিন্তু অবস্থার অবনতি হতে থাকে, অক্সিজেন দিয়ে সামলানো যাচ্ছিলো না। তাঁকে বলা হলো, ভেন্টিলেশন লাগবে। মহিলা শিক্ষিতা। তিনি জানেন, ভেন্টিলেশন থেকে খুব বেশি রুগী ফিরে আসেনা। বুঝলেন সবই, বললেন, ভেন্টিলেশনে যাওয়ার আগে, পরিবারের সবার সাথে কথা বলতে চান। কষ্ট হলেও তখনো তিনি কথা বলতে পারতেন, ভিডিও কনফারেন্সে পরিবারের সাথে দুইঘন্টা কথা বললেন। ডাক্তার সমীর সরকার বললেন, ‘তিনি সবার কাছ থেকে বিদায় নেন, জীবন-মৃত্যু’র সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্যটি বড়ই করুন, বেদনার’, বলে বোঝানো যাবেনা। জিজ্ঞাসা করলাম, এখন তিনি কোথায়? বললেন, ‘ভেন্টিলেশনে’। করোনা হলে মানুষ হাসপাতালে যেতে চাইতো না, কিন্তু একটা সময় আসে, হাসপাতাল না গিয়ে কি উপায় থাকে? এই মহিলা কি তাই? ডাক্তার সমীর একটি হিস্পানিক পরিবারের কথা বললেন, ভয়ে তাঁরা হাসপাতালে আসেনি, অথচ পরিবারের সবাই করোনা আক্রান্ত। ভদ্রলোকের স্ত্রী বাড়ীতেই মারা যান, এরপর ভয় পেয়ে সবাই হাসপাতালে আসেন, ভদ্রলোকের অবস্থা এখনো সঙ্কটজনক, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তবে বাকি দু’জন আক্রান্ত হলেও তাঁদের হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশী-আমেরিকান সমীর সরকার এমডি, নিউইয়র্কে রিচমন্ড হিলের মতুয়াদের ‘শ্রীশ্রী হরিমন্দিরের’ প্রতিস্তিহ সভাপতি। করোনা শুরুর দিকের আরো একটি ঘটনার কথা জানান। মহিলা বাংলাদেশের, বয়স ৪৪। স্বামী-পুত্র আছে, স্বামী ফার্মাসিষ্ট। ঘটনা করোনা’র প্রথম দিকে, মার্চ ২০২০’র। করোনা নিয়ে মহিলা হাসপাতালে ভর্ত্তি হ’ন। তিনি প্রেগন্যান্ট, তাই তাঁকে গাইনোকোলজি বিভাগে রাখা হয়। মহিলা মা, ভর্তি হয়ে প্রথমেই তিনি প্রশ্ন করেন, ‘আমার গর্ভস্থ সন্তান বাঁচবে তো’? ডাক্তার সমীর বলেন, নিজে বাঁচাবেন কিনা তা জিজ্ঞাস্য ছিলোনা, অনাগত সন্তানকে বাঁচানো যাবে কিনা তা নিয়ে তিনি চিন্তিত ছিলেন, এজন্যেই তিনি মা। প্রসূতি বিভাগে দ্রুত তাঁর অবস্থার অবনতি হচ্ছিলো, দু’দিন পর তাই তাঁকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ)-তে স্থানান্তর করা হয়, অর্থাৎ তিনি আমার ডিপার্টমেন্টে আসেন।

৪৪দিন তাকে নিয়ে যমে-মানুষে টানাটানি চলে, ভেন্টিলেশনের মধ্যেই তাঁর ‘কিডনি শাট-ডাউন হয়’, তাকে ‘ডায়ালাইসিস’ দেয়া হয়। তাঁর ইনফেকশন হয়, তাকে এন্টিবায়োটিক দেয়া হয়! এ সময়ে তাঁর গাইনি ডাক্তার আমাকে বলেন, তুমি যদি তাঁকে আর এক সপ্তাহ বাঁচিয়ে রাখতে পারো, তবে সিজারিয়ান করে তাঁর বাচ্চাটি বাঁচানো যাবে। জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি ক’সপ্তাহের গর্ভবতী ছিলেন? ডাঃ সমীর হিসাব করে বললেন, ভর্তি হয়েছেন ২৭ সপ্তাহের মাথায়, সিজারিয়ান হয় ৩৩ সপ্তাহে। ভেন্টিলেশনে সিজারিয়ান? হ্যাঁ। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, বাচ্চা হবার পর মহিলা আস্তে আস্তে সুস্থ হতে শুরু করেন। তাঁর ভেন্টিলেশন সরানো হয় এবং একসময় ভালো হয়ে তিনি সন্তান কোলে বাড়ী ফিরে যান। ডাক্তার হিসাবে এটি আমার জন্যে আনন্দের বিষয়। ডাঃ সমীর জানান, ক’দিন আগে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী আমার সাথে দেখা করেন, খুব খুশি। জিজ্ঞাসা করলাম, হাসপাতালের দিনগুলো মনে আছে? ভদ্রমহিলা অবাক করে জানালেন, ভর্তি হওয়া এবং বেরিয়ে যাওয়া ছাড়া তাঁর কিছুই মনে নেই!

তখনকার আরো একটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়? ডাক্তার সমীর দাশ বললেন, করোনা’র শুরুতে মার্চে একদিন আমাদের হাসপাতালে এক বৃদ্ধ মহিলা, ৮০ এলেন, ভীষণ অসুস্থ। তখনো আমরা টেষ্ট করতে পারতাম না, নমুনা পাঠানো হতো বাইরে, রেজাল্ট আসতে ৪/৫দিন সময় লাগতো। তাঁকে আইসিইউ-তে রাখা হয়, ৭দিন লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। এরপর তিনি ভালো হতে থাকেন, লাইফ-সাপোর্ট খুলে নেয়া হয়। মহিলাকে ষ্টেটডাউন-এ রাখা হয়, ষ্টেটডাউন হচ্ছে, আইসিইউ ও জেনারেল বেড-র মধ্যবর্তী অবস্থান। ডাঃ সমীর জানান, তাঁকে আমি দেখতাম, কিন্তু অন্যরা তেমন যেতেন না, কারণ জিজ্ঞাসা করলে ডাক্তার-নার্স বলতেন, আমাদের মাস্ক-গ্লাভস ও প্রটেকটিভ সরঞ্জাম নেই! ডাক্তার সমীর তখনকার হাসপাতাল ও ফেডারেল সরকারের অবস্থা বোঝাতে চাইছিলেন।

তিনি জানান, দু:খের বিষয় ফেডারেল সরকারের অবহেলায় মহিলা মারা যান! একই পরিবারের অপর এক বৃদ্ধ, ৮২ তিনিও করোনায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হন, তিনি বেঁচে যান। তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হয়, কিন্তু বাড়ীর লোকজন তাঁকে নেবে না? পরিবারটি বাংলাদেশ কমিউনিটি’র, আমি কথা বললাম, তাঁরা বুঝলো, বৃদ্ধকে বাড়ী নিয়ে গেলো। ডাক্তার সমীর বললেন, সত্যিকার অর্থে পরিস্থিতি তখন এতটা ভয়াবহ হয়েছিলো যে, মানুষ তাঁদের স্বজনকেও বাড়ী নিতে চাচ্ছিলো না? পরিবারটি’র পরিচয় জানতে চাইলাম, ডাক্তার সমীর জানাতে রাজি হ’ননি।

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।