স্টাফ রিপোর্টার : রাজনীতি এখন বসন্তের কোকিলদের হাতে বলে মন্তব্য করেছেন প্রবীণ রাজনীতিক, আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু।

বৃহস্পতিবার দেশের এক দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে তিনি এ মন্তব্য করেন।

এই প্রবীণ রাজনীতিক নেতা বলেন, রাজনীতি এখন আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। অরাজনৈতিক ব্যক্তি ও বসন্তের কোকিলের হাতেই এখন রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। তৃণমূলের কোনো ত্যাগী, পরীক্ষিত সৈনিক এখন এমপি-মন্ত্রী হতে পারেন না। কালো টাকার মালিক এখন অর্থ ব্যয় করে এমপি হচ্ছেন, নেতা বনে যাচ্ছেন। ফলে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত, ত্যাগী নেতা-কর্মীরা এখন রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন, বা তাদেরই বিতাড়িত করা হচ্ছে।

সম্প্রতি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া, আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থা, বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকীতে বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালন, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ উঠে আসে প্রবীণ এই রাজনীতিকের সঙ্গে আলাপচারিতায়।

ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু বলেন, আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এ দলের বর্ণাঢ্য ইতিহাস রয়েছে। দেশের যতগুলো অর্জন সবই আওয়ামী লীগের হাত ধরে। জনগণের কল্যাণের জন্যই দলটির জন্ম। তবে বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, দলটির নেতারা দেশ, জনগণ বা দলকে দেওয়ার চেয়ে বেশি নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ত্যাগী কর্মীদের আর মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। তোষামোদকারী, বসন্তের কোকিলরাই প্রাধান্য পাচ্ছে। ফলে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত, নির্যাতিত নেতারা দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন, যে কারণে সাম্প্রতিক সময়ে সর্বত্র সাংগঠনিক দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়েও সন্ত্রাস, খুন বেড়ে গেছে।

আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, দল ক্ষমতায় থাকলে চাটুকার, তোষামোদকারীর সংখ্যা বেড়ে যায়। এসব বসন্তের কোকিল '৭২ সালেও ছিল। কিন্তু পঁচাত্তরের পর তারা পালিয়ে গেছে। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, আবার বসন্তের কোকিলের আনাগোনা বেড়েছে। এসব কোকিলের কারণে ত্যাগী, পরীক্ষিত নেতারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।

বিচাপতিদের অভিশংসন বিষয়ে তিনি বলেন, বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ায় বিচারকরা আরও নিরাপদ হলেন। বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে আগেও ছিল। পরে সংবিধান সংশোধন করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন জাতীয় সংসদ যদি কোনো বিচারপতিকে অভিশংসন করতে চায়, তাহলে দুই-তৃতীয়াংশ এমপির সমর্থন লাগবে।

এ ছাড়া রাষ্ট্রপতির অনুমোদনও নিতে হবে। ফলে সরকার যা খুশি তা করতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। এর পরও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিতে হবে। স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রতি সরকার হস্তক্ষেপ করতে চাইছে বলে বিএনপির নেতারা যে বক্তব্য দিচ্ছেন তা সঠিক নয়।

বিএনপির সরকার পতনের আন্দোলনের ব্যাপারে তিনি বলেন, বিএনপি এ মুহূর্তে সরকার পতনের আন্দোলনের যে ঘোষণা দিচ্ছে, এর যথাযথ যুক্তি নেই। তাদের এমন সিদ্ধান্তও সঠিক নয়। কারণ জাতির জনকের খুব কাছ থেকে দেখেছি, তিনি কখনোই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেননি। কারণ ক্ষমতায় যাওয়া এবং দলকে সুসংগঠিত করার জন্য নির্বাচনই একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু বিগত নির্বাচনে বিএনপি না গিয়ে চরম ভুল করেছে। বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী দল। এমন সিদ্ধান্ত তারা কেন নিল তা বোধগম্য নয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে গিয়ে যদি ফল তাদের কোনো কারণে বিপক্ষে যেত, তাহলে এখন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সরকার পতনের আন্দোলন তারা গড়ে তুলতে পারত।

জাতির জনকের শাহাদাতবার্ষিকীতে বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালন করাকে বেদনাদায়ক অধ্যায় আখ্যায়িত করে বঙ্গবন্ধুর এই সহচর বলেন, জাতির জনকের শাহাদাতবার্ষিকীতে বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালন অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক অধ্যায়। তিনি দুবারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসন। কী করে জাতির জনকের মৃত্যুদিনে কেক কেটে আনন্দ উল্লাস করেন তিনি! বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন না করলে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হতে পারতেন না।

জেনারেল এম এ জি ওসমানীও পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্নেলের ওপরে উঠতে পারেননি। সেখানে জিয়াউর রহমান কোথায় থাকতেন। বেগম খালেদা জিয়া কি প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন? দায়িত্বশীল একজন নেত্রীর কাছে জাতি এসব আশা করে না।

একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলাকারীদের বিচারের মাধ্যমে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে পল্টু বলেন, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় শুধু শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল না। আওয়ামী লীগকে রাজনীতিবিমুখ করা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করাই ছিল মূল লক্ষ্য। আমরা সব সময়ই জঙ্গিবাদের ব্যাপারে তৎকালীন সরকারকে সতর্ক করেছিলাম। কিন্তু তারা বলত, দেশে জঙ্গি বলতে কিছু নেই। এসব মিডিয়ার সৃষ্টি। কিন্তু একটি বিশেষ ভবনে বসে, সরকারের মদদে ২১ আগস্ট বর্বরোচিত হামলা চালানো হলো।

সেদিন শেখ হাসিনা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও আওয়ামী লীগের ২২ নেতা-কর্মী ও দুজন সাধারণ মানুষ নিহত হন। শত শত মানুষ আজও স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছে। কিন্তু দীর্ঘ ১০ বছর পার হলেও এ বিচার প্রক্রিয়া শেষ হচ্ছে না। বর্তমান সরকারের উচিত দ্রুততম সময়ের মধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাকারী ও পরিকল্পনাকারীদের বিচার করে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা, যাতে ভবিষ্যতে কোনো অপশক্তি সাহস দেখাতে না পারে গ্রেনেড হামলা রাজনীতিবিদদের হত্যা করতে।

(ওএস/এটিআর/আগস্ট ২২, ২০১৪)