আবীর আহাদ


আমরা বর্তমানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম-শতবার্ষিকীর মধ্যে অবস্থান করছি । আগামী ২০২১ সালের ১৭ মার্চ তাঁর জন্মশতবার্ষিকী শেষ হবে । এই ঐতিহাসিক মর্যাদাপূর্ণ সময়ের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও মুক্তিযোদ্ধাদের উন্নত আর্থসামাজিক জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ঘোঘণা দিয়ে বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা একটি অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারেন ।

আমরা দেশের মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে অবগাহন করে সীমাহীন শৌর্য ত্যাগ ও বীরত্ব দিয়ে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় হানাদার পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলাম । কিন্তু অতি পরিতাপের বিষয় এই যে, স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর রচিত আমাদের জাতীয় সংবিধানের মূল স্তম্ভ 'প্রস্তাবনা'র কোথাও মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের অবদানের কথা বর্ণিত হয়নি । আমরা মনে করি, তড়িঘড়ি করে সংবিধান রচনা করতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে 'মুক্তিযোদ্ধা-মুক্তিযুদ্ধ' শব্দদ্বয় সন্নিবেশিত হয়নি । সংবিধান কোনো ধর্মীয় বাণী নয় যে, কোনো কিছু সংযোজন ও সংশোধন করা যাবে না । অতীতে জাতীয় প্রয়োজনে তো বটেই, এমনকি কোনো কোনো শাসকদের ক্ষমতা ও শাসনের সুবিধার্থে সংবিধানে অনেক সংশোধনী ও সংযোজনী এসেছে এবং দেশ ও যুগের দাগিদে ভবিষ্যতে আরো হতেই থাকবে ।

আমাদের সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি না-থাকার ফলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে এবং মুক্তিযোদ্ধা না-হয়েও অনেকে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে আসছে ! মুক্তিযুদ্ধের কথা সংবিধানের মূল স্তম্ভে স্থান না-পাওয়ার ফলে একটি বিশেষ মতলববাজ মহল থেকে আমাদের ঐতিহাসিক রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধকে একাত্তরের গোলমালের বছর, গৃহযুদ্ধ, ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ইত্যাকার অপবিশেষণে মণ্ডিত করা হয়ে থাকে । স্মরণ করুন, যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের অন্যতম শীর্ষনেতা একাত্তরের আলবদর বাহিনীর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মাওলানা আলী আহসান আল মুজাহিদ একদা জাতীয় সংসদের পবিত্র অঙ্গনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন যে, বাংলাদেশে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি ! তিনি এমন জঘন্যতম রাষ্ট্রদ্রোহ উক্তি করার দু: সাহস পেয়েছিলেন সংবিধানেরই কারণে । সংবিধানের মূল স্তম্ভে 'মুক্তিযুদ্ধ' শব্দটি থাকলে কুলঙ্গার মুজাহিদসহ কেউ মুক্তিযুদ্ধকে এমনি অপবিশেষণে কলঙ্কিত করতে পারতো না । এ বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী আওয়ামী লীগকে এক্ষুনি গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে । অপরদিকে 'মুক্তিযোদ্ধা' শব্দটিও সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকলে তা রাষ্ট্রীয় আইনদ্বারা সুরক্ষিত হতো----ফলে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কহীন অমুক্তিযোদ্ধারা যত্রতত্র মুক্তিযোদ্ধা হতে পারতো না; মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কটূক্তিসহ তাদের জীবনের নিরাপত্তা কেউ বিঘ্নিত করারও দু:সাহস দেখাতে পারতো না ।

অবশ্য বাহাত্তর সনে বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সংজ্ঞা দিয়েছিলেন । সেটাই ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংজ্ঞা । সেই সংজ্ঞাটি হলো : "মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি যিনি যেকোনো একটি সশস্ত্র দলের (ফোর্সের) সদস্য হিশেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন ।" এ ঐতিহাসিক সংজ্ঞার আলোকে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই করলেও ভুয়ারা মুক্তিযোদ্ধা হতে পারতো না । কিন্তু দু:খের বিষয়, বিএনপি-জামায়াত, এমনকি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারও বঙ্গবন্ধু সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞাটিকে হিমাগারে পাঠিয়ে নানান গোঁজামিলের সংজ্ঞায় হাজার হাজার অমুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়ার সুযোগ ও পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছে । এবং সেই সুযোগ ও পরিবেশের ফাঁকফোকর গলিয়ে অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় অমুক্তিযোদ্ধা এমনকি রাজাকাররাও দেদারসে মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছে ! আর এ অশুভ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ছিলেন অতীতের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের একশ্রেণীর স্বার্থান্ধ মুক্তিযোদ্ধা, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অনেক মন্ত্রী এমপি ও নেতা ; হালের জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের কর্তাব্যক্তিরা ।

আমি হলফ করে বলতে পারি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কোনো অবস্থাতেই দেড় লক্ষের বেশি হবে না । কিন্তু এখন দু'লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজারের মতো মুক্তিযোদ্ধার নাম সরকারি তালিকায় উঠেছে । অর্থাত্ সরকারি তালিকায় আশি/পঁচাশি হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মতো রাষ্ট্রীয় ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধাদি ভোগ করছে । এটা মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদার চরম অবমাননা । মুক্তিযোদ্ধা না-হয়েও মুক্তিযোদ্ধা----এটা কোনো সভ্য মানুষ মেনে নিতে পারেন না । এই যে হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, এরা মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় । এ-জন্য আমরা দাবি জানিয়ে আসছি যে, বঙ্গবন্ধুর সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে একটি উচ্চপর্যায়ের বিচার বিভাগ ও সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় কমিশনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নির্ভুল তালিকা প্রণয়ন করত হবে । উপরোক্ত বিষয়াদি নিয়ে প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধারা চরম মনোবেদনা নিয়ে দিনাতিপাত করছেন ।

আমাদের পুন:পৌণিক দাবির প্রেক্ষিতে সরকার আসছে ৩০ জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধাদের ৩৩টি প্রমাণক তালিকার মধ্যে শুধুমাত্র দুটি তালিকা তথা বেসামরিক ও সেনাবাহিনী গেজেটধারী মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বার যাচাই যাচাই করতে যাচ্ছেন । জামুকার চলমান নীতিমালার প্রতি আমাদের তেমন আস্থা নেই । তারপরেও অনিচ্ছা সত্বে আমরা এটাকে সাধুবাদ জানাই । তবে অন্যান্য আরো ৩১টি তালিকার মধ্যেও বিপুলসংখ্যক অমুক্তিযোদ্ধা রয়েছে, সেগুলোও যাচাই যাচাই করতে হবে । কথা হলো, মুক্তিযোদ্ধা তালিকার মধ্যে একটা ভুয়া যেমন থাকতে পারবে না----তদ্রূপ কোনো প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা তালিকার বাইরে থাকবে না । এটাই জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত ।

উপরোক্ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর এ ঐতিহাসিক মর্যাদাপূর্ণ সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার ভিত্তিতে ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নের ঘোষণাসহ বীর মুক্তিযোদ্ধারদের মাসিক ভাতা যৌক্তিক পর্যায়ে বৃদ্ধি, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ চিকিৎসা ভাতা ও বাসস্থানের জন্যে ২০ লক্ষ টাকার গৃহঋণ প্রদান বিষয়ে একটি ঐতিহাসিক প্যাকেজ ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অশান্ত মনকে শান্ত করবেন বলে সচেতন দেশবাসী ও মুক্তিযোদ্ধা সমাজ গভীর প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করছেন । কারণ মেঘে মেঘে অনেক বেলা গড়িয়ে গেছে । প্রতিদিন বীর মুক্তিযোদ্ধারা চরম হতাশা নিয়ে জীবন থেকে বিদায় নিচ্ছেন । তারা জীবনের এ-প্রান্ত:সীমায় দাঁড়িয়ে জীবদ্দশায় তাদের ঐতিহাসিক অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, একটু উন্নত জীবন ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা দেখে যেতে চান ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।