আবীর আহাদ


ধর্মীয় অনুভূতির কারণে অর্দ্ধশিক্ষিত মোল্লাদেরকে সমাজে সম্মান দেয়ার ফলে তারা ভেবে বসেছে যে, তারা খুব জ্ঞানী, আর সবাই অজ্ঞ ! তাই তারা নিজেদের একপেশে সীমিত জ্ঞান দিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে সবাইকে তাদের অধীনস্থ ভাবে । তাদের একটা বিশাল অংশ ধর্মের আলখাল্লা পরে যাবতীয় ব্যভিচার ও হিংসার বিষবাষ্প ছড়িয়ে সমাজকে কলুষিত করে চলেছে । তারা পরজীবী । দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এদের কোনোই ভূমিকা নেই । তাদের একমাত্র পুঁজি ধর্মব্যবসা । তারা ধর্মান্ধ । তারা তাদের এই অন্ধত্ব দিয়ে সাধারণ ধর্মভীরু মানুষের ধর্মানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে সমাজে তাদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে চায় । পবিত্র কোরআনের কিছু সুরা ও মছলা মুখস্থ করে তারা বিজাতীয় ভাষার কিছু কবিতা আউড়ে প্রমাণ করে যে, তারা বড়োই ধর্মীয় পণ্ডিত । অথচ তাদের চেয়ে সাধারণ মুসল্লিরা অনেক বেশি ধর্মপ্রাণ । তারা নিজেদেরকে সবজান্তা ভাবতে গিয়ে সমাজ ও যুগের বাস্তবতাকে অস্বীকার করে ধর্মের বস্তাপচা ফতোয়া মেরে গোটা দেশকে তারা তাদের করায়ত্তে নিতে চায় । সমাজ ও দেশকে পিছিয়ে দিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করতে চায় । ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষের ধর্মানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে তারা দেশকে অস্থিতিশীল করে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চায় । অথচ যে দেশটার ওপর দাঁড়িয়ে তারা আজ দেশটাকে করায়ত্ত করতে চাচ্ছে, সে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ভাষা, জাতীয়তা, মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা, জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা, রাষ্ট্রীয় সংবিধান ও মূলনীতি কোনোকিছুই তারা মানে না !

তাদের একটি বিশাল অংশ মাদ্রাসা, এতিমখানা ও মসজিদ কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ছাত্র বলৎকার, নারী শিশু ধর্ষণের মতো জঘন্যতম ব্যভিচারে লিপ্ত থাকলেও এসবের বিরুদ্ধে তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ নেই; ফতোয়া নেই ! দেশের মধ্যে দুর্নীতি ও লুটপাটের যে মহোৎসব সংঘটিত হচ্ছে, এসবের বিরুদ্ধেও তাদের কোনো বক্তব্য বা ফতোয়া নেই । কারণ যারা মনের দিক দিয়ে নষ্টা ও ভ্রষ্টা, তারা নষ্টাচারের বিরুদ্ধে লা-জবাব থাকবে, এটাই স্বাভাবিক !

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যখন দেশের সব শ্রেণী-পেশা, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি মুসলমান হিন্দু বৌদ্ধ খৃস্টানসহ সাঁওতাল মণিপুরী মগ মার্মা খাসিয়া প্রভৃতি উপজাতির বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে 'যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে' ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো-----এমনকি এদেশীয় মোল্লাদের চোখে কাফের-মালাউন-নাস্তিক বলে বহুলখ্যাত ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন সরাসরি মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো----বিশ্বের সব মানবতাবাদী গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক প্রগতিশীল বিজ্ঞানী কবি সাহিত্যেকি সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী শিল্পী অভিনেতা শিক্ষাবিদ ছাত্র শ্রমিক প্রমুখরা বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন----তখন এই বাংলাদেশের মোল্লা সম্প্রদায়ের ৯৯% অংশ পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে সেটিকে টিকিয়ে রাখার জন্যে শুধু দোয়া-দরুদ পড়েননি, তারা হানাদার বাহিনীর সশস্ত্র সহযোগী হিশেবে রাজাকার আলবদর আলশামস আলমুজাহিদ ও শান্তি কমিটি গঠন করে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন-----গণহত্যা নারীধর্ষণ অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের মতো জঘন্যতম অমানবিক অপরাধকর্মের সাথে জড়িত ছিলেন ।

শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বাঙালি নারীদের 'গণিমতের মাল' ফতোয়া দিয়ে তাদেরকে ভোগ করা ইসলামসম্মত বলে ফতোয়াও দিয়েছিলো । ৩০ লক্ষ মানুষকে নিধন ও পৌনে ৩ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত হরণযজ্ঞে তারা তাদের প্রভূ পাকিবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলো । আরো কী আশ্চর্য, স্বাধীনতার সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পরেও তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মেনে নেয়নি । মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের জাতীয় সংবিধানের চার মৌলনীতি গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তারা কুফরি মতবাদ বলে আখ্যায়িত করে থাকে । বাংলাদেশের জাতির পিতা, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত তারা মানে না । কী পরিতাপের বিষয় এই যে, তারা তাদের পরবর্তী প্রজন্মসমূহকেও তাদের একই মতাদর্শে দীক্ষিত করেছে ।

এই অর্দ্ধশিক্ষিত অসভ্য মোল্লা সমাজ যারা মূর্তি ও ভাস্কর্যের মধ্যের পার্থক্য বোঝে না----একটা জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি কৃষ্টি সম্পর্কে যাদের বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই, তাদেরকে জ্ঞান দান করা বৃথা । তাদের মধ্যকার কিছুসংখ্যক ধর্ম ব্যবসায়ী একপেশে সীমিত জ্ঞান দিয়ে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক ভাস্কর্য শিল্পের মধ্যে ইসশামী ধর্ম ধ্বংসের গন্ধ আবিষ্কার করে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে ধর্মের নামে যে অপরাজনীতির উস্কানি দিয়েছেন তাতে পরিষ্কার হয়েছে যে, ভাস্কর্য নয়, মুজিব তথা বঙ্গবন্ধু বিরোধিতাই তাদের মূল লক্ষ্য । অন্যান্য ইসলামী দেশে সেসব দেশের জাতীয় রাজনীতিক, জ্ঞানী-গুণীজনদের প্রচুর ভাষ্কর্য থাকলেও সে-বিষয়ে মোল্লাদের কোনো রা নেই, পাকিস্তানর জাতির পিতা জিন্নাহর ভাষ্কর্যের কোনো বিরোধিতা নেই, বিরোধিতা নেই জিয়ার ভাষ্কর্যের বেলায়ও ! কারণ জিন্নাহ-জিয়া তাদের পেয়ারা বলে তাদের বেলায় তারা লা জবাব । তাদের যাবতীয় রাগ-বিরাগ হলো শেখ মুজিবকে নিয়ে, কারণ তিনি তাদের পেয়ারা পাক ওয়াতন ভেঙে দিয়েছেন, তাদের ধর্ম ব্যবসা বন্ধ করার ব্যবস্থা করেছিলেন ।

রাজাকার জুনায়েদ বাবু নগরী, মামুনুল হক, ফয়জুল হক, মিজানুর আজহারী প্রমুখ মাওলানা নামের রাজাকার ও আলবদর শাবকরা ভাষ্কর্য নিয়ে বাংলাদেশের চেতনার ধেদীমূলে যে কুঠরাঘাত হেনেছেন, এদেরকে আইনের ডাণ্ডা মরে ঠাণ্ডা করে দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া দরকার যে, বাংলাদেশ কোনো ধর্মরাষ্ট্র নয় । ১৯৭১ সালে আমরা কোনো ধর্মের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ধর্ম প্রতিষ্ঠা বা ধর্ম উৎখাতের জন্যে মুক্তিযুদ্ধ করিনি । আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতান্ত্রিক চেতনা, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ও আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক মুক্তির লক্ষ্যে এক সর্বাত্মক বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করেছি, যে দেশে সবাই যে যার মতো ধর্ম পালন করবে । কেউ কারো ধর্মের ওপর অন্য ধর্ম চাপিয়ে দিতে পারবে না । আমরা বিশ্বাস করি, ধর্মের জন্যে মানুষ নয়-----মানুষের জন্যে ধর্ম । কে কোন ধর্ম পালন করবে কি করবে না সেটা ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব এখতিয়ার । রাষ্ট্র সব ধর্মের মানুষের ধর্ম পালনের নিশ্চয়তা দেবে, তবে বিশেষ কোনো ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা দেবে না । সব ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে । এজন্য রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ । সুতরাং বাংলাদেশ পরিচালিত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে তথা গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে । অথচ এদেশের কাঠমোল্লাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকার সম্পর্কে কোনোই ধারণা নেই; বিশ্বাস নেই ।

সুতরাং মোল্লা নামক এহেন অর্দ্ধশিক্ষিত, দেশ ও জাতিদ্রোহী, পাষণ্ড একপেশে ও ধর্মের আচ্ছাদনে ভালোমানুষের ছদ্মবেশধারী অসভ্য এক কিংভূতকিমাকার প্রজাতিকে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের মাটিতে ধর্মের নামে এভাবে বিচরণ করতে দেয়া যায় না । তাদেরকে দেশের প্রচলিত আইনের নিয়ন্ত্রণে এনে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে প্রয়োজনে জবরদস্তিমূক বিতাড়িত করে ধর্মীয় অঙ্গনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার ব্যবস্থা করা এখন সময়ের জরুরি দাবি ।

লেখক :মুক্তিযোদ্ধা লেখক গবেষক,চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।