রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : আরশাদ আলী মোড়ল ওরফে আশু মোড়ল। বয়স-৮৩। বাবা মৃত মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন মোড়ল। বাড়ি সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম নারায়ণপুর গ্রামে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানি উপজেলার চাপতি বাজার থেকে দীর্ঘপথ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে রাজাকার ও পাকসেনাদের চোখ এড়িয়ে শেখ কামাল ও শেখ মুজিবের ভাগ্নে ইলিয়াছকে কালিগঞ্জের তারালী ইউনিয়নের রহিমপুর গ্রামের ঠাণ্ডাই গাজীর  বাড়িতে আসেন। সেখানে দু’ সপ্তাহ রাখার পর নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তুলে ছুটিপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হিঙ্গলগঞ্জ পৌঁছে দিয়ে একইসাথে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। 

শনিবার দুপুরে নিজ বাড়িতে তার দীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন আশু মোড়ল। এ সময় স্মৃতিচারণা করেন রহিমপুর গ্রামের ঠাণ্ডাই গাজীর ভাই মহাতাবউদ্দিন ও ছেলে মোকছেদ আলী।

আশরাদ আলী মোড়ল ওরফে আশু মোড়ল বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ২০ বছর। অভাবের তাড়নায় লেখাপড়া হয়নি। খুলনা থেকে সার কিনে এনে এলাকায় বিক্রি করতেন তিনি। আনুমানিক ১৯৭১ সালের মার্চের শেষের দিকে খুলনার ফুলতলায় বন্দুকের দোকান লুট হয়। ওই দিন খুলনার তারপুকুর শান্তিধামের মোড়ে দরবার মেডিকেলের বারান্দায় তার সঙ্গে ব্যবসায়ী গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি থানার চাপতা বজারারের আব্দুর রহমান মিন্নুর পরিচয় হয়। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় আব্দুর রহমান তাকে ওই দিন তার বাড়িতে(মধুমতী নদীর তীরে) ডেকে নিয়ে যান। সেখানে অবস্থানকালে তিনি মধুমতী নদীতে পাকিস্তানি খান সেনাদের গানবোর্ট চলতে দেখেছেন। নিরাপত্তাজনিত কারণে দু’দিন পর তাকে নিয়ে ওড়াকান্দি ঠাকুরবাড়ি (হংসীবদ, মিহির ও সমীর তিন ভাই) আনা হয়।

এক সপ্তাহ পর বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করায় মিহির ঠাকুর ভারতে যেতে ইচ্ছুক এমন দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে যেতে বলে হাতে ২০ হাজার টাকা ধরিয়ে দেন। ওইদিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে তাদেরকে নিয়ে তিনি আব্দুর রহমানের বাড়িতে আসেন। সেখানে যেয়ে জানতে পারেন যে তার সঙ্গে থাকা মানুষ দু’টি একজন মুক্তিযুদ্ধের আহবানকারি শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে শেখ কামাল হোসেন (১৮) ও শেখ মুজিবের ভাগ্নে ইলিয়াছ (২১)। পরদিন ভোরে যাত্রা শুরু করে পানকার নদী পেরিয়ে চর বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে যশোর, খুলনা ও গোপালগঞ্জের বর্ডার গাজীরহাটে আসেন। আব্দুর রহমার একজন গোড়া আওয়ামী লীগার হওয়ার সুবাদে গাজীরহাটের চেয়ারম্যান হামুর সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেয়। হামু চেয়ারম্যানের সহায়তা নিয়ে পাকসেনা ও রাজাকারদের চোখ এড়িয়ে তারা (রেলগেট থেকে সুশীলগাতি হয়ে) দৌলতপুরে আসেন। সেখান থেকে গল্লামারি গণরেডিও সেন্টারের পাশ দিয়ে কৈয়ে বাজারের আগের একটি পথ বেয়ে দুপুর আড়াইটার দিকে বটিয়াঘাটা এলাকার সরাফপুর পৌঁছান তারা। সেখান থেকে তারা নৌকায় পাইকগাছার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পথিমধ্যে মাঝির পরিচিত একটি বাড়িতে যেয়ে তারা খাওয়া দাওয়া করেন। তখন মাগরিবের আযান হয়। সেখান থেকে নৌকাযোগে পাইকগাছার কাটাখালি তিন গাঙের মুখে এলে কেয়ারগাতির মুসলিম লীগ নেতা মকবুল চেয়ারম্যানের চারজন লোক তাদেরকে নৌকা ভিড়াতে বলে।

এ সময় সাতক্ষীরা ক্যাম্পে দেওয়ার কথা বলে শেখ কামাল ও ইলিয়াছের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরদিন সকালে তারা আশাশুনি খেয়াঘাটে আসেন সেখান থেকে পায়ে হেঁটে চাচাত ভাই আমুদ আলীর কালিগঞ্জের তারালী ইউনিয়নের রহিমপুরে শ্বশুর ঠাণ্ডাই গাজীর বাড়ি যাই। সেখানে শেখ কামাল, আব্দুর রহমান ও ইলিয়াছকে রেখে তিনি বাড়িতে আসেন। ঠাণ্ডাই গাজীর বাড়ির দোতলায় তাদেরকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ১৪ দিন রাখা হয়। রহিমপুর থেকে আটটি সাইকেল হেলিকপ্টারে করে লাইনম্যান হিসেবে রাঙার কৌশলে বাবু গাজী, মোহাম্মদ গাজী, আবুল গাজী,নূর আব্দুল বিশ্বাস ও সামছুর রহমানসহ কয়েকজনের সহায়তায় সন্ধ্যায় ছুটিপুরের ঘাট মালিক ঘড়ি মোহাম্মদের সঙ্গে মাথাপিছু ২০০ টাকা চুক্তিতে নৌকায় ইছামতী পার হয়ে তারা হাসনাবাদ আসেন। পরদিন হাসনাবাদ বাজারে ক্যাপ্টেন নুরুল হুদার বাসায় যান তারা। খবর দিয়ে টাকী থেকে ডেকে আনা হয় মেজর আব্দুল জলিলকে। পরদিন তাদের নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতার দমদম পাতিপুকুরে। সেখানে দেখা হয় জাতীয় নেতা তাজউদ্দিন আহম্মেদ, মুনসুর আহম্মেদ, তোফায়েল আহম্মেদ ও নজরুল ইসলামের। সেখান থেকে তাকে (আশু) পার্ক সার্কাসে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৬৫ সালে আনসার ট্রেনিং থাকায় শেখ কামালের কথামত তাকেও হাওড়া থেকে ট্রেনে করে বিহারের চাকুলিয়ায় ট্রেনিং এ নিয়ে যাওয়া হয়। তখন মেজর জলিল ছিলেন ৯নং সেক্টর কমাণ্ডার। ১৪ দিন ট্রেনিং দিয়ে সেখান থেকে কামাল, ইলিয়াসের সাথে তাকেও হাসনাবাদে ফিরিয়ে আনা হয়। সেখান থেকে কালিগঞ্জে এসে একদিন বাড়িতে রাখার পর কামাল ও ইলিয়াছকে গোপালগঞ্জ পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফেরেনি তিনি। বাড়ি ফিরেই আবারে চলে যান হাসনাবদের টাকীতে। সেখান থেকে সহকর্মীদের সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পাকাসেনা ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে নামেন তিনি।

১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর নারায়নপুরের ডাকবাংলা (ওয়াপদা অফিস) থেকে পাক সেনাদের তাড়িয়ে আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ওই স্থান দখলে নেয়। ওইদিনই সেখানে আব্দুল জলিলের পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে লাল সবুজের পতাকা তোলেন। এসময় তার সঙ্গে দেখা হয় শেখ মুজিবের ভাই নাসিরউদ্দিনের (খোড়া) সাথে। পরদিন সোহরাওয়ার্দ্দি উদ্যানে তোলা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা।

রহিমপুরের ঠাণ্ডাই গাজীর ছেলে মোকছেদ গাজী ও তার চাচা মহাতাবউদ্দিন বলেন, ঠাণ্ডাই গাজী ১৯৯৭ সালের ২৭ নভেম্বর মারা গেছেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের প্রথম দিকে তারা শেখ কামাল, ইলিয়াস, আব্দুর রহমানকে দেখেছেন তাদের বাড়িতে। নিরাপত্তার কারণে শেখকামালের কাছে দেওয়া হয় তাদের লাইসেন্সকৃত বন্দুক। সেখানে থাকাকালিন পিস কমিটির সভাপতি ফজলুল করিম সানা, সদস্য ইমান আলী সানা, জামাত আলী, মোহর আলী সানা, ধোনাই সানা, খোদাবক্স গাজী ও খোদাবক্স সানাসহ একটি লোকও পর্যন্ত তাদের কোনপ্রকার সমস্যা করেনি। বরং নিরাপদে কালিগঞ্জ সীমান্তে পৌঁছে দিতে সহায়তা করেছেন। তারা (মোকছেদ আলী) ইউনিয়ন জাতীয় পার্টির সভাপতি ও চাচা (মহাতাবউদ্দিন) জাতীয় পার্টির সক্রিয় সদস্য। এরপরও ২০১৩ সালে নব্য আওয়ামী লীগার ইসরাইল মেম্বর ও জহুর সানা এসআই সাগরকে দিয়ে মহাতাবউদ্দিনের ছেলে মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগ এনে বহু টাকা ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। ভুয়া ডিবি পুলিশ সেজে তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। ভাই আবুল কাশেমের ছেলে নিরীহ ঔষধ ব্যবসায়ি মহিউদ্দিনের নামে তিনটি নাশকতার মামলা দেওয়া হয়েছে। ইসরাইল মেম্বর ও জহুর সানার মাধ্যমে এক লাখ টাকা দিয়ে ওই মামলা থেকে অব্যহতি পেতে হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা আশু মোড়ল বলেন, ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কালিগঞ্জে এসেছিলেন। ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন ও ১৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে নভেম্বরের শেষের দিকে নির্বাচনে জনসংযোগ করতে তিনি সোহরাওয়ার্দি মাঠে এক মঞ্চে এক ঘণ্টা বক্তব্য দেন। সে সময় মঞ্চে ছিলেন ডাঃ হযরত আলী, গাজী আবু সাঈদ, বেতার শিল্পী শান্তি গোপাল চক্রবর্তী, জেহের আলী মাষ্টার, ফেরাজতুল্লাহ, খায়রুল আলম, এএফএম এন্তাজ আলী, যশোর জাতীয় পরিষদের মশিউর রহমান, সংগ্রাম পরিষদের প্রচার সম্পাদক শীতলপুরের মনির আহম্মেদ, কলারোয়ার মমতাজ আলী, অ্যাড, আব্দুল গফফার, কয়েকজন। ওই সময় অস্থায়ী সকোর গঠিত না হওয়ায় বাংলাদেশীরা দলে দলে দেশ ছেড়ে ভারতে শরণার্থী হন।

আশু মোড়ল আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, শেখ কামাল ও ইলিয়াছকে সাক্ষাৎ পাক হানাদারদের কালো থাবা থেকে রক্ষা করে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। একসাথে ট্রনিং নিয়েছেন । ১৯৭০ এ বঙ্গবন্ধু কালিগঞ্জে এসে কালিগঞ্জবাসিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উৎসাহিত করেছেন। অথচ যারা সেই মুক্তিযুদ্ধের স্থপতি তাদেরই স্মরণীয় কীতি সম্পর্কে কালিগঞ্জে কোন স্মৃতিস্তম্ভ নেই। এমনকি পশ্চিম নারায়নপুর হাসপাতালের পিছনে পাকসেনারা একইসাথে ১৪ জনকে, গুল্লিরখালের পাশে পাঁচজনকে (পাঁচপোতা নামে পরিচিত) গুলি করে মাটিতে পুঁতে ফেলেছিল। এছাড়াও ওয়াপদা ডাকবাংলোর পাশে বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকজনকে গুলি করে ড্রেন দিয়ে লাশ খালে ফেলে দেওয়া হয়। আসন্ন স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতেও সংরক্ষণ করা হয়নি ওইসব গণকবরগুলো। অবেশেষে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, মুক্তিবার্তায় নাম থাকার পরও ভাতা বন্ধ করে দেওয়ায় সু চিকিৎসার অভাবে বিষ্ণুপুরের মুক্তিযোদ্ধা গোবিন্দ রায় মারা যাওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক।

(আরকে/এসপি/জানুয়ারি ১৬, ২০২১)