আয়েশা সিদ্দিক সামিয়া


কি দেখার কথা কি দেখছি!
কি শোনার কথা কি শুনছি!
কি ভাবার কথা কি ভাবছি!
কি বলার কথা কি বলছি!
৩০ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি

........জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী হায়দার হোসেন তাঁর এ গানে স্বাধীনতাকে খুঁজছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিনি স্বাধীনতা খুঁজছেন? তবে কি স্বাধীনতা তা নয় যা আমরা অর্জন করেছি, স্বাধীনতা মানে কি শুধু 'স্বাধীন' নামটি বয়ে বেড়ানো? তবে স্বাধীনতা মানে যা খুশি তা করা নয়। স্বাধীনতা মানে মুক্তচিন্তা, যেখানে থাকবে গণতন্ত্র, যেখানে দেখা হবে জনগণের স্বার্থ, দেশের স্বার্থ।

বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে উল্লেখ করা রাষ্ট্রপরিচালনার চারটি মূলনীতির মধ্যে একটি হলও গণতন্ত্র। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ‘জনগণ’ই প্রধান। জনসাধারণের প্রতিক্রিয়াই নির্ধারণ করে দেশটি কিভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। অর্থাৎ গণতন্ত্র হলও জনসাধারণের শাসন ব্যবস্থা। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা গণতন্ত্র, ফলে গণতন্ত্রে নাগরিকদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের যথেষ্ট সুযোগ ও স্বাধীনতা থাকে। গণতন্ত্র ও গণমাধ্যম একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গণতন্ত্রের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অপরিহার্য।

কোনও রাষ্ট্র যদি নিজেকে গণতান্ত্রিক দাবি করে তবে সেখানে গণমাধ্যমের একশভাগ স্বাধীনতা থাকতেই হবে। যে গণমাধ্যম সরকারের সমালোচনা করবে, সেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আবার সেই সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। জনসাধারণের কথাই উঠে আসে গণমাধ্যমে। তাই এই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। গণমাধ্যম মানুষের জন্য তথ্যের বৃহত্তর প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করে। সরকারের সমালোচনার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়, এতে গণমাধ্যমের ভূমিকাই সর্বাধিক। অমর্ত্য সেন বলেছেন, রাষ্ট্রে গণমাধ্যম স্বাধীন হলে এমনকি দুর্ভিক্ষও ঠেকিয়ে দেওয়া যায়। অজ্ঞতা ও ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি না করে জনগণ রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞাত হয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে পারে, সচেতন ভোটাররা তখন খারাপ শাসককে ক্ষমতা থেকে ফেলে দিতে পারে। আবার গণমাধ্যম এর সঠিক চর্চা রাষ্ট্র ও জনসাধারণের মাঝে সেতু তৈরি করে।

তবে অনেক সময় গণমাধ্যমকেও পক্ষপাতিত্ব করতে দেখা যায়। নানান মতাদর্শের ভিন্ন আঙ্গিক সংবাদ জনসাধারণের কাছে তুলে ধরা হয়। এর মাধ্যমে গণমাধ্যম অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উৎসাহিত করে। আবার অনেক সময় গণমাধ্যম চাইলেও সঠিক ও মুক্তচিন্তার প্রকাশ ঘটাতে পারে না। ১৯৮০'র এরশাদের সামরিক শাসনামলে সাংবাদিক নির্যাতন বা বিরোধী চিন্তার পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সাংবাদিকরা এতো চাপের মুখে থাকা স্বত্বেও কেউ কেউ আবার নির্ভীকভাবে সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করত।

রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীনের অন্তর্র্বতীকালীন সরকার কর্তৃক প্রেস ও পাবলিকেশন অ্যাক্ট ১৯৭৩ সালের ২৩ নং আইন সংশোধনীর পরেই গণমাধ্যমে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। এরপর নতুন শতকে ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমের বিস্ফোরণে অনেক টেলিভিশন ও রেডিও চ্যানেলের আগমন ঘটে। সাম্প্রতিক সময়ে ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক মাধ্যমে জনসাধারণেরা সরাসরি মত প্রকাশ করতে পারছেন। এখন আর মত প্রকাশের স্বাধীনতা শুধুমাত্র সংবাদপত্রের উপরই নির্ভর করেনা। মত প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে যুক্ত হয়েছে সামাজিক মাধ্যম (ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার) ও ব্লগ। তবে নানান আইনের বেড়াজাল, এমনকি জীবনের হুমকির মুখে পড়ার শঙ্কায় মুক্ত চিন্তাবিদরা। আবার ভিন্ন চিত্রও দেখা যায়, স্বাধীন গণমাধ্যমের সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক কিংবা ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষায় অনেক সময় ভুল সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করা হয়, এর ফলে গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র বাধাগ্রস্ত হয়। পুঁজিপতি মালিক ও বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রভাবও স্বাধীন সাংবাদিকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। মত প্রকাশের স্বাধীনতা জনগণের একটি মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশের সংবিধানের ধারার ৩৯(১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে এবং ৩৯(২) সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। আলোচনা, মতপ্রকাশ, ঐক্য হলও গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ সিড়ি। যেখানে গণমাধ্যম যত বেশি শক্তিশালী সেখানে গণতন্ত্র ততো বেশি শক্তিশালী।


২০১৩ সালের সংশোধিত আইনের ৫৭ ধারাটি ছিল সাংবাদিকদের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশেষত ডিজিটাল মাধ্যমে মানহানিকর কিছু বলা হলে তার বিরুদ্ধে যে শাস্তির বিধান রাখা হয় তা ছিল কঠোর এবং প্রচলিত আইন ও সাংবিধানিক পরিকাঠোমের বিরোধী। পরবর্তীতে সেই ৫৭ ধারাকে বাতিল করা হয় এবং নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রবর্তন করা হয়। তবে এই আইনের বেশ কিছু ধারা নিয়েও রয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।

গণমাধ্যম এর সঠিক চর্চা যেমন গণতন্ত্র রক্ষা করতে পারে তেমনি প্রকৃত গণতন্ত্র পারে গণমাধ্যমকে স্বাধীন রাখতে। স্বাধীন গণমাধ্যম যেকোনো সরকারের সেরা বন্ধু। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে একটি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সূচক হিসেবে ধরা হয়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন গণতন্ত্রের একটি জনপ্রিয় সংজ্ঞা দিয়েছেন। তাঁর মতে ‘জনসাধারণের জন্য, জনসাধারণের দ্বারা পরিচালিত এবং জনসাধারণের সরকারই হল গণতন্ত্র’। আর গণমাধ্যমের কাজ হলও এই জনগণের বার্তা নিরপেক্ষ ও নির্ভুলভাবে সরকারের কাছে তুলে ধরা। একটি দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে কি নেই এবং নাগরিকের চিন্তার স্বাধীনতার আছে কি নেই, তা দিয়ে সহজেই গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি পরিমাপ করা সম্ভব। সে হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশে গত এক দশকে সরকারব্যবস্থা যেমন গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে ক্রমশ একদলীয় বা একনায়কতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে, তেমনি মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে।

অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘সংবাদমাধ্যমের ওপর লাগাম টানার ফলে যেসব তথ্য সুপ্ত হয়ে যায়, তা একনায়কতান্ত্রিক সরকারকেই ভুল পথে চালিত করে। এটা অবশ্যই সত্য যে সংবাদমাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ কেবল নাগরিকদেরই অন্ধকারে রাখে না, সরকারের কাছেও অতি জরুরি তথ্য পৌঁছাতে দেয় না।’ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের একটি স্তম্ভ। এই স্তম্ভকে যতো মজবুত করা যাবে দেশ পরিচালনা ততই স্বচ্ছ হবে। গণতন্ত্র আর প্রশ্নবিদ্ধ হবে না। এর ফলে গণমাধ্যমের সমন্বয়হীনতা রোধ করা জরুরি। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।