আবীর আহাদ


জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, দেশে একজন মানুষও ভূমিহীন-গৃহহীন থাকবে না; সবারই মাথার ওপর নিদেনপক্ষে এক টুকরো ছাদের ব্যবস্থা করা হবে । তিনি ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে আজ ২৩ জানুয়ারি সকালে গণভবন থেকে দেশের ৬৪ জেলার ৪৯২টি উপজেলার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছেন । তিনি আজ ৬৯ হাজার ৯শ' ৪ জন ভূমিহীন ও গৃহহীনকে ঘর প্রদান কার্যক্রমের প্রথম পর্যায়ের শুভ উদ্বোধন করেছেন । সবার ঘরে বিদ্যুৎ ও সুপেয় পানি সরবরাহের বন্দোবস্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন । প্রতিটি জমি ও বাড়ির মালিকানা স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে দেয়া হচ্ছে । দেশের প্রতিটি মানুষ ঘর না পাওয়া পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে এই কার্যক্রম চলমান থাকবে বলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এহেন কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি সত্যিকার অর্থে তাঁর 'জননেত্রী' নামের মর্যাদা রক্ষা করে চলেছেন।

বঙ্গবন্ধু-কন্যার এমন জনকল্যাণ ও মানবতাবাদী কার্যক্রমের ফলশ্রুতিতে আমরা যারপরনাই তাঁর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি । সেই সাথে প্রধানমন্ত্রীর সদয় জ্ঞাতার্থে বলছি যে, যাদের শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বে দেশটি অর্জিত হয়েছে, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে তিনি এখন নিশ্চয়ই দৃষ্টি দেবেন । তিনি অবশ্যই জানেন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশই গৃহহীন ও ভূমিহীন । অতীতে কোনো সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অতোটা দৃষ্টি দেননি, যতোটা তিনি দিয়েছেন । মাসিক ১২ হাজার টাকা ভাতা দিয়ে তিনি তাদের মুখে একটু অন্ন তুলে দিয়েছেন । তারা এখন অতি বৃদ্ধ ও রোগাক্রান্ত । অতীতে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যহীনতার অভিশাপে তাদের জীবন তছনছ হয়ে গেছে । তিনিই তাদের একমাত্র ভরসা । তাদের অন্ন, বাসস্থান ও চিকিৎসা----এ সবকিছু এখন তাঁর বদান্যতার ওপর নির্ভর করছে । বিশেষ করে মাথা গোঁজার ঠাঁইটাই এ-মুহূর্তে অতি জরুরী । তবে সরকারের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা বিনামূল্যে গৃহ চাচ্ছেন না । এ-বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে নিম্নরূপ-----

২০২০ সালের গোড়ার দিকে ১৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে বাড়ি করে দেয়া হবে বলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বাহাদুর ঘোষণা দেয়ার পর উপজেলায় উপজেলায় যে বাণিজ্যিক ধান্দা শুরু হয়েছে, সেটাকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নির্মম তামাশা বলে প্রতিভাত হচ্ছে। দেশের ৯০% শতাংশ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বলা চলে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করে চলেছেন । এ অবস্থায় ঐ তথাকথিত ১৪ হাজার বাড়ি কারা কীভাবে পাবেন তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয় । তাছাড়া এই বিরাট সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে পর্যায়ক্রমে বাড়ি করে দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হলে সেজন্য কতোটি বছর অতিবাহিত হবে এবং ততোদিন মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে থাকবেন কিনা তা কি মন্ত্রীবাহাদুর বলতে পারবেন ? এ-ব্যতীত প্রত্যেক উপজেলায় প্রকৃতই গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি খরচে নির্মিত বাড়ি পাবেন----- তার কী কোনো নিশ্চয়তা আছে ? অভিযোগ পাচ্ছি, উপজেলা পর্যায়ে একশ্রেণীর প্রতারকচক্র স্থানীয় প্রশাসনের যোগসাজশে পর্দার অন্তরালে সর্বোচ্চ ঘুষদাতা মুক্তিযোদ্ধাকে বাড়ি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অগ্রিমও গ্রহণ করেছে ! এ-প্রক্রিয়ায় আর্থিক প্রতিযোগিতায় কোনো প্রকৃত গৃহহীন দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা নয়----বাড়িগুলো পাবে টাকাওয়ালা ও রাজনৈতিক যোগাযোগের অবস্থাসম্পন্ন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা । ইতোমধ্যে বিভিন্ন উপজেলা থেকে তথাকথিত সরকারি বীর নিবাস প্রাপকদের যে তালিকা সুপারিশ আকারে মন্ত্রণালয়ে পাঠনো হয়েছে তার মধ্যে উপরোক্ত আশংকার সত্যতা পাওয়া গেছে ।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীবাহাদুর এ পর্যন্ত যতোগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার কী পরিমাণ বাস্তবায়ন ঘটেছে তা তিনি না জানলেও আমরা জানি । তাঁর কোনো প্রতিশ্রুতিই বাস্তবায়িত হয়নি । তাঁর প্রতিটি বক্তব্য ফাঁপা বুলিতে পরিণত হয়েছে । মুক্তিযোদ্ধারদের শৌর্য ত্যাগ ও বীরত্বে দেশটি স্বাধীন হয়েছে বলেই যিনি জীবনে যা কল্পনাও করেননি তিনি তাই হয়েছেন, হচ্ছেন এবং হতেই থাকবেন । অতএব জাতীয় দায়িত্ববোধ থেকেই যেমন সরকারকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে ভুয়াদের উচ্ছেদ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে ; সেই সাথে উন্নত চিকিত্সার ব্যবস্থাসহ তাদের জাতীয় মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে । এছাড়া দ্রুততম সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের বেকার সন্তানদের বিশেষ নিয়োগের মাধ্যমে সরকারি চাকরি প্রদানসহ বাজার মূল্যের সাথে সংগতি রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা বৃদ্ধিসহ প্রত্যেক গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের ভাতা থেকে মাসিক ৫০০০|= টাকা কেটে নেয়ার শর্তে এককালীন অতি নামমাত্র সুদে ২০ লক্ষ টাকার গৃহঋণ প্রদান করা যেতে পারে ।

যা করার তা মুক্তিযোদ্ধাদের জীবিতকালের মধ্যেই করতে হবে । কারণ মুক্তিযোদ্ধারা পৃথিবীতে আর তেমন বেশি দিন বাঁচবেন বলে মনে হয় না । এছাড়া তথাকথিত ১৪ হাজার বাড়ি বরাদ্দকে কেন্দ্র করে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে টানাপোড়েনের মাধ্যমে একে অপরের সাথে চরম রেষারেষি ও হানাহানি সৃষ্টি হয়েছে । কারণ সব মুক্তিযোদ্ধাই তো এ-সুযোগ পাওয়ার সমান অধিকারী । সবাই মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিতে গিয়েছিলো । মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কেউ ছোটো বা কেউ বড়ো মুক্তিযোদ্ধা বলতে কিছু নেই । সবাই মুক্তিযোদ্ধা । বাড়ি দিতে হলে সবাইকে দিন, অন্যথায় এ অবাস্তব জগাখিচুড়ি ও হানাহানিপূর্ণ পরিকল্পনা বাদ দিন । তারচে' ভালো, সবাইকে গৃহঋণের আওতায় ছেড়ে দিন । যার প্রয়োজন সে ঋণ নেবে অথবা নেবে না । এতে সবাই একটি সান্ত্বনা পাবে । কোনো মন খারাপের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না, হবে না কোনো হানাহানি । অপরদিকে এ ঋণের বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ঋণখেলাপীও হবে না । কারণ তারা ঋণ নেবে তাদের ভাতার বিপরীতে----যে ভাতাটি রয়েছে সরকারেরই হাতের মুঠোয় । ভাতাটিই তাদের ঋণের নিরাপত্তা----কো-লেটারাল সিকিউরিটি হিশেবে কাজ করবে । সুতরাং মুক্তিযোদ্ধদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করবেন না । এটা করে তাদের মনে ব্যথা দেবেন না । তাদের জন্যে উপরোক্ত প্রস্তাবনার গৃহঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করে তাদের অশান্ত মনে একটু শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়ার জন্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আবেদন জানাচ্ছি ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।