রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : মহানবীকে অবমাননা করা হয়েছে দৈনিক দৃষ্টিপাত পত্রিকার এক মিথ্যা খবরের ভিত্তিতে ফতেপুর ও চাকদাহে  ১২টি হিন্দু পরিবারের ঘরবাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাসহ এলাকায় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

রবিবার সকাল ১১টায় সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণুপুর বাজারে এ কর্মসুচি পালন করা হয়।

বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল হকের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন মানবাধিকার কর্মী রঘুনাথ খাঁ, শঙ্কর সরদার, সমীর কুমার মণ্ডল, হিন্দু মহাজোটের কালিগঞ্জ শাখার সভাপতি গোপাল মণ্ডল, বিধান সরদার, হিন্দু যুব মহাজোট কালিগঞ্জ শাখার সাধারণ সম্পাদক তাপস মজুমদার প্রমুখ।

বক্তারা বলেন, ২০১২ সালের ২৭ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উদযাপন উপলক্ষে কালীগঞ্জের ফতেপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে মঞ্চস্ত ‘হুজুরে কেবালা’ নাটকে মহানবী(স্বাঃ)কে কটুক্তি করা হয়েছে এমন মিথ্যা খবর ২৯ মার্চের দৃষ্টিপাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এর জের ধরে ৩০ মার্চ ফতেপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেজায়ান হারুন ও সহকারি শিক্ষক মিতা রানী বালাকে আটক করে জেলে পাঠান তৎকালিন থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফরিদ হোসেন। ওইদিন বিকেলে দক্ষিণ শ্রীপুর ইউপি সদস্য জাফর সাঁফুইকে দিয়ে নাটক পরিচালনাকারি মীর শাহীনুর রহমানসহ সাত জনের নামে থানায় মামলা করান তৎকালিন কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ ফরিদউদ্দিন।

মহানবীকে কটুক্তি করার গুজবে কৃষ্ণনগর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ২০১৮ সালে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত মোশারফ হোসেন ও তৎকালিন কৃষ্ণনগর ইউপি চেয়ারম্যান আনছারউদ্দিন(প্রয়াত) ও চৌমুহুনী ফাজিল মাদ্রাসার তৎকালিন সুপার আব্দুল কাদের হেলালীর নেতৃত্বে দু’টি মিছিল ৩১ মার্চ সকালে ফতেপুর মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়, শাহীনুর মীর, বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সদস্য আব্দুল হাকিম, শিক্ষিকা মিতা রানী বালা ও লক্ষীপদ মণ্ডলের বাড়ি মিতা রানী বালাসহ কয়েকজনের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ফতেপুর সাংস্কৃতিক পরিষদ ভাঙচুর ও লুটপাটের পর আগুণ দেওয়া হয়। জুলফিকার সাঁফুই ও জাফর সাঁফুই এর নেতৃত্বে লক্ষীপদ মণ্ডল ও মিতা রানী বালার বাড়িতে দ্বিতীয় দফা অগ্নিসংযোগ করা হয়।

ফতেপুরের সহিংসতার জের ধরে ওই বছরের পহেলা এপ্রিল চাকদহ গ্রামের কাপালিপাড়ায় আটটি হিন্দু বাড়িতে লুটপাঠ শেষে ভাঙচুর চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করা হয়। জীবন বাঁচাাতে এক গৃহবধু পালিয়ে বিচালী গাদার মধ্যে অবস্থান নিলে তাকে ধর্ষণ করা হয়।

সহিংসতার সকল ঘটনায় ৫ এপ্রিল দায়েরকৃত চারটি মামলায় ৯৪ জনের নামসহ অজ্ঞাতনামা দু’ হাজার ২০০ লোককে আসামী শ্রেণীভুক্ত করা হয়।

বক্তারা আরো বলেন, কর্তব্যে অবহেলার দায়ে কালীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক ও বর্তমানে সাতক্ষীরার পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লস্কর জায়াদুল হককে বাগেরহাটে স্ট্যাণ্ড রিলিজ করা হয়। ৮ এপ্রিল তৎকালিন পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান খান ও কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ ফরিদউদ্দিনকে প্রত্যাহার করা হয়। ১০ এপ্রিল তৎকালিন জেলা প্রশাসক আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের নির্দেশে দৃষ্টিপাত পত্রিকার প্রকাশনা বাতিল করা হয়। ১২ এপ্রিল অস্ত্রধারি শিবির ক্যাডার দৃষ্টিপাত পত্রিকার সাংবাদিক মিজানুর রহমানকে গাজীপুর সদরের একটি ব্যাচেলার ছাত্রবাস থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২৫ এপ্রিল তৎকালিন পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান খান ও কালীগঞ্জ থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ ফরিদউদ্দিনকে হাইকোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ভৎর্সনা করা হয়।

হাইকোর্টের নির্দেশে ওই বছরের ১২ জুন অতিরিক্ত যুগ্ম সচীব একেএম জহরুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি সাতক্ষীরা সার্কিট হাউজে ঘটনার তদন্ত করেন। পরবর্তীতে জাফর সাঁফুই এর দায়ের করা মামলা খারিজ হয়ে যায়। নীলকণ্ঠপুরের যুবলীগ নেতা খলিলুর রহমানের দায়েরকৃত মামলায় রাষ্ট্রোদ্রাহ আইনে ২০১৪ সালের ৩০ জুলাই উপপরিদর্শক নকীব অয়জুল হক আদালতে দৃষ্টিপাত সম্পাদক জিএম নূর ইসলামসহ ছয়জনের নামে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। তথ্য গোপন করে আসামী পক্ষ ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর হাইকোর্টে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেন।

হাইকোর্ট খারিজ করায় পরবর্তীদে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলে ২০১৯ সালের ১০ জুলাই তা খারিজ হয়ে যায়। এর ১৬ মাস পর গত ৪ জানুয়ারি বাদির নারাজী আবেদন শুনানী শেষে ওই মামলা পূণঃতদন্তের জন্য গোয়েন্দা পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়। সে অনুযার্য়ি গত শনিবার গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক হাফিজুর রহমান তদন্ত শুরু করেন। ফলে সহিংতার নয় বছর পর মামলাটি ভিন্নভাবে পবাহিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়।

বক্তারা আরো বলেন, ২০০৩ সালে ফতেপুরের গোবিন্দ লাল সরদার ও তার মাকে দিগম্বর করে জামায়াত নেতা মনিরুল ও আবু আসলাম লাল্টুর নেতৃতে বাড়ি দখল করে নেওয়া হয়। গত ২ জানুয়ারি জামায়াত কর্মী আবু আসলাম লাল্টুর নেতৃত্বে সঞ্জয় সরদারের জমিস দখলের চেষ্টা করা হলেও পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করে। গত শুক্রবার সঞ্জয় সরদার জমিতে ধান চাষ করতে গেলে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লাল্টু শেখের পক্ষ নিয়ে পাওয়ার ট্রিলার আটক করে মালিত বিশ্বনাথ মণ্ডলকে ১২ ঘণ্টা থানায় আটক রাখে।

সঞ্জয়ের জমি বেদখল করার জন্য পুলিশ ও কতিপয় জনপ্রতিনিধি চেষ্টা চালাচ্ছে। কামদেবপুরের লক্ষণ সাহার চিংড়ি ঘের লুটপাট ও ঘেরের বাসায় আগুনি দিয়ে প্রতিপক্ষরা দখলে নেয়। অথচ ১৫ দিন পর সেই প্রতিপক্ষের দায়েরকৃম মিথ্যা মামলায় লক্ষণ সাহাসহ গ্রামের হিন্দু পুরুষরা বাড়ি ছাড়া। একইভাবে নিয়ম বহির্ভুতভাবে শ্যামনগরের কাচড়াহাটিতে উৎপল মণ্ডল ও তার শরীকদের জমি নিয়ম বহিভর্ৃুতভাবে ডিসিআর দিলে বাধা দেওয়ায় ওই পরিবারের নয়জনকে পিটিয়ে জখম করা হয়েছে।

ফতেপুর চাকদাহের সহিংসতার ঘটনায় বিচার হলে সংখ্যালঘুদের উপর একের পর এক হামলা মামলা হতো না বলে বক্তারা অভিযোগ করেন। তারা অবিলম্বে ঘটনার নাংক জিএম নূর ইসলামসহ সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

(আরকে/এসপি/জানুয়ারি ২৪, ২০২১)