তারেক হাবিব, হবিগঞ্জ : যে কোন অপরাধীদের আত্মশুদ্ধি বা শোধরানোর জায়গা হল কারাগার। প্রত্যেক আসামির জন্য কারাগার হল এক জীবণ সংগ্রামের পথপ্রর্দশক । অথচ সেই কারাগারে চলছে অনিয়ম-দুর্নীতিসহ হরেক রকম অপরাধমূলক কর্মকান্ড। এমনটি সত্যতা মিলেছে হবিগঞ্জ জেলা কারাগারে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কারা কেন্টিনে বড় অংকের উৎকুচ হাতিয়ে নিয়ে চুক্তিতে পোস্টিং ও ডিউটি বন্টনে গুরুত্বপূর্ণ পদে পোস্টিং, পণ্যসামগ্রী ক্রয়-বিক্রয় মূল্যে সীমাহীন দুর্নীতি, বন্দিদের নিম্নমানের খাবার বন্টন, স্টাফদের রেশন-বন্দীর বরাদ্দকৃত খাদ্য সামগ্রী নিয়ে দুর্নীতি, স্টাফদের ছুটি নিয়ে বাণিজ্য, বন্দি বেচা-কেনা ও সিট ভাড়া আদায় নামে বাণিজ্য, প্যারিমিটার ওয়ালের সাথে হাসের খামার বাণিজ্যসহ কতিপয় অসাধু কারারক্ষীদের দৌড়াত্ব অপরিসীম। এতে উদ্বেগ উৎকন্ঠার মধ্যে থাকতে হচ্ছে কয়েদি/আসামি ও কারারক্ষীসহ কারাগারের বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের। আর এসকল কর্মকান্ডের নাটের গুড়ু হলেন জেল সুপার জাকির হোসেন ও জেলার জয়নাল আবেদীন ভূইয়া। তাদের নেতৃত্বেই কারাগারে গড়ে তোলা হয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতির পাহাড়। যদিও বিগত ২৬ নভেম্বর ২০২০ ইং-তারিখে কারা উপ মহাপরিদর্শক (সিলেট) স্টাফ দরবারে অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছিলেন কিন্তু সেই নির্দেশ আজ উপেক্ষিত।

সম্প্রতি (১৮ জানুয়ারি) সকালে হবিগঞ্জ জেলা কারাগারে ঘটেছে নজির বিহীন এক আলোচিত ঘটনা। যাহা প্রাচীন যুগের সতীদাহ প্রতাকেও হার মানিয়েছে। সেখানের জেল সুপার ও জেলারের নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে স্টাফ কোয়ার্টারে থাকা কারারক্ষী সজীব মিয়া (২৭) নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেন। বর্তমানে তিনি মৃত্যুশয্যায় কারাগার হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। তাও অতি গোপনে। তার অপরাধ ছিল কারাগারের ভেতরে থাকা অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, গত ২৬ নভেম্বর ২০২০ তারিখে বর্তমান ডি আই জি প্রিজন সিলেট কামাল আহমদ ৪/৫গুণ বেশি দামে পণ্য বিক্রয়ের দায় দালাল কারারক্ষী এরশাদ মিয়া, আনিছ আহমদ ও রিয়াজুল ইসলাম ক্যান্টিনের দায়িত্ব থেকে সরানোর নির্দেশ প্রদান করলেও রহস্যজনক কারনে আজ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে নেয়া হয়নি কোন প্রশাসনিক আইনি ব্যবস্থা। এছাড়া নিজ স্বার্থ হাসিল করতে কারা আদেশ অমান্য করে সাময়িক বরখাস্ত আরেক কারারক্ষী সজল মাহমুদকে ক্যান্টিনের দায়িত্বভার দিয়ে দেন দুর্নীতিবাজ জেল সুপার ও জেলার নিজে।

উল্লেখ্য, এর পূর্বে লক্ষীপুর জেলা কারাগারে থাকাকালীন সময়ে জেলার জয়নাল আবেদীন বন্দির কাছ থেকে লক্ষ টাকার বিনিময়ে মোবাইল বিক্রয় অভিযোগে সাময়িক বরখাস্তসহ একাধিক গুরুদন্ডে শাস্তিপ্রাপ্ত হন। এদিকে জেল ডির্পাটমেন্টের কোন সদস্য না হওয়া সত্বেও সুহাগ মিয়া নামক এক দুর্বৃত্ত সরকারী কারারক্ষী ব্যারাকে থাকার গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই ব্যক্তি জেল সুপার ও জেলারের নাম ভাঙ্গিয়ে বন্দিদের বরাদ্দকৃত খাদ্য সামগ্রী ও স্টাফদের রেশন সঠিক ভাবে বন্ঠন না করে নামে মাত্র মূল্য দেখিয়ে বাহিরের বিভিন্ন হাটবাজারে সেই পণ্য বিক্রয় করে দেন।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, জেল সুপার নিজে জিয়াউল হক নামক এক কারারক্ষীকে দিয়ে তার বাসার আসবাবপত্র, কাপড় ধৌত, রান্না-বান্না ও ঘর মুছার কাজ করিয়ে থাকেন। কারাগারের বিভিন্ন প্রাচীর ও ওয়াচ টাওয়ার লোক স্বল্পতা দেখিয়ে তা খালি করে রাখেন জেল সুপার নিজে। এতে কারা নিরাপত্তা হুমকি স্বরুপ!

বহুল আলোচিত আরেক কারারক্ষী কাওসার মিয়া। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকের দায়ের করা একটি মামলা প্রক্রিয়াধিন রয়েছে । তার কাছ থেকে বড় অংকের উৎকুচ হাতিয়ে নিয়ে জেল সুপার নিজে বন্দিদের খাবার বন্টন সহ গুরুত্বপুর্ন বহাল রেখেছেন। স্টাফদের ছুটি নিয়েও চলে রমরমা বাণিজ্য । মাত্র ৩ হাজার টাকা ঘুষ দিলে বছরে ২০ দিনের বেশি ছুটি দেয়া হয় অনায়াসে। নিত্য নতুন বন্দিরা কারাগারে প্রবেশ করা মাত্র ওয়ার্ডে সিট দেয়ার কথা বলে জনপ্রতি লোকের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয় ২৫০০ টাকা হারে। জেলকোড আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বছরের পর বছর যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত বন্দিদের নিজ জেলা কারাগারে রেখে দেয়া হয়েছে। তাও লাখ লাখ টাকা বাণিজ্যে আদায়ে। সেই বন্দিরা হলেন, (১) শাবাজ মিয়া, (২) সালাহ উদ্দিন, (৩) লাল মিয়া, (৪) জসিম উদ্দিন, (৫) রনি, (৬) নজরুল ইসলাম ও (৭) রাসেল । তারা সকলেই জেল সুপার ও জেলারের আর্শিবাদপুষ্ট পালা বাহিনীর শীর্ষ ভক্ত হিসেবে খ্যাত।

এখানেই শেষ নয় কারাগারে থাকা প্যারিমিটার ওয়ালের সাথে বা আশপাশে কোন গাছ রোপন-কোন ধরণের স্থাপনা গড়ে তোলা যাবে না বিধি-নিষেধ থাকলেও কোনটাই মানছে না এই দুই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। রহস্যজনক হলেও সত্য যে, প্যারিমিটার ওয়ালের পার্শ্ববর্তী এলাকায় একটি সেল রয়েছে । জঙ্গি ও মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন শীর্ষ আসামী সেই সেল-এ অবস্থান করছে। কিন্তু সেখানে বাঁশের কুটি, টিনশেডের ঢালা ও বেড়া দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে হাঁসের খামার! এতে যে কোন সময় আসামীরা পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান।

এদিকে কারাগারে ঘটে যাওয়া সকল অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য অধিদপ্তরে জানানোর দায়িত্বে থাকা কারারক্ষী সদস্য জিহাদ এখনও নাকে তৈল দিয়ে ঘুমের ঘরে বাস করছে। সে প্রতিমাসে কাড়ি কাড়ি টাকা কামানোর আসায় সঠিক দায়িত্ব পালনে বিমূখ। এভাবেই দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে হবিগঞ্জ জেলা কারাগার।

এ বিষয়ে জানতে জেল সুপার জাকির হোসেনের সহীত মুটোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, কোন স্বার্থান্বেষী মহল কারাগারের ভাবমূর্তী বিনষ্ট করতে এরকম কর্মকান্ড করছে। এসময় তিনি কারাগারে কিছু ফলফ্রুটের গাছ লাগানো রয়েছে বলে দাবি করে বলেন, কারাগারে সব কর্মকান্ড চলে উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের নির্দেশ মোতাবেক। সেখানে কোন ধরণের দুর্নীতির স্থান নেই বলে জানান।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারাগারে হাঁসের খামার রয়েছে তবে তা ক্ষতির কোন সম্ভাবনা নেই বলে দাবি করেন। অন্যান্য অভিযোগ ঢাহা মিথ্যা বলে জানিয়েছেন তিনি।

এ নিয়ে জেলার জয়নাল আবেদীন ভূইয়ার মুটোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, কারাগারে কোন হাঁসের খামার নেই বা কোন গাছপালা নেই। জেল সুপারের ন্যায় অন্যান্য অভিযোগগুলো মিথ্যা বলে দাবি করেন তিনি।

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারারক্ষি সজিব যে ঘটনাটি ঘটিয়েছে সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয় । একপর্যায় তিনি কারারক্ষী জিয়াউল জেল সুপারের বাসায় মাঝে মধ্যে বিস্কুট জাতিয় দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে যায় বলে জানান তিনি।

আত্মহুতির চেষ্টা সজিবের মুঠোফোনে আলাপকালে তিনি গুরুতর অসূস্থ থাকায় কথা বলতে পারবেন না বলে জানিয়ে সংযোগটি কেটে দেন।

এ ব্যাপারে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসানের সহীত মুঠোফোনে আলাপকালে তিনি বলেন, এরকম অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে তার কিছু জানা নেই। তবে তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলে জানান।

(টিএইচ/এসপি/জানুয়ারি ২৫, ২০২১)